ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানের বিচারপতিরা কোন মিশনে নেমেছেন

প্রকাশিত: ০৪:১১, ৬ মার্চ ২০১৮

পাকিস্তানের বিচারপতিরা কোন মিশনে নেমেছেন

পাকিস্তানের সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি মিয়া সাকিব নিসার এক মিশনে নেমেছেন। সবচেয়ে সিনিয়র বিচারপতি দেশকে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের হাত থেকে মুক্ত করতে এবং আমাদের হরমোনমুক্ত চিকেন খাওয়াতে চান। সম্প্রতি রাজধানী ইসলামাবাদে বার সমিতির ক্যাফেটরিয়ায় হঠাৎ করে থেমে তিনি আইনজীবীদের বলেছিলেন : ‘আমার সংগ্রামের লক্ষ্য হচ্ছে বিশুদ্ধ বায়ু, বিশুদ্ধ পানি, বিশুদ্ধ দুধ।’ তিনি এ ব্যাপারে তাদের সাহায্য কামনা করেন। তাঁর করণীয় বিষয়ের তালিকায় আরও রয়েছে হেপাটাইটিস ও ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই এবং ফসলের ন্যায্য মূল্য আদায়। নিসার বলেছেন, পাকিস্তান পরাশক্তিতে পরিণত হতে না পারার একটা কারণ পাকিস্তানের বাগানের মালীরা কাজে ক্ষান্ত দিয়ে ধূমপান সেরে নেয়ার কাজটা চীনা মালীদের তুলনায় বেশি করে থাকে। তিনি আরও বলেন যে, বিচার বিভাগ হলো গ্রামের মুরুব্বিদের মতো। এর সততা নিয়ে কোন সংশয় থাকা উচিত নয়। গ্রামের মুরুব্বিদের মাঝে মাঝে পাগলামো এসে ভর করে। কিন্তু আমাদের প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে আমরা এমন কথা বলতে পারি না। কারণ এটা হবে এক গুরুতর অপরাধের সমতুল্য, যার নাম আদালত অবমাননা। এই অপরাধের জন্য ইতোমধ্যেই একজন সাবেক সিনেটর জেলে গেছেন এবং দুই মন্ত্রী শীঘ্রই তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে পারেন (এই তিনজনই শাসক পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজ বা পিএমএল-এন এর সদস্য)। সুতরাং নিসার যত্রতত্র গিয়ে অন্যান্য বিচারক, আইনজীবী ও সামগ্রিকভাবে নাগরিকদের নিজ নিজ কাজ করার এবং সেটা শুধু চাকরি হিসেবে নয়, বরং মনপ্রাণ ও আবেগ দিয়ে করার জন্য নসিহত করে বেড়াচ্ছেন। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে সুপ্রীমকোর্ট প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করার জন্য অভিযোগ আনে। এবং সেটা মন প্রাণ আবেগ ঢেলে করা হয়। কিছুদিন আগে নিসারের নেতৃত্বে গঠিত একটি প্যানেল নওয়াজ শরীফকে পিএমএল-এন এর প্রধানের পদে অযোগ্য ঘোষণা করে। এর ফলে আগামী মার্চ মাসে অনুষ্ঠেয় সিনেট নির্বাচনে দলীয় টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষমতাও আর তার থাকে না। অনেক সময় বলা হয় যে, বিচারকদের কথা বলা উচিত নয়। শুধুমাত্র আদালতের পক্ষে তাদের প্রদত্ত রায়েরই কথা বলা উচিত। কিন্তু পাকিস্তানের সিনিয়র বিচারকরা শুধু বিচার কাজই করতে চান না। তারা যে বিচার কাজ করছেন তা দেখাতে চান ও শোনাতে চান। শরীফের বিরুদ্ধে একটি দুর্নীতি মামলায়, যেটি ‘পানামাগেট’ হিসেবে বহুল পরিচিত একটি কেলেঙ্কারির অংশ, সেখানে নিজের পর্যবেক্ষণ দিতে গিয়ে বিচারপতি আসিফ সাইদ খান খোসা ‘গডফাদার’ উপন্যাসটিতে মারিও পুজোর দেয়া বালজাকের একটি উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছেন। উদ্ধৃতিটা হচ্ছে, ‘প্রতিটি বড় ধরনের ঐশ্বর্যের পিছনে একটা অপরাধ আছে।’ মাফিয়া উপন্যাসের এপিগ্রাফকে দারুণ মুগ্ধ করার মতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান মামলাটিকে ঘিরেও একই ধারণা আবর্তিত। অন্যান্য বিচারকও নিজেদের কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে এত ভালবাসেন যে, তারা উর্ধতন আদালতগুলোকে ‘টকশো’র মতো করে চালান। সুপ্রীম কোর্টের এজেন্ডা মনে হয় টেলিভিশনে যা পরিবেশিত হয় উত্তরোত্তরভাবে সেগুলোর দ্বারা নির্ধারিত হচ্ছে। বড় ধরনের সংবাদ কাহিনীগুলো আদালতকে সুয়োমোটো বা নিজ কর্তৃত্ববলে মামলা করতে প্রণোদিত করেছে। এরপর মামলার যে শুনানি হয় সেটাও আবার সংবাদ মাধ্যমে পরিবেশিত হয়, যেখানে বিচারকদের শিরোনাম হওয়ার উপযোগী মন্তব্য ও রূঢ় কৌতুক থাকে। গত বছর তাদের একজন এ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেছিলেন যে, সরকার ‘সিসিলিয়ান মাফিয়া’র মতো। নিসার সম্প্রতি এক শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় শুনানিতে উপস্থিত হওয়ার জন্য ডজনখানেক বিশিষ্ট সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানান। তিনি তাদেরকে পরামর্শও দিতে বলেছিলেন : ‘টিভির যে সংবাদ পাঠক সন্দেহভাজন ধর্ষককে যৌন নিপীড়নকারী পর্ণোগ্রাফি চক্রের অন্তর্গত বলে অভিযোগ করেছিলেন, তার ব্যাপারে কি করা যায়?’ ধর্ষিত ও নিহত শিশুটির বাবা কাঁদতে শুরু করে দিলে প্রধান বিচারপতি তাকে তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বর দিয়ে বলেন যে, সাহায্যের প্রয়োজন হলে তিনি তাকে যে কোন সময় কল দিতে পারেন। কিন্তু বিচারকরা যারা ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করে, এদেশের জন্য তারা বিপজ্জনক। পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর কোন জেনারেল যখন ক্ষমতা দখল করেন, তখন তাঁর প্রথম কাজ হলো বিচারপতিদের নতুন করে তাদের পদের জন্য শপথ নিতে বলা। সাধারণত তারা সেভাবেই শপথবদ্ধ হন। তারপর তারা একনায়কের ক্ষমতা দখলের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। আইনের কিতাবগুলোতে তাঁরা এই ক্ষমতা দখলের ব্যাখ্যা খুঁজে না পেলে সেই ব্যাখ্যা নিজেরাই আবিষ্কার করেন। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে প্রথম মার্শাল ল’ জারির যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য সুপ্রীমকোর্ট বিখ্যাত ‘ডকট্রিন অব নেসিসিটি’ বা ‘প্রযোজনীয়তা তত্ত্ব’ সৃষ্টি করেছিল। এর যুক্তিটা মূলত ছিল এই : ‘জেনারেলের কমান্ডে সেনাবাহিনী আছে। কাজেই আমাদের অর্থাৎ, বিচারপতিদের কাছ থেকে আপনারা কি আশা করতে পারেন?’ পাকিস্তানের বিচার বিভাগ অন্যভাবেও সামরিক একনায়কদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছেন। এই বিচার বিভাগ একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে সন্দেহজনক অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল (১৯৭৯ সালে জুললিকার আলী ভুট্টোকে) এবং আরেক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আততায়ীর হাতে নিহত হবার পর এই বিভাগের যে ভূমিকা পালন করার কথা, তা করতে ব্যর্থ হয় (বেনজীর ভুট্টো, যিনি ২০০৭ সালে নিহত হয়েছিলেন)। বিচারক ও জেনারেলদের মধ্যে কখনও সখনও সংঘাত বাঁধে। তবে তা দেশবাসীর জন্য ভাল কোন ফল বয়ে আনে না। ২০০৭ সালে জেনারেল পারভেজ মোশারফ একদল সিনিয়র বিচারপতিকে বরখাস্ত করে তাদের গৃহবন্দী করেন। তিনি