ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

ভাষা দিবসের নাটক নিখোঁজ সংবাদের মঞ্চায়ন

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 ভাষা দিবসের নাটক নিখোঁজ সংবাদের মঞ্চায়ন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া আধুনিকতার ছোঁয়ার সঙ্গে অত্যাধুনিক শিক্ষার চাপে বিপদগ্রস্ত এক কিশোর রাজর্ষি। এ যেন আধুনিকতার মোড়কে জোরপূর্বক খাঁচায় বন্দী করার পাঁয়তারা। যদিও ছেলেবেলায় দাদা-দাদির কাছ থেকে পেয়েছে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তাকে ভালবাসার দীক্ষা। তবে সেই শিক্ষা যেন ম্লান হতে বসেছে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার গ্যাঁড়াকলে। বাংলার সঙ্গে ইংরেজীর দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপটে নিজেকে সে হারিয়ে ফেলে। কোন্ পথে যাবে সে? তার বই থেকে মুছে গেছে সব বাংলা শব্দ। কোথায় গেল ওরা? ওরা কি নিখোঁজ, নাকি এ ওদের অভিমান? রাজর্ষি কি পারবে অভিমান ভাঙিয়ে হারিয়ে যাওয়া শব্দগুলো ফিরিয়ে আনতে? বাংলা ভাষার অনাদর-অবহেলার এমন কাহিনীকে উপজীব্য করেই নির্মিত নাটক ‘নিখোঁজ সংবাদ’। ভাষার মর্যাদাহীনতার বিরুদ্ধে যেন প্রতিবাদী প্রকাশ ঘটেছে নাটকে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনের অংশ হিসেবে শুক্রবার বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে প্রযোজনাটির প্রথম মঞ্চায়ন হয়। নিখোঁজ সংবাদ নাটকটি রচনা করেছেন গাউসুল আলম শাওন ও আদনান আদিব খান। তারিক আনাম খানের সমন্বয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন রেজা আরিফ। বাংলা শব্দ পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াসে বিভিন্ন নাট্যদলের শিল্পীদের অংশগ্রহণে মঞ্চে এসেছে কোকা-কোলা নিবেদিত প্রযোজনাটি। বিশ্বায়নকে আঁকড়ে ধরতে চাওয়া সমাজে এক কিশোরের ভাষা নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গড়িয়েছে নাটকের গল্প। রাজর্ষি তার বাবাকে জানায়, সে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটকের অমল চরিত্রে অভিনয় করতে চায়। ক্ষুব্ধ হয়ে বাবা বলে ওঠেন ‘বেঙ্গলি ড্রামা মূল্যহীন। রাজর্ষি বুঝতে পারে তার কাছ থেকে নদী-জল-হাওয়া আর অসীম আকাশকে চুরি করে বন্দী করা হয়েছে বিদেশী খাঁচায়। সেই খাঁচার গালভরা নামটি হচ্ছে গ্লোবালাইজেশন। এক সময় নাটকের চরিত্রগুলো অনুধাবন করতে পারে, বিদেশী ভাষার আগ্রাসনে বাংলা ভাষার অর্থবহ ও শ্রুতিমধুর কিছু শব্দ তারা ভুলে যেতে বসেছে। যে শ্রুতিমধুর ও অর্থপূর্ণ বাংলা শব্দগুলো বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করেছিল এবং সময়ের সঙ্গে বিলুপ্তপ্রায় সেই শব্দগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বানই এই নাটকের উদ্দেশ্য। রাজধানীর বিভিন্ন নাট্যদলের সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের একঝাঁক অভিনয়শিল্পী করেছেন এ নাটকে। প্রযোজনাটির বিভিন্ন চরিত্রে রূপ দিয়েছেন এশা ইউসুফ, ফাহিম মালেক ইভান, মনোজ কুমার প্রামাণিক, রোশেন শরিশ, জিনাত জাহান নিশা প্রমুখ। ভুলে যাওয়া বাংলা শব্দ পুনরুজ্জীবিত করতে কোকা-কোলা বাংলাদেশে মাসব্যাপী প্রচারের অংশ হিসেবে নাটকটি দেশের ২০টি সরকারী ও বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয়ে মঞ্চস্থ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নাটকটি মঞ্চস্থ করবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীবৃন্দ। এছাড়া আগামী ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে নাটকটির চারটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফের জন্মশতবর্ষের আয়োজন ॥ বহমুখী প্রতিভায় উজ্জ্বল এক কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ। কবিতার সমান্তরালে লিখেছেন উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ও কিশোর সাহিত্য। তার মননের আশ্রয়েই প্রথম বাংলায় অনূদিত হয় পারস্যের মহাকবি ফেরদৌসীর বিশ্বখ্যাত মহাকাব্য ‘শাহনামা’। ১৩ ফেব্রুয়ারি ছিল একুশে পদকজয়ী প্রয়াত এই কবির শততম জন্মদিন। এ উপলক্ষে বছরব্যাপী কবির জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে মনিরউদ্দীন ইউসুফ জন্মশতবর্ষ জাতীয় উদ্্যাপন পরিষদ। সে আয়োজনের সূচনা হলো শুক্রবার। এদিন বিকেলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চলচ্চিত্র মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো আলোচনাসভা। সেই সঙ্গে আয়োজনে পঠিত হয় মনিরউদ্দীন ইউসুফের রচিত কবিতা। লেখকের ‘নবমূল্যায়নে রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থদ্বয়ের ওপর অনুষ্ঠিত আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মুফতি রাশিদ আহমদ, বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক ফজলে রাব্বি ও অধ্যাপক সেলু বাসিত। স্বাগত বক্তব্য রাখেন লেখকের মেয়ে ফাতেমা জেবুন্নেসা গীতি। মনিরউদ্দীন ইউসুফের কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন ফারহানা মিষ্টি, জাহানারা বেগম রেখা ও শামীমা চৌধুরী। স্মৃতিচারণ করে অধাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বয়সে ছোট হয়েও মনিরউদ্দীন ইউসুফের কাছ থেকে বন্ধুর মতো ব্যবহার পেয়েছি। লেখকের মূল্যায়ান করে আনিসুজ্জামান বলেন, তিনি ছিলেন অনন্য কীর্তিমান এক মানুষ। একসঙ্গে চারটি ভাষায় ছিল তার অনায়াস বিচরণ। বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজী, আরবী ও ফার্সিতে দারুণ দখল ছিল তার। সে কারণেই শাহনামা অনুবাদের মতো শ্রমসাধ্য কাজটি তিনি করতে পেরেছিলেন। এটি তার জীবনের অন্যতম কীর্তি। তার আরেকটি মৌলিক কাজ হচ্ছে ‘উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থ রচনা। বাংলা ভাষায় উর্দু সাহিত্য নিয়ে এমন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ আমরা আর পাইনি। এই বইয়ের মাধ্যমে তিনি উর্দু সাহিত্যের সকল শাখার পরিচয়কে তুলে ধরেছেন। আজীবন সাহিত্য সাধনায় নিমগ্ন এই মানুষটি আজ বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছেন। সেই প্রেক্ষাপটে জন্মশতবর্ষের এ আয়োজনটি তাকে নতুন প্রজন্মের কাছে নতুনভাবে তুলে ধরতে সাহায্য করবে। মুফতি রশীদ আহমদ বলেন, মানবকল্যাণের ভাবনা থেকেই মনিরউদ্দীন ইউসুফ উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থটি রচনা করেছেন। কারণ, সেই সময়ের উর্দু সাহিত্যে মানবতার কথা অনেক বেশি উচ্চারিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন আল্লামা ইকবালের মতো মানবতাবাদী কবির কবিতা। ফজলে রাব্বি বলেন, শাহনামা অনুবাদের যে কাজটি মনিরউদ্দীন ইউসুফ করেছেন, তা অন্য কেউ পারেননি। এছাড়া মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন ভীষণ বিনয়ী। একাত্তরের স্মৃতিবহ চলমান জাদুঘরের উদ্বোধন ॥ একাত্তরের স্মৃতিকে ধারণ করে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা, মধুর ক্যান্টিন, জগন্নাথ মাঠের গণকবর, কাঁটাবন, নীলক্ষেত প্রভৃতি এলাকা বহন করছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন। এসব স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের তাগিদে চালু হলো ওয়াকিং মিউজিয়াম বা চলমান জাদঘুর। শুক্রবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ আয়োজিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্বোধন হয় ‘চলমান জাদুঘর : ’৭১-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জেনোসাইড’। অনুষ্ঠান প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। প্রধান অতিথির বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আমাদের ইতিহাসকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে হবে। নতুনভাবে আবিষ্কার করতে হবে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের অবদান। হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস পুনরুদ্ধার ও আবিষ্কার করতে হবে। ইতিহাসের বাস্তবতায় এটি একটি অত্যন্ত জরুরী কাজ। এ কাজে সচেতন নাগরিক ও ইতিহাসবিদের ভূমিকা থাকা দরকার। মন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বাঙালী জাতির আত্মত্যাগের ইতিহাস কেবল একটি ফ্রেম বা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা ও স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সারাদেশে । মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মচারীর আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে মন্ত্রী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের গর্ব করার মতো আলোকোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে সর্বপর্যায়ের ছাত্রছাত্রীর অংশগ্রহণ ও আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়।
×