ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্লো মোশনে রোহিঙ্গা গণহত্যা দেখেছি

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ১০ মার্চ ২০১৮

স্লো মোশনে রোহিঙ্গা গণহত্যা দেখেছি

॥ রাখাইন প্রদেশ, মিয়ানমার ॥ সোনো ওয়ারা সারাটা দিন কেঁদে কাটিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় তাঁর চোখের পানি শুকিয়ে গেলেও মাতৃস্তন থেকে চুয়ে আসা দুধে তার গায়ের জামাটা তখনও ভিজে চলেছিল। আগের দিন তার সদ্যজাত যমজ শিশু দুটো মারা গেছে। ছনের কুটিরের ভেতর উবু হয়ে বসা ছিল সে। ব্যথা-বেদনা ও শোকে বিপর্যস্ত। ওর বয়স ১৮। এটাই ছিল প্রথমবারের মতো তার সন্তান গর্ভে আসা। কিন্তু রোহিঙ্গা জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বলে সে কোন ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পারেনি। কাজেই জটিল ধরনের প্রসবের পর তার যমজ শিশু দুটি মারা যায়। তাকে মাটি পুঁতে কবর দেয়া হয়। কখনও কখনও মিয়ানমার জাতি নিধনের জন্য গুলি ও চাপাতি ব্যবহার করে। আর এভাবেই এর আগে সোনো ওয়ারা তাঁর মা ও বোনকে হারিয়েছিল। তবে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার সুযোগের পথ নিয়মিত বন্ধ রেখে এবং মানবিক সাহায্য রুদ্ধ করে আরও সূক্ষ্মভাবে ও গোপনে তাদের হত্যা করে চলেছে। আর সে জন্যই তার যমজ শিশু দুটো মারা গেছে। মিয়ানমার ও তার নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নেত্রী আউং সান সুচি রোহিঙ্গাদের জীবন বসবাসের অযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করছে অথচ এর কোন প্রত্যক্ষদর্শী থাকতে দিচ্ছে না। গত কয়েক মাসে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। তবে যারা রয়ে গেছে তাদের পরিণতি কি তা পরিষ্কার নয়। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিয়ানমার বিদেশীদের রোহিঙ্গা এলাকায় যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। সেনাবাহিনীর হাতে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের ওপর প্রতিবেদন করার জন্য রয়টারের দুই সাংবাদিককে গ্রেফতারের মধ্যদিয়ে সরকার হুঁশিয়ারি সঙ্কেত জানিয়ে দিয়েছে অসাধারণ সাংবাদিকতার নিদর্শন রাখার জন্য। এই দুই রিপোর্টারের ১৪ বছর কারাবাস হতে পারে। ট্যুরিস্ট ভিসায় মিয়ানমারে প্রবেশের পর আমি সবার নজর ফাঁকি দিয়ে চুপিসারে পাঁচটি রোহিঙ্গা পল্লীতে যেতে সক্ষম হই। আমি যা দেখতে পেয়েছি তা ছিল এক সেøা মোশনের গণহত্যা, গত আগস্ট মাসে যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও চাপাতি হামলা হয়েছিল আপাতত তা আর হচ্ছে না। তবে রোহিঙ্গারা তাদের গ্রামগুলোতে তথা এক বিশাল জঙ্গী শিবিরে আবদ্ধ। তাদের সুপরিকল্পিতভাবে শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। অতএব তারা মারা যায়। কেউ মৃত্যুর সংখ্যা সঠিকভাবে গুণে দেখে না। তবে আমার ইন্দ্রিয়ই বলে দিচ্ছে যে, মিয়ানমার সরকার গুলি করে বা চাপাতি দিয়ে যত রোহিঙ্গা মেরেছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় রোহিঙ্গা মারছে তাদের চিকিৎসার সুযোগ এবং কখনও কখনও খাদ্য থেকে বঞ্চিত রেখে। বৌদ্ধ প্রধান একটি দেশে অতি ঘৃণা ও অবজ্ঞার শিকার মুসলিম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের খবর সংগ্রহের জন্য চার বছরে এ নিয়ে আমি চার বার মিয়ানমারে গেছি। গোড়ার দিকে আমি ‘জাতিগত শুদ্ধি অভিযান’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। তবে অনেক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকের সঙ্গে আমিও এই উপসংহারে পৌঁছেছি যে, এখানে যা ঘটছে সম্ভবত তাকে গণহত্যা বলা যায়। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিতবর্গ এবং ইউএস হলোকস্ট মিউজিয়াম ইতোমধ্যে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে- এটা হয়ত গণহত্যা। জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান জাইদ বাদ আল-হোসেনও তেমনই মন্তব্য করেছেন। এই গণহত্যা কখনও কখনও সহিংস হামলার রূপ ধারণ করে। তবে এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে খাদ্য ও চিকিৎসার পথ বন্ধ করে দিয়ে গণহত্যা চলছে। মিয়ানমার বা অন্য নামে বর্মার ঘটনায় বিশেষজ্ঞ জ্ঞান আছে এমন এক মানবাধিকার গ্রুপ ‘ফর্টিফাই রাইটস্’ ম্যাথু স্মিথ বলেন, ‘গণহত্যা যারা করে এই কৌশলগুলো তাদের কেতাবী নিয়মকানুনের বাইরে। অর্ধভুক্ত রেখে একটি জনগোষ্ঠীকে সুপরিকল্পিতভাবে দুর্বল করে দেয়া অন্যান্য গণহত্যারও একটা বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা যাচ্ছে।’ সোনো ওয়ারা প্রসবপূর্ব কিংবা জরুরী কোন চিকিৎসা সেবা লাভ করতে পারেনি। কোন সঙ্কটে পড়লে একজন রোহিঙ্গা জনসাধারণের চলাচলের রাস্তা দিয়ে কোন সরকারী ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য পুলিশের অনুমতি চাইতে পারে। কিন্তু সেখানে ডাক্তার থাকে না। তাছাড়া ক্লিনিকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও অনেক সময় রোহিঙ্গাদের থাকে। কাজেই ক্লিনিকে পুলিশের এসকর্ট নেয়ার জন্য তাদের অবশ্যই পয়সা দিতে হয়। এতে খরচ বেড়ে যায়। বিকারগ্রস্তের মতো কণ্ঠে সোনো ওয়ারা বলল, ‘আমার ক্লিনিকে যেতে ভয় লেগেছিল। সেখানে রোহিঙ্গাদের কোন পাত্তাই দেয়া হয় না।’ শারীরিক ব্যথা ও যন্ত্রণা এবং আবেগত দুঃখ ও বেদনাকে ছড়িয়ে তার ওপর ভর করে আছে সার্বক্ষণিক ভীতি। আগস্টে একের পর এক সহিংসতার তান্ডবের সময় তাদের গ্রামটি আক্রান্ত হয়নি। তবে সোনো ওয়ারা বলে, ‘সেই হামলা এখানে হতে পারত।’ ২০১২ সালে নিকটবর্তী একটি গ্রামের লোকেরা চাপাতি দিয়ে হামলা করে তাঁর মা ও বোনকে হত্যা করেছিল। একটি তত্ত্ব¡ এই যে, মিয়ানমার এমন এক দুর্দশা ও ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করছে, যাতে রোহিঙ্গারা নিজ থেকেই পালিয়ে যায়। ফলে সেনাবাহিনীকে ব্যাপক হত্যাকান্ডের মতো বিচ্ছিরি কাজে হাত দেয়ার প্রয়োজন হবে না। সোনো ওয়ারা জানায় সে ও তার স্বামী মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করেছে। তবে সেটা অনেক বিঘ্ন সঙ্কুল যাত্রা সেখানে প্রায়শই ওত পেতে থাকে ধর্ষণ, ডাকাতি ও মৃত্যুর আশঙ্কা। গত আগস্টে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক হারে দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে পাইকারি হত্যা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যে সব কাহিনী বেরিয়ে এসেছিল তাতে মিয়ানমারের জাতি নিধনের ঘটনা লুকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। গত বছরের শেষ দিকে ওইসব শরণার্থীর সাক্ষাতকার নিতে গিয়ে আমি হাসিনা বেগম নামে এক মহিলার বিবরণ শুনে সবিশেষ কম্পিত বোধ করেছিলাম। হাসিনা আমাকে বলে কিভাবে সৈন্যরা তার গ্রামের পুরুষ ও বালকদের হত্যা করেছিল, তাদের লাশগুলো আগুনে ছুড়ে বহ্নুৎসব করেছিল এবং তারপর মহিলাদের একটি কুটিরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছিল। হাসিনা বেগম জানায়, ‘আমি আমার বাচ্চাটিকে আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওরা ওর পাটা দেখে ফেলে। তারপর তারা পা ধরে টেনে নিয়ে আমার শিশুটিকে আগুনে ছুড়ে ফেলে।’ গ্রামগুলোতে রয়ে যাওয়া নর-নারীর ক্ষেত্রে যা ঘটছে তা আরও নগ্ন ধরনের নিষ্ঠুরতা। শুধু নৌকায় করে বা হেঁটে যাওয়া যায় এমন এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমি উমর আমিন নামে ৪ বছরের এক শিশুকে দেখতে পাই যার শারীরিক বিকাশ ছিল বাধাপ্রাপ্ত। তাঁর বড় বোন তাকে গোসল করিয়ে দিচ্ছিল। আমি একটি এমইউএসি স্ট্রিপ বের করে নেই যা দিয়ে উপরের বাহুর বেড় মেপে শিশুর অপুষ্টি পরিমাপ করা হয়ে থাকে। উমর আমিন অবস্থান ছিল বেড় ডেঞ্জার জোনে। তার মানে অতি গুরুতর অপুষ্টির শিকার ছিল সে। সে হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না। অন্যের সাহায্য লাগে। অথচ তাকে কখনও ডাক্তার দেখানো সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক সাহায্য গোষ্ঠীগুলো উমর আলীর মতো শিশুদের সাহায্য করতে আগ্রহী এবং তার জন্য প্রস্তুতও। কিন্তু সরকার প্রায়ই তাদের বাধা দেয়- বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকাগুলোতে। এই মানবিক সাহায্য লাভের সুযোগ না দেয়াটা যে রোহিঙ্গাদের চরমভাবে নিষ্পেশিত করে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যমূলক নীতি ছাড়া আর কিছু নয় তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এটাই একটা কারণ যে, আমি এই ব্যাপারটিকে স্লো মোশনের গণহত্যা হিসেবে দেখি। মিয়ানমারের মানবাধিকারের জন্য অবিচল সংগ্রামের কারণে যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন সেই লেডি আউং সান সুচি কি করছেন? তিনি এখন মিয়ানমার সরকারের সার্থক নেত্রী। তিনি এই গণহত্যার একজন সমর্থক হিসেবেই শুধু নন উপরন্তু এতে যোগসাজশকারী হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছেন। গণহত্যায় যারা নিয়োজিত হয়েছিল সেই সেনাবাহিনীকে সুচি নিয়ন্ত্রণ করেন না সত্য, তবে তিনি সাহায্য সংস্থাগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে সাহায্য করেছেন। রোহিঙ্গা শব্দটি নাকচ করে দিয়ে এবং তারা বাংলাদেশ থেকে আগত বেআইনী অভিবাসীমাত্র- এ কথা বলে তিনি রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব মুছে ফেলারও চেষ্টা করেছেন। (বস্তুতপক্ষে ১৭৯৯ সালের একটি দলিলে দেখা গেছে যে, তখনও রোহিঙ্গারা এখানে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল)। আর তাঁর সরকারই রয়টারের দুই রিপোর্টারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে। আমি দি নিউইয়র্ক টাইমস কোম্পানি আয়োজিত মিয়ানমার সফরের একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম বলে একটা ট্যুরিস্ট ভিসা পেতে সক্ষম হয়েছিলাম। ভিসা দেয়ার সময় আমাকে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছিল যে আমি যেন কোন অবস্থাতেই রিপোর্টিং না করি। সাধারণভাবে আমি বিশ্বাস করি যে সাংবাদিকরা সে দেশে যান সেখানকার আইনকানুন তাদের মেনে চলা উচিত। কিন্তু যখন কোন শাসকগোষ্ঠী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনে এবং সেই অপরাধ আড়াল করতে নিজস্ব আইন-কানুনকে ব্যবহার করে তখন আমি এর অন্যথা করি। এই সফরের একটি ক্ষেত্রে আমি সন্ধ্যা নামার পর এসেছিলাম, যাতে আমার হদিস পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। অন্যান্য ক্ষেত্রে গ্রামবাসীই আমাকে পুলিশের নজর এড়ানোর জন্য কোন্ পথে যাওয়া উচিত তা বাতলে দিয়েছিল। দুটি গ্রামে পৌঁছানোর জন্য আমি পুলিশের চেক পয়েন্ট এড়াতে নৌকায় চড়েছিলাম। নৌকাযোগে পৌঁছানো একটি গ্রামে জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে আমার দেখা হয়। সে তখন তার ২০ বছরের বউ জাহান আরার মৃত্যুতে শোকার্ত ছিল। সন্তান প্রসব করতে গিয়ে জাহান আরা মারা যায়। মারা যায় শিশুটিও। ওটা ছিল মেয়েটির পেটে প্রথম বাচ্চা আসা। অথচ সে কোন চিকিৎসা সহায়তা পায়নি। জয়নুল আবেদিন বলেন, ‘হয়ত হাসপাতালেও সে মারা যেত। তথাপি তার অন্তত একটা সুযোগ থাকত। অথচ এভাবে সে কোন সুযোগই পেল না।’ জয়নুল পালানোর চেষ্টার কথা ভাবছে। মালয়েশিয়ায় তাঁকে পাচার করে দেয়ার জন্য মানব পাচারকারীদের ২৩০০ ডলার দিতে হবে। কর্তৃপক্ষ সাহায্যকর্মী ও সাংবাদিকদের খুঁজে বেড়ায়। অথচ এসব মানব পাচারকারীর ওপর থেকে তারা চোখ ফিরিয়ে নেয় বলে মনে হয়। তাদের অনেকে পথেই মারা যায়। এসব ঝুঁকির কথা জয়নুল আবেদিনের জানা। কারণ তাঁর নিজেরই বাবা মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর আশায় পালিয়ে ছিল। তারপর থেকে তাঁর কথা আর শোনা যায়নি। জয়নুল আবেদিন আমাকে বলে, আমরা খাঁচার পাখির মতো। ওরা আমাদের কম কম করে খেতে দেয় এবং আমরা ততই শুকাতে থাকি এবং তারপর মারা যাই অথবা আমরা পালানোর চেষ্টা করতে পারি এবং সেক্ষেত্রে ওরা আমাদের মেরে ফেলতে পারে। আজ প্রায় ৬ বছর ধরে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ নিজ গ্রাম ও বন্দী শিবিরগুলোতে সীমাবদ্ধ করে রাখার হয়েছে। গত আগস্ট মাসের হত্যাযজ্ঞের পর বিধিনিষেধগুলো আরও কড়াকড়ি করা হয়েছে। বয়স্করা আমার কাছে বিশেষ করে শিক্ষার অভাব সম্পর্কে অভিযোগ করেছে। কারণ রোহিঙ্গাদের নিয়মিত স্কুলগুলোতে লেখাপড়া করার সুযোগ দেয়া হয় না। গ্রামগুলো তাদের নিজস্ব অপ্রাতিষ্ঠানিক স্কুল চালানোর চেষ্টা করে। তবে কোন পাঠ্যবই নেই, ডেস্ক নেই, উপযুক্ত শিক্ষক নেই। শেখার কাজ খুব একটা হয় না। সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েদেরও কখনও হাই স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ নেই। এর ফলে একটা প্রজন্ম হারিয়ে যায়। মিয়ানমারের অনেক পাঠক আমার রিপোর্টিংকে অসমীচীন মনে করবে। কারণ তাদের ব্যাখ্যা একেবারেই ভিন্ন। এই রাখাইন রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দল আরাকান ন্যাশনাল পার্টির নেতা নতুন অং কাইয়াও আমাকে বলেছেন, তার দৃষ্টিতে সমস্যার মূল বিষয়গুলো হলো রোহিঙ্গারা বেআইনী অভিবাসী; তারা কয়েক দশক ধরে পৃথক ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের চেষ্টা করে আসছে; তাদের মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহী আছে যারা নৃশংসতা করে এবং মিয়ানমার সরকারের ওপর বদনাম চাপানোর জন্য নিজেরাই নিজেদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এটা মূলত বাজে কথা। যদিও অতি সত্য যে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গ্রুপ থানাগুলোতে হামলা চালিয়ে গত আগস্টের সহিংসতায় অংশ নিয়েছিল। ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস এর বিবরণ অনুযায়ী সেনাবাহিনীর এর জবাবে পোড়ামাটির কৌশল অবলম্বন করেছিল যার পরিণতিতে কক্ষপথে ৯ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ হারায়। সেনাবাহিনী মিয়ানমারের অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘু যেমন শান ও কারেনদের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে হিংস্র সন্ত্রাস দমন অভিযান চালিয়েছে। কাজেই সিভিলিয়ান হত্যা ও ধর্ষণের মধ্যে অতটা সাময়িক স্ট্র্যাটেজির পরিচয় পাওয়া যায় না যতটা প্রতিফলন পাওয়া যায় একই কাজের