ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

২ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ বাড়িয়েছে অধিকাংশ ব্যাংক ;###;আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আকর্ষণীয় সুদের সঙ্গে বিশেষ অফার!

আমানতকারীদের সুদিন ফিরছে

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আমানতকারীদের সুদিন ফিরছে

রহিম শেখ ॥ আমানতকারীদের সুদিন ফিরছে। রীতিমতো ফোন দিয়ে টাকা রাখতে বলছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। বলছেন, ব্যাংকে আমানত রাখলেই সবচেয়ে আকর্ষণীয় মুনাফা দেয়া হবে। সঙ্গে বিশেষ কোন অফার তো থাকছেই। মূলত ঋণের চাহিদা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকগুলোর কাছে আমানতের প্রয়োজনও বেড়েছে। প্রয়োজন মেটাতে চলতি মাস থেকে আমানতের সুদহার বাড়াতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। কোন কোন ব্যাংক জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে বাড়িয়েছে আমানতের সুদহার। কোন কোন ব্যাংক আমানতের সুদহার ২ থেকে ৪ শতাংশ বাড়িয়েছে। ব্যাংকের পাশাপাশি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও আমানতের সুদের হার বাড়িয়েছে ২ থেকে ৫ শতাংশ। সঙ্গে দেয়া হচ্ছে বিশেষ অফার। এদিকে বর্তমানে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে প্রকল্পসহ বিভিন্ন নামে ঋণ নিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ও জমি কেনার ঘটনায় ২০০৯-১০ অর্থবছর হঠাৎ করে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়ে ২৪ দশমিক ২৪ শতাংশে ওঠে। তার আগের অর্থবছর ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। বাড়তি চাহিদার কারণে ওই সময় ঋণ ও আমানতের সুদহার বাড়তে থাকে। এরপরও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তেমন কোন পদক্ষেপ না থাকায় পরের অর্থবছর ২০১০-১১-এ ঋণ প্রবৃদ্ধি আরও বেড়ে ২৫ দশমিক ৮৪ শতাংশে ঠেকেছিল। ঋণ ও আমানতের সুদহার ব্যাপক হারে বাড়তে থাকায় ২০১২ সালে সব ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদহারের একটা সীমা নির্ধারণ করলেও কাজ হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ে ঋণ বিতরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ির পর ঋণ ও আমানতে সুদহার কমতে শুরু করে। গত কয়েক বছরে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ প্রবাহ কম থাকায় ব্যাংকগুলোয় ঋণের চাহিদা কমে যায়। এ কারণে ব্যাংকে মাত্রাতিরিক্ত অলস অর্থের বিনিয়োগ বাড়াতে এবং আমানতের চাপ কমাতে ব্যাংকগুলো আমানত ও ঋণের সুদের হার কমাতে থাকে। গত দুই বছরে ব্যাংকগুলো ব্যাপক হারে আমানতের সুদের হার কমিয়েছে। ঋণের সুদের হার সামান্য কমলেও ব্যাংকিং খাতে ঋণের চাহিদা বাড়েনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হঠাৎ বেড়েছে। ভোক্তা ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে সার্বিকভাবে বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যাংকাররা জানান, ঋণের চাহিদা না থাকায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকগুলোর লাখো কোটি টাকারও বেশি অতিরিক্ত তারল্য ছিল; কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ঋণপ্রবাহ অনেক বেড়েছে। প্রতিমাসে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ বাড়ছে; কিন্তু আমানত বাড়ছে মাত্র ১০ থেকে ১১ শতাংশ। ফলে অতিরিক্ত তারল্য ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য একেবারেই কমে গেছে, যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেসব ব্যাংককে জরিমানাও করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য কমে ৯২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকায় নেমেছে। আগের বছরের একই সময়ে যা এক লাখ ২৫ হাজার ৩১১ কোটি টাকা ছিল। গত কয়েক বছরের পরিস্থিতি পর্যালোচনায় উদ্বৃত্ত তারল্য কখনও এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার নিচে আসতে দেখা যায়নি। চলতি বছরের শেষের দিকে নির্বাচন হতে পারে। নির্বাচনী বছরে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম রাখার পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক; কিন্তু ব্যাংকগুলো ব্যাপকহারে ঋণ বিতরণের সুযোগ চেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করলেও ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ বাড়িয়ে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন পড়বে। অর্থ সংগ্রহের জন্য আমানতের সুদহার বাড়িয়ে আমানতকারীদের আকৃষ্ট করা হতে পারে। ইতোমধ্যে সরকারী ব্যাংকগুলোসহ অনেক বেসরকারী ব্যাংক আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে। আমানতের সুদহার অনেক কম থাকায় গ্রাহক ব্যাংকে টাকা জমাতে আগ্রহী হচ্ছেন। এদিকে ঋণগ্রহীতাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ বিতরণ করছে ব্যাংকগুলো। এতে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) আইনী সীমা অতিক্রম করেছে। এডিআর সীমা কমানো হয়েছে। সীমার মধ্যে থাকার জন্য আমানত বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। তাই কয়েক বছর পর আবার কর্মকর্তাদের আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংক। প্রাইম ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের মেয়াদি আমানতের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। বড় অঙ্কের আমানত পেলে তাদের ক্ষেত্রে আরও বিবেচনার সুযোগ রাখা হয়েছে। কর্মকর্তাদের আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছে। সরকার মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংক তাদের মেয়াদি আমানত প্রকল্পগুলোর সুদহার দশমিক ৫০ থেকে ১ শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়েছে। তিন মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার সাড়ে ৪ থেকে বাড়িয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ, ছয় মাস মেয়াদি আমানতে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ, এক বছর মেয়াদি আমানতে ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ শতাংশ, স্বল্পমেয়াদি আমানতে ৩ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ এবং সঞ্চয়ী আমানতের সুদহার সাড়ে ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ নির্ধারণ করেছে রূপালী ব্যাংক। অগ্রণী ব্যাংক দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ বাড়িয়ে ৩ মাস মেয়াদি আমানতে ৫ শতাংশ, ৬ মাস মেয়াদি ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং এক বছর বা এর বেশি মেয়াদি আমানতে সাড়ে ৫ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করেছে। বেসরকারী খাতের ঢাকা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, এবি ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছে। তবে কোন কোন ব্যাংক এর চেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে। প্রিমিয়ার ব্যাংক সুদ বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। মেঘনা ব্যাংক সর্বোচ্চ সুদ দিচ্ছে সাড়ে ৯ শতাংশ। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আমানতের বিপরীতে সুদহার দেড় থেকে ২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ৩ ও ৬ মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৯ শতাংশ নির্ধারণ করেছে ব্যাংকটি। এর বাইরে সব ব্যাংক গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে দর কষাকষির মাধ্যমে সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। ঘোষিত রেটের চেয়ে বেশি হারে সুদ পাচ্ছেন গ্রাহকরা। কোন কোন ব্যাংক গত মাসে ও চলতি ফেব্রুয়ারিতে সুদহার বাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে কর্মকর্তাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমানত সংগ্রহ মাস, সপ্তাহ বা পাক্ষিক পালন করছে কোন কোন ব্যাংক। পূবালী ব্যাংক জোরেশোরে আমানত সংগ্রহ মাস পালন করছে। এছাড়া নন-ব্যাংকিং কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতের সুদের হার বাড়িয়েছে ২ থেকে ৫ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের এমডি এ্যান্ড সিইও আতাউর রহমান প্রধান বলেন, এখনও দেশের অনেক আমানতকারী রয়েছেন, যারা সরকারী ব্যাংকে অর্থ রাখা নিরাপদ মনে করেন। এ রকম সময়ে আমানতকারীরা যেন না ঠকেন, সেজন্য সুদহার কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে আমানতের একটু চাহিদা বেড়েছে ফলে সুদের হারও বাড়িয়েছি আমরা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, গত বছরে ঋণ অনেক বেড়েছে, সেই তুলনায় আমানত বাড়েনি। ফলে অলস তারল্যের ওপর চাপ পড়েছে। এছাড়া এডিআর কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইনি সীমা পরিপালনে আমানত বাড়ানো একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে। তাই চাহিদা অনুসারে ঋণ বিতরণ করতে হলে আমানত বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এজন্য সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। প্রয়োজনে আমানতের সুদহার আরও বাড়তে পারে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি লাখ টাকার আমানত রাখলে আকর্ষণীয় সুদের পাশাপাশি দিচ্ছে পাঁচ তারকা হোটেলে ডিনার করার অফার। সঙ্গে আছে আড়ংয়ের গিফট ভাউচার।
×