ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৪ বছরে ৮১৭ কোটি টাকার স্বর্ণ আটক

বিমানবন্দর যেন সোনার খনি!

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বিমানবন্দর যেন সোনার খনি!

ওয়াজেদ হীরা ॥ বিমানের টয়লেট থেকে শুরু করে যাত্রীর শরীর কোথায় নেই সোনা! যাত্রীর পেটে, পায়ুপথ, ব্যাগ, জুতা কিংবা মোবাইল ফোনসহ নানাভাবে অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর দিয়ে আসছে সোনার ছোট-বড় চালান। অনেক ক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকিও নিচ্ছে চোরাকারবারি কিংবা বহনকারীরা। একের পর এক বড় চালান ধরা পড়ায় এক ধরনের ভীতি থেকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে সোনা চোরাচালান হচ্ছে। বিমানবন্দরে প্রতি মাসেই যে হারে সোনার চালান ধরা পড়ছে তাতে যে কারও মনে হবে, বিমানবন্দর যেন সোনার খনি! ধরা পরা সত্ত্বেও থেমে নেই সোনা আসা। আর কর্তৃপক্ষ বলছে, অভিযান প্রতিনিয়তই চলবে। চোরাচালানের রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। মূলত বিদেশ থেকে সোনা চোরাচালানের ক্ষেত্রে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দর ব্যবহৃত হয়। গত কয়েক মাসের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, প্রায় প্রতি মাসেই সোনা আটক হচ্ছে। এতেই স্পষ্ট চোরাকারবারিরা থেমে নেই। আটক আর মামলা কোনটাই দমাতে পারছেনা চোরাকারবারিদের। দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে রয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। চোরাকারবারিরা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেও ধরা পড়ছে তবুও থামছেনা এই সোনা আনা। প্রতি মাসেই ধরা পড়ছে সোনার ছোট বড় চালান। কাস্টমস এবং শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের আটক করা চালানগুলোর মধ্যে লাখ টাকার অঙ্ক থেকে কোটি টাকার চালানও রয়েছে। সর্বশেষ সোমবারও বিমানের দুই পরিচ্ছন্ন কর্মীকে ৪০টি সোনার বারসহ আটক করা হয়। ৪ কেজি ৬৪০ গ্রাম ওজনের সোনার মূল্য রয়েছে দুই কোটি টাকার বেশি। সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সোনার বড় বড় চালান জব্দ হলেও চোরাচালানি চক্রের নেপথ্যের প্রভাবশালীরা বরাবরই ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। আবার ধরা পড়লেও জামিনে বের হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিমানবন্দর কেন্দ্রিক চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। এছাড়াও মামলার দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ, সাক্ষীর অভাব, তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্বলতাসহ নানা কারণে অপরাধীদের শাস্তিও হচ্ছে না। ফলে গত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন বিমান বন্দর বিশেষ করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালান হচ্ছে। বিমানের টয়লেটে, বিমানের সিটের নিচে, প্যাকেট, যাত্রীর জুতার ভেতরে, লাগেজসহ নানা জায়গায় মিলছে সোনা। মনে হতে পারে প্রতিটি বিমানবন্দর এক একটি সোনার খনি! গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতার মাঝেও বন্ধ হয়নি চোরাচালান। অভিযোগ রয়েছে, চোরাচালানি চক্র এতটাই শক্তিশালী যে তাদের পাকড়াও করতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দারা। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ অর্থবছরের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রত্যেক বছরেই সোনার চালান ধরা পড়েছে। এছাড়াও ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মোট ৫৫ মাসের মধ্যে মাত্র তিনটি মাস ব্যতীত প্রত্যেক মাসেই ধরা পড়েছে সোনার চালান। আর তাতেই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, নানা মাধ্যমে সোনা আসছে। ধরা না পড়া সোনার চালানের পরিমাণ আরও বেশি হবে সে আশঙ্কাও বাড়ছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ গত চার অর্থবছরে সোনা আটকের পরিমাণ ১৬২২.৭৭ কেজি যার মূল্য ৭৬৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এই চার বছরে চোরাচালানের জন্য আটক করা হয়েছে ১২৬ জনকে। যদিও অনেকেই জামিনে বেরিয়ে পালিয়ে গেছেন দেশের বাইরেও। সর্বশেষ গত চার অর্থবছরের সঙ্গে আরও সাত মাস অর্থাৎ জানুুয়ারি ২০১৮ সহ মোট ৫৫ মাসে ১৭১৭.২০ কেজি সোনা আটক হয়েছে যার মূল্য ৮১৭ কোটি ২২ লাখ টাকা। একই সময়ে আটক হওয়া আসামির সংখ্যা ১৮৯ জন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী, কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, কয়েকটি প্রাইভেট এয়ার লাইন্সের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন পেশার অসাধু কর্তা ব্যক্তিরা জড়িত রয়েছেন। আর তাদের জড়িত থাকার কারণেই বন্ধ হচ্ছে না সোনা চোরাচালান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্যও সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোপূর্বে বিমানের উপ-মহাব্যবস্থাপকসহ পাঁচজন গ্রেফতারও হন। তখন জানা যায়, চোরাচালানের এই চক্রে বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও বিদেশীরা জড়িত। শুল্ক গোয়েন্দারা চোরাচালানের ঘটনাগুলো তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পেরেছে, বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। যাদের অনেকেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এর ফলে কোন অবস্থাতেই সোনার পাচার বন্ধ হচ্ছে না। কিছুদিন পর পরই আটক হচ্ছে বড় সোনার চালান। আর আটক না হওয়ার চালানের সংখ্যা যে কি পরিমাণ তা অজানা। তবে শুল্ক গোয়েন্দার উর্ধতন একাধিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আটক হওয়া সোনা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে যোগ করা হয় যা যোগ হয় জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে। এদিকে এই সোনা চালানের সঙ্গে সোনা ব্যবসায়ীরাও যুক্ত এমন অভিযোগও রয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকারও করেছেন ব্যবাসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস)। বাজুসের সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার জনকণ্ঠকে বলেন, এসব ভুয়া তথ্য। কোন ব্যবসায়ী এর সঙ্গে জড়িত নয়। কখনও কোন ব্যবসায়ীর নামে কোন মামলাও হয়নি। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে স্বর্ণনীতির কথা বলে আসছে ব্যবসায়ীরা। সে বিষয়ে সম্প্রতি এ উদ্যোগও নেয়া হয়েছে বলেও জানান বাজুসের সভাপতি। গঙ্গাচরণ মালাকার বলেন, এই স্বর্ণনীতি হলে আমরা মনে করছি আমরা যেভাবে চেয়েছি তাতে সোনা চোরাচালান কমে যাবে। ইতোমধ্যেই সচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এনবিআর, কাস্টমস, বাংলাদেশ ব্যাংক সবাই স্বর্ণনীতি নিয়ে মতামত দিচ্ছে। আশা করছি একমাসের মধ্যে একটা ফল আসবে। গোয়েন্দাসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভৌগোলিক অবস্থান ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে আন্তর্জাতিক সোনা চোরাচালানকারিরা বাংলাদেশকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আকাশ ও স্থলপথে সোনা চোরাচালান হয়ে আসছে বাংলাদেশে। অনুসন্ধানে জানা যায়, আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশকে চোরাচালানের নিরাপদ ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে। এখন মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও সোনা আসছে ইউরোপের কয়েকটি দেশ থেকে। আকাশপথে সোনার চালান এনে তা সহজেই আবার স্থলপথে পাচার হচ্ছে পাশের দেশ ভারতে। এ পর্যন্ত যত সোনা আটক হয়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সোনা পাচার হয়েছে নিরাপদে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপুল অঙ্কের লাভের কারণে চোরাকারবারিরা সোনা চোরাচালানে যুক্ত হচ্ছে। তবে অনেকের অভিযোগের তীর দেশীয় সোনা ব্যবসায়ীদের দিকেও। ব্যবসায়ীরা অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ব্যাগেজ রুলসের আওতায় আনা কিছু কিছু সোনা ক্ষেত্রবিশেষে কেনা হলেও বাংলাদেশের সোনার বাজারের চাহিদার বেশির ভাগ অংশই পূরণ হয় পুরনো সোনা দিয়েই। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ব্যাগেজ রুলস অনুযায়ী, বিদেশ থেকে একজন যাত্রী ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালঙ্কার আনতে পারবেন। এ জন্য তাকে শুল্ক দিতে হবে না। আর সোনার বার আনতে পারবেন ২৩৪ গ্রাম, তবে এর জন্য শুল্ক দিতে হবে। তবে এই সোনাও ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যই কেবল আনা যাবে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টমসের এক কর্মকর্তা বলেন, নির্দিষ্ট সীমা থেকে অল্প কিছু বেশি সোনা আনা হলে সাধারণত তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় না। বাংলাদেশে বৈধ পথে সোনা আনার সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে তারা এ ছাড় দেন বলেও জানান তিনি। টিআইবির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বৈধ পথে আমদানি না হওয়ায় সোনা সংশ্লিষ্ট এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি বার্ষিক ৪৮৭ থেকে ৯৭৪ কোটি টাকা পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, চোরাচালানকারীদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছে। আমাদের কাছে খবর আছে, জামিনে ছাড়া পেয়ে তারা আবারও এই ব্যবসা শুরু করেছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জনকণ্ঠকে বলেন, সোনার অবৈধ প্রবেশ আগের তুলনায় অনেকটা কমানো সম্ভব হলেও বন্ধ করা যায়নি। প্রতিনিয়তই কোন না কোন বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালান অব্যাহত আছে। তবে আমাদের কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে অধিকতর সজাগ রয়েছেন। আমাদের সার্বক্ষণিক অভিযান আছে এবং অভিযান অব্যাহত থাকবে। বিমানবন্দরগুলোতে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যেই সরকারকে বিষয়গুলো অবহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ হয়ে সোনা আসে, সোনা যায়। আর আসা যাওয়ার সেই মাধ্যম ঠেকাতে এখনই দ্রুত পদ্ধতি অবলম্বন করার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের। একই সঙ্গে যে কোন ধরনের পাচার রোধে সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অন্যান্য বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।
×