চেয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচাপতি ইফতেখার মোহম্মদ চৌধুরী পদত্যাগ করুন। নিসারের মতো ইফতেখারও পাকিস্তানকে ঠিকঠাক করতে চেয়েছিলেন। দেশ কিভাবে চালাতে হয় রাজনীতিক ও আমলাদের বলে দেয়ার একটা প্রবণতা তাঁর মধ্যে কাজ করত। তাকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা তিনি প্রতিহত করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে পদচ্যুত করা হয়েছিল। তখন আইনজীবীরা সমবেতভাবে তাকে সমর্থন জানান এবং তাদের আন্দোলন মোশারফের শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক ভিত্তিক বিরোধিতার রূপ ধারণ করে। এই বিরোধী আন্দোলনের মুখে জেনারেল মোশারফ শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। ইফতেখার চৌধুরী প্রধান বিচারপতি হিসেবে পুনর্বহাল হন। কিন্তু দায়িত্ব নতুন করে গ্রহণ করার পর তাঁর অন্যতম প্রথম কাজ কি ছিল? তিনি একটি প্যানেল গঠন করেন, যা তার নিজের ছেলেকে ব্যাপক দুর্নীতির একটি মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়। একই সময় এমন সব ইস্যু আছে যেখানে সুপ্রীমকোর্ট কখনই হাত দেবে না। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আন্তঃসার্ভিস গোয়েন্দা পরিদফতরের (আইএসআই) বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে লাখ লাখ ডলার দিয়ে ১৯৯০ সালের নির্বাচনে কারচুপি করেছিল। এ সংক্রান্ত একটি মামলা বহু বছর ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এমন শত শত মামলা আছে যেখানে অভিযোগ আছে যে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অপহরণ করে নির্যাতন করেছে, সেসব অভিযোগ বিচারপতিরা কখনই শোনেন না। মোশারফ প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে আনীত বেশ কিছু মামলায় আদালতকে দিয়ে তাঁকে জামিন দেয়াতে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করেছিল। সংবিধান বাতিলের জন্য অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও মোশারফকে স্বচ্ছন্দে প্রবাসে বসবাসের সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং তাকে তার নিজের দলকে নেতৃত্ব প্রদানে কখনই বাধা দেয়া হয়নি যেটা শরীফের ক্ষেত্রে করা হয়েছে। অবাক হবার কিছু নেই যে, পিএমএস-এনএর নেতা হিসেবে তাঁর নাম খারিজ করতে সুপ্রীমকোর্ট সম্প্রতি যে রায় দিয়েছে, তাতে শরীফ বিদ্রƒপ সহকারে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ফলে বিচারপতিরা তাঁর কাছ থেকে তার নিজের নামটিও ‘কেড়ে’ নেয়ার যুক্তি খুঁজে বের করতে আইন ঘেঁটে দেখার জন্য তাড়িত হচ্ছেন। শরীফ বলেন, সুপ্রীমকোর্টের সমস্ত রায় নওয়াজ শরীফের সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে যুক্তি আছে। নিসার বিচারপতিদের কাছ থেকে প্যাশন অর্থাৎ মন প্রাণ ঢেলে, আবেগ ঢেলে কাজ চান। কিন্তু প্যাশন জিনিসটাই হলো পক্ষপাতিত্বমূলক। পাকিস্তানের বিচারপতিরা যদি নিজেদের কাজকে পেশা হিসেবে গণ্য করার ভূমিকায় ফিরে যান এবং ‘গডফাদার’ থেকে উদ্ধৃতি দেয়ার পরিবর্তে আইনের বই থেকে উদ্ধৃতি দেন তাহলে আমাদের সবার জন্যই ভাল হবে। [লেখক ‘এ কেস অব এক্সপ্লোডিং ম্যাঙ্গোস’; এবং ‘আওয়ার লেডি অব এলিস ভাট্টি‘ উপন্যাসের রচয়িতা এবং ‘ভুট্টো‘ অপেরার লিব্রেটিস্ট] সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
×