পুনরাবৃত্তির। রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারণা বিশেষ করে ফেসবুকের প্রচারণায় সাধারণ নাগরিকরা অনেক সময় প্রভাবিত হয়। রাখাইন গ্রামের এক মডারেট নেতা উ মং কাইয়াউ আমাকে জানায় যে, স্মার্টফোন ও ফেসবুকের আগমনের কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতি ঘৃণা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ঘোরতর রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারণা চলছে। তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে শুনে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে যারা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালায়। তিনি বলেন, তরুণরা প্রচুর স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। তারা নিজ চোখে দেখে না। ফোন দিয়ে দেখে। তিনি আরও বলেন, এ নিয়ে আমার ছেলের সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়েছে। ফেসবুক মিয়ানমারের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। সামরিক বাহিনী রাশিয়ায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত ইন্টারনেট ইউনিট আছে। একটা ধারণা হলো, সামাজিক মিডিয়ায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানের পেছনে সেনাবাহিনীর একটা ভূমিকা থাকতে পারে। মিয়ানমারের ওপর পাশ্চাত্যের খুব বেশি চাপ সৃষ্টির সুযোগ নেই। চীন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে থাকে। মিয়ানমারে মানবাধিকার সংক্রান্ত দীর্ঘদিনের বিশ্লেষক ডেভিড ম্যাথাইসন বলেন, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বাইরের প্রতিবাদে বহুলাংশেই কোন কাজ হয় না বরং কখনও কখনও হিতে বিপরীতে রূপ ধারণ করে এবং তখন মিয়ানমারের বর্ণনায় অতিরঞ্জন ফুটে ওঠে। তারপরও আমরা জাতিগত শুদ্ধি অভিযান থেকে উদ্ভূত সমস্যাার ব্যয়ভার সংগ্রহে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কাজ করতে পারি এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে গণহত্যা মোকাবেলার পদক্ষেপ গ্রহণে আমাদের একটা দায়িত্ব আছে। মার্কিন সরকার নির্যাতনকারীদের ধিক্কার জানানোর চাইতেও বেশি কিছু করতে এবং মানবিক সাহায্যকর্মীদের কাজের সুযোগ দেয়ার জন্য বিরামহীন চাপ প্রয়োগ করতে পারে। দেখে ভাল লেগেছে যে, জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি রোহিঙ্গাদের জীবনকে ‘মৃত্যুদ-ে পরিণত করার জন্য মিয়ানমারের নিন্দা করছেন। আমরা যুদ্ধাপরাধের তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা সমাজের প্রতি আহ্বান জানাতে পারি। ভয়েস অব আমেরিকার মাধ্যমে আমরা রোহিঙ্গা স্কুলগুলোর জন্য পাঠ সম্প্রচার করতে পারি। বিশ্বব্যাপী ও অভ্যন্তরীণ পরিসরে যখন টালমাটাল অবস্থা সে সময় রোহিঙ্গাদের এসব গ্রামের দুঃখ-দুর্দশা, যন্ত্রণা উপেক্ষা করা সহজ। আমরা সবাই ক্ষোভ ও পরদুঃখকাতরতার ভারে ক্লান্ত। তবে ভিন্ন এক গণহত্যায় দারুণভাবে বেঁচে যাওয়া এলি ওয়াইসেল নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণকালে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন : ‘জাতি, ধর্ম বা রাজনৈতিক মতের কারণে সেখানেই পুরুষ বা নারীরা নির্যাতিত হয় সেই স্থানটিকে সেই মুহূর্তে অবশ্যই বিশ্বজগতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে হবে।’ সেই বিচারে সোনো ওয়ারা যে পর্নোকুটিরে বসে তাঁর মৃত যমজ সন্তানদের জন্য কাঁদছে সেটাই এখন বিশ্বজগতের কেন্দ্রবিন্দু। সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
×