ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নের সেতু নির্মাণে পাল্টে যাচ্ছে চিত্র;###;দেশী-বিদেশী ৬ হাজার শ্রমিক অবিরাম কাজ করছে

পদ্মাপারে গড়ে উঠছে নতুন নগরী

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

পদ্মাপারে গড়ে উঠছে নতুন নগরী

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে পাল্টে যাচ্ছে পদ্মাপারের চিত্র। গড়ে উঠছে নতুন নগরী। সেতু নির্মাণ এলাকায় দেশী শ্রমিকদের কোলাহল। তাদের ঘামেই তৈরি হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। কমবেশি ৬ হাজার শ্রমিক অবিরাম কাজ করছে। দেশী-বিদেশী এই শ্রমিকরা বসবাস করছে পদ্মাতীরে। দেশী- বিদেশী কর্মকর্তাদের জন্য তৈরি হয়েছে সার্ভিস এরিয়া নামের ৩টি উন্নতমানের বিশাল কমপ্লেক্স। সেতুর জন্য জমি দেয়া ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়েছে দুই পারে ৭টি। মাওয়া প্রান্তে চারটি এবং জাজিরার বাকরেরকান্দি, পূর্ব নাওডোবা ও পশ্চিম নাওডোবায় আরও তিনটি। মাওয়া প্রান্তের চারটির মধ্যে রয়েছে কুমারভোগে দুটি এবং মেদিনীম-লের জসলদিয়ায় দুটি। এই দুই পুনর্বাসন কেন্দ্রে রয়েছে পাঁচটি স্কুল এবং পাঁচটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র । রয়েছে ছয়টি নান্দনিক মসজিদ। রয়েছে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত ২৮ শ’ পরিবারকে এখানে পুনর্বাসন করেছে। দু’পারে সেনাবাহিনীর প্রায় ২ হাজার সদস্য অবস্থান করছেন। আর প্রতিদিনই এই অঞ্চলে কৌতূহলী মানুষের সমাগমও বাড়ছে। সামরিক-বেসামরিক জনগোষ্ঠীর পদচারণায় পদ্মাতীরের জনপদের এখন চেহারা পাল্টে গেছে। এক রকম নতুন নগরী তৈরি হয়েছে। এসব শ্রমিকের চাহিদা অনুযায়ী ঘরবাড়ি নির্মাণ ছাড়াও বসেছে হাট-বাজার, হরেক রকমের দোকান পাট। হয়েছে স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এপারের চন্দ্রেরবাড়ি, কুমারভোগ, শিমুলিয়া, হলদিয়া, দোগাছি, কান্দিপাড়া, জসলদিয়া, মাওয়া এবং ওপারের কুতবপুর, বাকরেরকান্দি, পূর্বনাওডোবা, পশ্চিম নাওডোবা এবং জাজিরা গ্রামগুলো ঘুরে দেখা গেছে এখানকার জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে। এসব এলাকার হাটবাজারে পরিবর্তন এসেছে। নতুন বসতি স্থাপনকারীদের চাহিদা অনুযায়ী নানা পন্যের পসরা থাকে। চীনা নাগরিকদের পছন্দের পণ্যও রাখা হয়। চীনা নাগরিকদের উপযোগী রেস্তরাঁও হয়েছে। দুইপার যেন স্বপ্নের শহর ॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মিত হচ্ছে এপারে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এবং ওপারে শরীয়তপুরের জাজিরা ও মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ওপর দিয়ে। দিন দিন তাই পাল্টে যাচ্ছে এসব এলাকার চিরাচরিত চিত্র। গ্রামীণ জনপদ হয়ে উঠছে শহুরে। ৭/৮ বছর আগে এখানে যারা এসেছিলেন তারা তফাৎটা বুঝতে পারেন খুব ভাল করেই। সেতু এলাকায় ১০ বছর আগের তুলনায় জায়গার মূল্য বেড়েছে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ গুণ। এ প্রসঙ্গে মাওয়া গ্রামের বাসিন্দা ও বাংলাদেশ কেমিস্ট এ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি লৌহজং উপজেলা শাখার সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি কুমারভোগ এলাকায় ১৯৯৭ সালে ৪০ শতাংশ জায়গা ৪০ হাজার টাকায় ও ২০০৩ সালে ৬১ শতাংশ জায়গা ৭৮ হাজার টাকায় খরিদ করি। এর মধ্যে ২০১০ সালের দিকে পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ ৮ শতাংশ জায়গা অধিগ্রহণ করে, যার মূল্য ছিল ১৮ লাখ টাকা। এখন বাকি জায়গার বাজার মূল্য প্রায় ৬/৭ কোটি টাকা। এই পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ায় জায়গার উচ্চমূল্য হয়েছে বলে আমি মনে করি। পদ্মা সেতু নির্মাণে বর্তমানে বিশেষ করে মূল সেতুতে স্থায়ী শ্রমিক কাজ করেন প্রায় ৪ হাজার। এছাড়া নদী শাসনে কাজ করেন আরও ১ হাজার শ্রমিক। এই বিপুল শ্রমিকের মধ্যে ১২শ’ চীনা নাগরিক, বাকিরা বাংলাদেশের। এই শ্রমিকদের কল্যাণে সেতুর দুইপারে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ভবন ও বাড়িঘর। স্থানীয় হাটবাজার হয়ে উঠছে রমরমা। দিনরাত এসব শ্রমিকের পদচারণায় জনপদ মুখর হয়ে উঠছে। স্থানীয় জমির মালিকরা টিনকাঠের ঘর তুলে ভাড়াও পাচ্ছেন শহরের মতো। ১৫ বর্গফুট ঘরের ভাড়া প্রায় দুই হাজার টাকা। চীনারা সেতুর দুইপারে বিভিন্ন বিল্ডিং কিংবা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন। সেসব বিল্ডিংয়ের মাসিক ভাড়া প্রায় ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ঢাকায় বসবাসকারী লৌহজংয়ের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা তাদের গ্রামের পাকাবাড়ি ভাড়া দিয়ে ঢাকার চেয়েও মোটা অঙ্কের টাকা কামাই করছেন। শ্রমিকদের কারণে স্থানীয় হাটবাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশি বলে উল্লেখ করেছেন অনেক স্থানীয় বাসিন্দা। কেউ কেউ আবার বলছেন শ্রমিকদের কারণে নয়, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে স্থানীয়রা পদ্মা সেতুর জন্য অধিগ্রহণ করা জমির উচ্চমূল্য পাওয়ার কারণে। পূর্ণাঙ্গ ক্যান্টনমেন্ট হচ্ছে ॥ পদ্মাতীরে পূর্ণাঙ্গ সেনানিবাস হচ্ছে। পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে হচ্ছে এই সেনানিবাস। এই সেনানিবাসের কর্মকা- এখন চলছে পুরোদমে। এছাড়া মাওয়া প্রান্তেও থাকছে সেনা ক্যাম্প। বর্তমানে দু’পার মিলে ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেডে এখন কর্মরত প্রায় ২ হাজার সেনা সদস্য। মাওয়া প্রান্তের দোগাছি ১ নম্বর সার্ভিস এরিয়ার ভেতরে এখন সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। ওপারের কুতবপুর ২নম্বর সর্ভিস এরিয়ার ভেতরে রয়েছে আরেকটি ক্যাম্প। দুটি সেনা ক্যাম্পে প্রায় ১ হাজার করে সেনা সদস্য রয়েছেন। সেতুর নিরাপত্তাসহ নানা কারণেই এই কম্পোজিট ব্রিগেড করা হয়েছে। আর সচল সেতুর জন্য হচ্ছ পূর্ণাঙ্গ ক্যান্টনম্যান্ট। এছাড়া