ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিন দিনের কৃষি যন্ত্রপাতি মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী

সাশ্রয়ী দামে ছোট যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের তাগিদ

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সাশ্রয়ী দামে ছোট যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের তাগিদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সাশ্রয়ী দামে কৃষকের ব্যবহার উপযোগী ছোট যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনে প্রযুক্তিবিদদের তাগিদ দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। তিনি বলেছেন, দেশের বেশির ভাগ কৃষকের জমি আকারে ছোট। এসব জমিতে চারা রোপণ, পরিচর্যা ও ফসল মাড়াইয়ে বড় যন্ত্র ব্যবহার সব সময় সাশ্রয়ী হয় না। কৃষিকে লাভজনক করতে প্রান্তিক কৃষকের কথা মাথায় রেখে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে স্লিম, স্মার্ট ও ইফেকটিভ যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করতে হবে। তিনি বলেন, ধানের কিছু জাত আছে, যেগুলো পাকলে নুইয়ে পড়ে। এ ধরনের ধান কাটার কোন যন্ত্র আমাদের নেই। হেলে বা নুইয়ে পড়া ধান কর্তনের যন্ত্রপাতি আমদানি বা উদ্ভাবন করতে হবে। শনিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে প্রথমবারের মতো শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী ‘জাতীয় কৃষি যন্ত্রপাতি মেলা ২০১৮’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে এ মেলার উদ্বোধন করেন। ‘কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে, অর্থ-শ্রম-সময় বাঁচবে’ প্রতিপাদ্যে শুরু হওয়া এই মেলা শেষ হবে আগামী সোমবার। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। মেলায় সরকারী-বেসরকারী ২১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সর্বশেষ প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন দর্শনার্থীদের সামনে তুলে ধরছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় এ মেলা আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী বলেন, দিন দিন আমাদের কৃষিতে কায়িক শ্রম দেয়ার শ্রমিকের অভাব দেখা দিচ্ছে। যার ফলে কৃষিতে উৎপাদন ও সময় বেশি লাগছে। আমরা নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কৃষক আগে অনেকটা বাধ্য হয়ে কৃষিকাজ করত। এখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এজন্য কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। তিনি বলেন, যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কায়িক শ্রম ও খরচ কমছে। সময় বেঁচে যাচ্ছে। কৃষিকে এখন নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্র উদ্ভাবন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার হাওড় ও এক ফসলি এলাকায় শতকরা ৭০ ভাগ ও অন্যান্য এলাকায় শতকরা ৫০ উন্নয়ন সহায়তা দিচ্ছে। এতে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অনেকের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে। প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি শ্রমিকরা দিন দিন অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন। যার ফলে কৃষিকাজে শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কৃষি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে বিজ্ঞানসম্মত ও আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় ও ব্যবহারে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের নিবন্ধিত এক লাখ ৭৫ হাজার সমবায় সমিতিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পিপিসি) মোহাম্মদ নজমুল ইসলামের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের প্রফেসর ড. মোঃ মঞ্জুরুল আলম। প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নেন কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ড. ওয়ায়েস কবীর। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বর্তমানে জমি চাষে শতকরা ৯০ ভাগ, সেচে ৬৩ ভাগ, চারা রোপণে দশমিক ১ ভাগ, সার প্রয়োগে ১ ভাগ ও ফসল মাড়াইয়ে ৭০ ভাগ যন্ত্রের ব্যবহার হয়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বর্তমানে কতগুলো বাধা আছে। এগুলো হলো- কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়া, সহজ শর্তে ঋণের অভাব, দেশীয় ও আমদানি করা যন্ত্রের নিম্নমান, খ- খ- জমির কারণে যন্ত্রের ব্যবহার দক্ষতা কমা ও খরচ বেশি হওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব এবং কৃষি জমি হ্রাস পাওয়া। এসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগুনোর পরামর্শ দেয়া হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে সকালে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা থেকে খামারবাড়ি পর্যন্ত বর্ণাঢ্য র‌্যালির আয়োজন করা হয়। আধুনিক কৃষিযন্ত্রের সমাহার ॥ বিকেলে মেলা প্রাঙ্গণে ঘুরে দেখা গেছে, স্টলগুলো আধুনিক, বাহারি আর বিভিন্ন সাইজের কৃষি যন্ত্রপাতির পসরা সাজিয়ে বসেছে। কী নেই এখানে! আলু উত্তোলন, ভুট্টা মাড়াইকল, থেকে রিপার, পাওয়ার টিলার, থ্রেসার, কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ খুচরা যন্ত্রাংশ প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়েছে। কৃষি প্রযুক্তি আমদানিকারী বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এসেছেন বগুড়া ও সিলেট থেকে। কীটনাশক ছিটানোর ছোট-বড় যন্ত্রের প্রদর্শনী আছে প্রায় সব স্টলেই। আম, লিচু, কলাসহ বিভিন্ন ফলের বাগান ও কৃষিজমিতে কীটনাশক ছিটানোর জন্য ব্যবহার করা যাবে জনতা পাওয়ার বুম স্প্রেয়ার। যন্ত্রটির দাম পড়বে ৩০ হাজার টাকা। একটি বড় আকারের রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহারে বিঘা প্রতি খরচ পড়ে ৫০০ টাকা, যেখানে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে খরচ হয় ২ হাজার ২০০ টাকা। যন্ত্রটির দাম ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। তবে এটি সরকারী উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে সমতল এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ এবং হাওড় ও সিডর আক্রান্ত এলাকার জন্য ৭০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে পাওয়া যাব। মেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে জানা গেলো, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্র ব্যবহার করে ধান রোপণের ক্ষেত্রে কৃষকরা একাধিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বিভিন্ন দূরত্বে ও গভীরতায় চারা রোপণ করা যায়। একজন শ্রমিক ঘণ্টায় প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ জমিতে চারা রোপণ করতে পারে। যন্ত্রটি ব্যবহার করতে জ্বালানি খরচও খুব কম, ঘণ্টায় মাত্র ০.৫-০.৬ লিটার অকটেন প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া রয়েছে নিয়ন্ত্রিত ও নিখুঁতভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণে চারা রোপণ করার সুবিধা। নেই চারা নষ্ট হওয়ার কোন আশঙ্কাও। এসিআই মোটরসের স্টলে জমি চাষ থেকে শুরু করে ফসল কাটা এবং সেই ফসল মাড়াইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হওয়া প্রায় সব যন্ত্রপাতিই প্রদর্শিত হচ্ছে। সর্বশেষ প্রযুক্তি হিসেবে মেলায় তারা নিয়ে এসেছে ইয়ামাহার ব্রান্ডের রাইস ট্রান্সপেল্টার ও কম্বাইন্ড হারভেস্টার। মাত্র দুদিন আগে দেশে প্রবেশ করা সর্বশেষ প্রযুক্তির এসব যন্ত্র এখনও বাজারজাত শুরু হয়নি। এসিআইয়ের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানটি গত বছরে সাড়ে তিনশ’ কম্বাইন্ড হারভেস্টার বিক্রি করেছে। সরকারী টেন্ডারসহ এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০। প্রতিনিয়তই এসব যন্ত্রের চাহিদা বাড়ছে বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠানটির উর্ধতন কর্মকর্তারা। মেটাল এগ্রিটেক লিমিটেডের স্টলে ‘মেটাল চপার’ নামের একটি যন্ত্র চোখে পড়েছে। যন্ত্রটি দিয়ে শুধুমাত্র ঘাষ কাটা হয় এবং এর ব্যবহার ডেইরি ফার্মে। দাম প্রায় ১৪ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটির এজিএম এ্যান্ড হেড (মার্কেটিং ও সেলস) জহুরুল ইসলাম বলেন, এটি আমাদের নিজস্ব প্রোডাক্ট। অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে এই যন্ত্রটি নেই। এছাড়া চীন থেকে আমদানি করা সর্বশেষ প্রযুক্তির কম্বাইন্ড হারভেস্টার রয়েছ, যার দাম ১৮ লাখ টাকা।
×