ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টা- শাবি ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ বিক্ষোভ

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৫ মার্চ ২০১৮

জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টা- শাবি ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ বিক্ষোভ

সালাম মশরুর/হোসেইন ইমরান ॥ বিভিন্ন সময়ে হুমকির মধ্যে থাকা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের নিরাপত্তার জন্য সর্বক্ষণিক পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করে সরকার। আর এই পর্যায়েই তাকে হত্যার উদ্দেশেই হামলা চালায় জঙ্গী যুবক। এই যুবক শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়। মাস্টার প্ল্যানের মাধ্যমে জাফর ইকবালকে টার্গেট করেই হামলাকারী যুবক এখানে অবস্থান নেয়। জাফর ইকবালের ওপর হামলার এই ঘটনায় শুধু শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ই উত্তাল নয়, বিক্ষোভ প্রতিবাদ, মানববন্ধন চলছে সিলেট নগরীতে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জাফর ইকবালকে হত্যার উদ্দেশে হামলার কথা স্বীকার করেছে হামলাকারী যুবক। জঙ্গীমদদপুষ্ট হামলাকারী এই যুবকের শেকড় রয়েছে গভীরে, জিজ্ঞাসাবাদে তা বেরিয়ে আসবে। ‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই হামলা করেছি’- র‌্যাবের কাছে এমনটি বলেছে হামলাকারী ফয়জুর রহমান। শনিবার রাতে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংকালে র‌্যাব-৯ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ বলেন, আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। জিজ্ঞাসাবাদে সে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে। সে বলেছে, ‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই তাকে মেরেছি’। উত্তাল শাবি ক্যাম্পাস ॥ জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী, ‘শিক্ষক সমিতি’, ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’, ‘শাখা ছাত্রলীগ’, ‘শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট’, ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের সন্তান’ প্রভৃতি সংগঠন আলাদাভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করেছে। রবিবার সকাল সাড়ে নয়টায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেছেন বিভিন্ন বিভাগের প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী। মানববন্ধন শেষে দশটা থেকেই হাজার হাজার শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে ক্যাম্পাসে নামে বিক্ষোভ মিছিল। শিক্ষার্থীরা এসব কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের প্রিয় শিক্ষকের ওপর বর্বর হামলার প্রতিবাদে।‘স্যারের ওপর হামলা কেন প্রশাসন জবাব চাই’, ‘সাস্টিয়ান সাস্টিয়ান এক হও এক হও’, ‘আমার ক্যাম্পাসে হামলা কেন প্রশাসন জবাব চাই’ প্রভৃতি স্লোগান নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। বিক্ষোভ মিছেলে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থী খালেদ সাইফুল্লাহ ইলিয়াস বলেন, স্যারের ওপর যে হামলা হয়েছে তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। আমরা এর এর তীব্র নিন্দা জানাই। শীঘ্রই হামলাকারীর মূল হোতাদের বের করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। রবিবার দুপুর বারোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ভবনের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে শিক্ষক সমিতি। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাসসহ বিভিন্ন বিভাগের দুইশতাধিক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। মানববন্ধন শেষে সমাবেশে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহীর উদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন সভাপতি হাসানুজ্জামান শ্যামল। হাসানুজ্জামান শ্যামল বলেন, জাফর ইকবালের ওপর যে হামলা হয়েছে তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। আমার মনে হচ্ছে এই হামলা পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। এ ধরনের হামলা মুক্তচিন্তা চর্চা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত করবে বলে আমার বিশ্বাস। আমরা এ ঘটনার মূল হোতাদের বের করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। দুপুর একটায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৬টি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠেনের নেতা-কর্মীরা কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক মেহেদী কবীর বলেন, ক্যাম্পাসে সীমানা প্রাচীর নেই। তাই বরাবরই ক্যাম্পাসে বিভিন্ন অঘটন ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় জাফর স্যারের ওপর হামলা হলো। সীমানা প্রাচীর এখন সময়ের দাবি। ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ও শাখা ছাত্রলীগও। রবিবার বিকেলে ক্যাম্পাসে মানববন্ধনের আয়োজন করে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইমরান খান বলেন, আমরা হামলাকারীদের ফাঁসি চাই। স্যারকে হত্যার উদ্দেশেই সে হামলা করেছিল। তাই তার উপযুক্ত শাস্তি হচ্ছে ফাঁসি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দিনব্যাপী অন্যান্য কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে, সন্ধ্যায় মৌন মিছিল এবং দিনব্যাপী গণস্বাক্ষর কর্মসূচী। রিফাত হাসান নামের এক শিক্ষর্থী বলেন, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা জোরদারের করতে বহিরাগতদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করার দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি ক্যাম্পাসের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করারও দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া আজ সোমবার সকাল এগারোটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত শিক্ষক সমিতি কর্মবিরতি পালন করবে বলে জানান সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহীর উদ্দিন আহমেদ। মোবাইল ফোনে ব্যস্ত ছিল পুুলিশ ॥ শনিবার শাবির মুক্তমঞ্চে ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ফেস্টিভ্যালের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার সময়ও তার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন ৩ পুলিশ সদস্য। তবে এ সময় উপস্থিত থাকা তিন পুলিশ সদস্যের মধ্যে দুজনই তাদের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় হামলাকারী যুবক ফয়জুরকে। এরপর অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় কর্তব্যরত পুলিশের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন তুলেছেন সেখানে উপস্থিত থাকা সকল ছাত্র-শিক্ষক। নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নওশাদ সজীব জানান, জাফর ইকবাল স্যারের পাশে পুলিশ অবস্থান করতে দেখা গেলেও পুলিশ কোন তৎপর ভূমিকা পালন করেনি। শাবি ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত একটি রোবটিক্স প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে শাবিতে গেলে এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হন তিনি। তবে ছাত্র-শিক্ষকের এ দাবি অস্বীকার করে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব বলেন, হয়তো অনুষ্ঠানের বিরতির কোন এক সময় এ হামলার ঘটনাটি ঘটেছে। তদন্ত করে পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার কোন প্রমাণ মিলে তাহলে আমরা পদক্ষেপ নেব। জাফর ইকবালের ওপর হামলার নিন্দা সিলেটের বিভিন্ন মহলের ॥ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদে সিলেটে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। রবিবার ওসমানী স্মৃতি পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বেলা ২টায় সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে শহর প্রদক্ষিণ করে চৌহাট্টা পয়েন্টে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওসমানী স্মৃতি পরিষদের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহমুদুর রহমান লায়েকের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভার সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস। এতে বক্তব্য রাখেন- সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ফরহাদ আহমদ রিপন, দফতর সম্পাদক কিরণ দেবনাথ। বক্তারা ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষক, লেখক, সাহিত্যক, বুদ্ধিজীবীদের ওপর হামলা আজ নতুন নয়। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাকে মেধাশূন্য করার যে পাঁয়তারা শুরু হয়েছিল তা আজও বিদ্যমান। এরই ধারাবাহিকতায় আজ জাফর ইকবালের ওপর হামলা হয়েছে। এখনই ষড়যন্ত্রকারীদের টুঁটি চেপে ধরতে না পারলে তারা তাদের নৃশংস কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাবে। বক্তারা আরো বলেন, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলা মানে গোটা জাতির ওপর হামলা। দেশের সমস্ত অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানমনস্ক লোকদের ওপর হামলা করা। তারা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। একইসঙ্গে দোষীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। প্রতিবাদে বিশাল মানববন্ধন করেছে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি পরিবার। মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির সিন্ডিকেট এবং একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য হচ্ছেন জাফর ইকবাল। রবিবার দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটি ক্যাম্পাসের নিচ থেকে চৌহাট্টার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত এ মানববন্ধনে কয়েকশ’ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী অংশগ্রহণ করেন। মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ড. তৌফিক রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক শিব প্রসাদ সেন, রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ ফজলুর রব তানভীরসহ বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভাগীয় প্রধানসহ অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। মানববন্ধনে ড. তৌফিক রহমান চৌধুরী বলেন, ‘দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি পরিবারের সদস্য অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ওপর যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা ন্যক্কারজনক ও বর্বরোচিত। আমরা এই হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একইসঙ্গে যে বা যারা এই হামলার সঙ্গে জড়িত, আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটিও জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে। ঘটনার প্রতিবাদে রবিবার নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারী সমন্বয়ে এক ক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে প্রতিবাদ মিছিলটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে তেলিহাওড়ের ক্যাম্পাসে এসে শেষ হয়।
×