এখন পুলিশ ফাঁড়ি থাকলেও দু’পারেই করা হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ থানা। শ্রমিকদের জীবনযাপন ॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে দেশী-বিদেশী ছয় সহস্রাধিক শ্রমিক কাজ করছেন। যোগ্যতার কারণে উচ্চ মজুরি, থাকা-খাওয়াসহ নানা সুবিধা পাচ্ছেন বিদেশী শ্রমিকরা। নামীদামী বাড়ি ভাড়া করে তারা সাচ্ছন্দে থাকছেন। কিন্তু দক্ষতা না থাকায় শুধু মজুরি বিক্রি করে অনেক কষ্টে থাকছেন দেশী শ্রমিক। দেশী শ্রমিকদের বেতন, থাকা-খাওয়াসহ সবকিছুই নি¤œমানের। পদ্মা সেতুর দুইপারে দিনমজুররা প্রতিদিন যেখানে অন্তত ৫০০ টাকা কামাই করেন। পদ্মা সেতুতে নিয়োজিত একজন শ্রমিকের মাসিক মজুরি সাড়ে ৯ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা। সেই হিসেবে দিনপ্রতি মজুরি ৩১৬ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পড়ে। পুনর্বাসনের বাসিন্দাদের কথা ॥ পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের আওতায় মাওয়া অংশের কুমারভোগ ও যসলদিয়ায় চারটি পুনর্বাসন কেন্দ্র। মৌলিক কোন পার্থক্য না থাকলেও সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে কিছু পার্থক্য আছে। কেন্দ্র দুটির প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেবার মান নিয়ে কারও কোন অভিযোগ নেই। কুমারভোগ পুনর্বাসন কেন্দ্রে বাজার স্থাপন করা হলেও সেখান কোন বাজার বসে না। অন্যদিকে যসলদিয়া কেন্দ্রে বাজার থাকলেও সেখানে মাছ ও শাকসবজি পাওয়া যায় না। কমিউনিটি সেন্টার নেই উভয় কেন্দ্রেই। যসলদিয়া কেন্দ্রে বাজার, স্কুল, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এক সঙ্গে পাশাপাশি থাকলেও কুমারভোগ কেন্দ্রে সেসব রয়েছে একটি থেকে অন্যটি বেশ দূরে দূরে। কাকতালীয়ভাবে কুমারভোগ কেন্দ্রের বাসিন্দারা যসলদিয়া কেন্দ্রের বাসিন্দাদের চেয়ে তুলনামূলক আর্থিক দিয়ে ভাল। যসলদিয়া কেন্দ্রের বাসিন্দাদের কর্মস্থলে যেতে অনেক বেগ পেতে হয় রাস্তাঘাটের দুরবস্থার কারণে। এতে তাদের একদিকে যেমন ভোগান্তি রয়েছে, অন্যদিকে যাতায়াত ভাড়ায় বেশ খরচ হচ্ছে। উভয় কেন্দ্রে রোপিত গাছ নিয়ে বাসিন্দাদের অসন্তুষ্টি আছে। তাদের বেশিরভাগের অভিমত হলো - ঝাউগাছ ও তেঁতুলগাছ লৌহজংয়ে বেমানান, এখানে স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে উপযুক্ত গাছ রোপণ করা উচিত। রাতে বিদ্যুতের আলো ও নাইট গার্ডের ব্যবস্থা নেই কোন কেন্দ্রেই। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এখানে ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় অনায়াসেই। কেন্দ্রের ভেতরে খালি জায়গায় শিশুদের জন্য রাইড নির্মাণ করে বিনোদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কেন্দ্র দুটি থেকে বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট কোন জায়গা নেই। নেই আবর্জনা নিতে আসা লোকবল। ফলে পুনর্বাসনের বাসিন্দাদের যত্রতত্র ময়লা ফেলতে হয়।
×