ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১১ মার্চ ১৯৪৮, পূর্ববঙ্গে সাধারণ ধর্মঘট

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১২ মার্চ ২০১৮

১১ মার্চ ১৯৪৮, পূর্ববঙ্গে সাধারণ ধর্মঘট

২৮ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিস এবং পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথসভায় রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটি গঠিত হওয়ায় ইতিপূর্বে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অনানুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে। শূন্যতা পূরণ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সুসংগঠিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে ২ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে কমরুদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে বিভিন্ন ছাত্র-যুব-রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন আবুল কাসেম, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল আলম, রণেশ দাসগুপ্ত, আজিজ আহমদ, অজিত গুহ, শামসুদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল আলী, সরদার ফজলুল করিম, আলী আহমেদ, মহীউদ্দিন, শওকত আলী, আনোয়ারা খাতুন, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল আউয়াল, শহীদুল্লা কায়সার, তাজউদ্দিন আহমদ, লিলি খান, নুরুল আলম, আবদুল অদুদ প্রমুখ। সংগঠনগতভাবে গণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম ছাত্রলীগ, ছাত্র ফেডারেশন, প্রগতি লেখক সংঘ এ দিনের সভায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সভায় শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির দুটি সভা ৪ ও ৫ মার্চ ১৯৪৮ ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত হয়। ১০ মার্চ একই হলে অনুষ্ঠিত সংগ্রাম কমিটির সভায় ১১ মার্চের সাধারণ ধর্মঘটের বিস্তারিত কর্মসূচী চূড়ান্ত করা হয়। ঢাকা শহরের কোন কোন স্থানে পিকেটিং হবে, কে কোন পয়েন্টে নেতৃত্ব দেবে ইত্যাদি ঠিক করা হয় এই সভায়। ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান নিয়েও নানা ধরনের চক্রান্ত চলে। আন্দোলনের অনভিজ্ঞতা, ভয়ভীতি, মুসলিম লীগ সরকারের ষড়যন্ত্র, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফর সবকিছু মিলিয়ে নেতৃত্বের অনেকেই দোদুল্যমানতায় ভুগছিলেন কর্মসূচী বাস্তবায়ন নিয়ে। ভাষা আন্দোলনের এই পর্বে তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর দূরদৃষ্টি, সাহস এবং সাংগঠনিক দক্ষতা প্রথম পর্যায়ের এ আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আন্দোলনকে সংগঠিত করে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে যেতে তাঁর দৃঢ়প্রত্যয়ী ভূমিকা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক বলেন, ‘ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের একটি সভা বসল। সভায় আপোসকারীদের ষড়যন্ত্র শুরু হলো। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বায়কসহ অনেকেই তখন দোদুল্যমানতায় ভুগছে, আপোস করতে চাইছে সরকারের সঙ্গে। একটি বজ্রকণ্ঠ সচকিত হয়ে উঠল- সরকার কি আপোস প্রস্তাব দিয়েছে? নাজিমুদ্দিন সরকার কি বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে তবে আগমীকাল ধর্মঘট হবে, সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে। এই বজ্রকণ্ঠ ছিল শেখ মুজিবের। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে সমর্থন দিলেন অলি আহাদ, তোয়াহা, মোগলটুলীর শওকত সাহেব, শামসুল হক সাহেব। আপোসকামীদর ষড়যন্ত্র ভেসে গেল।’ [সূত্র : ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, লেখক : মাযহারুল ইসলাম, পৃ. ২৪-২৫] গাজীউল হকের বক্তব্যের সমর্থন মিলল অলি আহাদের কথায়। এ প্রসঙ্গে অলি আহাদ বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় যদি মুজিব ভাই ঢাকায় না পৌঁছাতেন তাহলে ১১ মার্চের হরতাল, পিকেটিং কিছুই হতো না।’ [সূত্র : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-জীবন ও রাজনীতি, প্রথম খ-, সম্পাদক-মোনায়েম সরকার, পৃ. ১৬৭] ১১ মার্চের সাধারণ ধর্মঘট সফল করার জন্য ভোর থেকেই ছাত্ররা রাস্তায় নেমে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জগন্নাথ কলেজসহ ঢাকা শহরের প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্ররা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পিকেটিং করে। নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাক, টেলিগ্রাফ অফিস, রেলওয়ে ওয়ার্কসপ ও রমনা পোস্ট অফিসে অবরোধ কর্মসূচী পালিত হয়। অফিসগামী জনসাধারণকে ফিরিয়ে দেয় পিকেটাররা। হাইকোর্টের গেটেও ছাত্ররা পিকেটিং করে এখানে কতিপয় আইনজীবীর সঙ্গে ছাত্রদের বাকবিত-া হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেক্রেটারিয়েট (তৎকালীন ইডেন বিল্ডিং) ছিল উত্তপ্ত। ছাত্রনেতারা এখানে পিকেটিং করে। পুলিশ ছিল বেপরোয়া মারমুখী। ছাত্রনেতারা অফিসার-কর্মচারীদের ধর্মঘটে অংশগ্রহণ এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়। আন্দোলনের নেতা শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ সেক্রেটারিয়েটের প্রথম গেটে এবং কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রমুখ দ্বিতীয় গেটে পিকেটিং এ নেতৃত্ব দেন। এখানে পুলিশ বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে এবং কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, শামসুল হক, অলি আহাদসহ আরও অনেককে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পুলিশি নির্যাতন এবং ছাত্রনেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ওইদিন দুপুরবেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক বিরাট সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন। সভায় বক্তারা পুলিশি নির্যাতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানান। তাঁরা গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার উদাত্ত আহ্বান জানান। সভাশেষে এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিল কার্জন হল অতিক্রম করে হাইকোর্টের সামনে পৌঁছুলে পুলিশ মিছিলে বাধা প্রদান করে । মিছিলটি তোপখানা রোডে না যেয়ে আবদুল গণি রোডে ঢুকে পড়ে এবং সেক্রেটারিয়েটের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই সময় পুলিশ সুপার আবদুল গফুরের নেতৃত্বে পুনরায় ছাত্রদের উপর হামলা চালানো হয়। পুলিশের বন্দুকের বাঁটের আঘাতে মোহাম্মদ তোয়াহা আহত হলে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি সরকারের লেলিয়ে দেয়া গু-াবাহিনীও ছাত্রদের উপর হামলায় অংশ নেয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আয়োজিত সেদিনের বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক সরকারী কর্মচারী এবং সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি যে ব্যাপকতর মানুষের মাঝেও আবেদন সৃষ্টি করেছে তা এ থেকে সহজেই স্পষ্ট হয়ে উঠে। চলবে... লেখক : গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×