ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘না-ফেরার দেশে হকির কিংবদন্তি সবার প্রিয় সোনা ভাই’

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 ‘না-ফেরার দেশে হকির কিংবদন্তি সবার প্রিয় সোনা ভাই’

জাহিদুল আলম জয় ॥ বহু গুণের সমাহার তার মধ্যে। দীর্ঘদিন খেলেছেন বাংলাদেশ জাতীয় হকি দলে। খেলোয়াড় হিসেবেই তিনি কিংবদন্তি। পাশাপাশি কোচ, আম্পায়ার, সংগঠক হিসেবেও আলো ছড়িয়েছেন। তার ছেলে বাংলাদেশ জাতীয় হকি দলের বর্তমান অধিনায়ক রাসেল মাহমুদ জিমি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন নিপাট একজন ভদ্রলোক, সাদা মনের ভাল মানুষ। এই পরিচয় দিতেই ভালবাসতেন তিনি। বহু গুণের সমাহারে সমৃদ্ধ এই মানুষটির নাম আবদুর রাজ্জাক (সোনা মিয়া)। দেশের হকির কিংবদন্তি। বাংলাদেশ হকির ‘টাইগার খ্যাত’ এই কিংবদন্তি মানুষটি দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগে অসুস্থ থাকার পর রবিবার সকালে হাসপাতালে নেয়ার পথে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। মৃত্যুকালে তিনি ২ ছেলে, ৩ মেয়েসহ বহু আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব রেখে গেছেন । সোনা মিয়ার বড় ছেলে রাসেল মাহমুদ জিমি বাংলাদেশ জাতীয় হকি দলের অধিনায়ক এবং ছোট ছেলে রাকিন জাতীয় অনুর্ধ-২১ হকি দলের খেলোয়াড়। গতকাল দুপুরে মওলানা ভাসানী জাতীয় হকি স্টেডিয়ামে সোনা মিয়ার প্রথম জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মরহুমকে নিয়ে যাওয়া হয় পুরনো ঢাকার বেগমগঞ্জে। সেখানে বাদ আছর চকবাজার শাহী মসজিদে দ্বিতীয় জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয় গুণী এই মানুষকে। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। খেলাপাগল এ মানুষের মৃত্যুতে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের পক্ষ হতে গভীর শোক ও শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদানা জানানো হয়েছে। আরও শোক জানিয়েছে ঢাকা আবাহনী, ঢাকা মোহামেডান, বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতিসহ আরও অনেকে। সোনা মিয়া ১৯৪৯ সালের ২ নবেম্বর ঢাকার আরমানিটোলায় জন্মগ্রহণ করেন। খেলোয়াড়ী জীবনে খেলেছেন আজাদ স্পোর্টিং, কম্বাইন্ড, ভিক্টোরিয়া, পিডব্লিউডি ও আবাহনীতে। পাকিস্তান জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলেন। খেলেছেন জুনিয়র দলে। করাচীতে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে খেলেছেন বেশ কয়েকটি ম্যাচ। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে ইউরোপ সফরের সুযোগ পেলেও চোটের দুর্ভাগ্যে যেতে পারেননি। তিনি আরমানিটোলা স্কুলে ছাত্রাবস্থায় ১৯৬২ সালে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের পক্ষে হকি লীগে অংশগ্রহণ করে খেলোয়াড় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পরবর্তীতে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। জগন্নাথ কলেজে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ২০০, ৪০০, ৮০০, ১৫০০ মিটার স্প্রিন্টে ও ৪ঢ১০০ মিটার রিলেতে প্রথম হয়ে দুই বছর কলেজ চ্যাম্পিয়ন হন। এছাড়া কম্বাইন্ড, ভিক্টোরিয়া, পিডব্লিউডি ক্লাবের পক্ষে লীগে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তন দলের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে ১৯৭২, ১৯৭৮ পর্যন্ত আবাহনীর পক্ষে খেলেন এবং সর্বশেষ ১৯৮৮ সালে আবাহনী ক্রীড়াচক্রের পক্ষে খেলার মাধ্যমে খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি টানেন। জাতীয় হকি প্রতিযোগিতায় ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে ঢাকা জেলা দলের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৮৮ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত জুনিয়র ওয়ার্ল্ডকাপ কোয়ালিফাইং রাউন্ডে এবং ১৯৮৯ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ৩য় এশিয়া কাপ হকি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দলের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় এশিয়া কাপে আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সদস্য ও হকি আম্পায়ার্স বোর্ডের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান আমলে যে কয়জন বাঙালী হকি খেলোয়াড় দৃষ্টি কেড়েছিলেন, পাকিস্তানীদের সমীহ কেড়েছিলেন, সোনা মিয়া তাদের অন্যতম। স্টিকের ভেল্কি দেখাতেন অহরহ, মাঠে ছিলেন আগ্রাসী এক খেলোয়াড়। পাকিস্তানী হকি খেলোয়াড়রা তাকে ডাকতেন ‘বাঙাল মুলক কা টাইগার’ নামে। ১৯৭০ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে খেলতে যাওয়ার আগে তখনকার দুর্র্ধর্ষ পাকিস্তান জাতীয় হকি দল ঢাকা সফর করেছিল। পূর্ব পাকিস্তান দলের বিপক্ষে খেলেছিল একটি প্রস্তুতি ম্যাচ। ওই ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেছিলেন সোনা মিয়া। বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে যে ম্যাচটি চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। পূর্ব পাকিস্তান দল বিশ্বসেরা পাকিস্তান জাতীয় দলের কাছে হেরেছিল মাত্র এক গোলে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ভারতের দিল্লীতে নেহরু কাপে খেলেছিলেন ‘ঢাকা একাদশে’র হয়ে। স্বাধীন দেশে সেটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় হকি দল। ১৯৭৮ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ দলের জার্সি গায়ে খেলেছেন। বাংলাদেশের হকির সূতিকাগার পুরান ঢাকা থেকেই উঠে এসেছেন আবদুর রাজ্জাক সোনা মিয়া। গোলাম মোস্তফা লেনে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তারপরই আছে তার তিন বোন। শৈশব থেকেই তিনি বেড়ে ওঠেন ক্রীড়াময় পরিবেশে। আকৃষ্ট হন হকি, ফুটবল, ক্রিকেট খেলায়। পিতা-মাতার একমাত্র ছেলে হওয়ায় বন্ধনহীন ছিল তার শৈশব। পারিবারিকভাবে তাকে কোন গঞ্জনা সইতে না হওয়ায় খেলাধুলায় মেতেছেন মনের আনন্দে। আর আরমানিটোলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর খুলে যায় তার স্বপ্নের দুয়ার। সেই কিংবদন্তি মানুষটি অবশেষে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। যেখান থেকে কেউ কখনও ফিরে আসে না।
×