ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীতে ছিনতাই রোধে বস্তিতে চলছে ব্লকরেইড

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রাজধানীতে ছিনতাই রোধে বস্তিতে চলছে ব্লকরেইড

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ছিনতাইরোধে ভোরে ও গভীর রাতে রাজধানীর নিরাপত্তা আরও জোরদার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনে গুলি চালানোর কথাও বলা হয়েছে। ঢাকার বস্তিগুলোতে ব্লক রেইড পদ্ধতিতে অভিযান চালানো হচ্ছে। রাজধানীতে ছিনতাইকারীদের হাতে একের পর এক হত্যাকা-ের ঘটনার পর এমন নিদের্শ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে। চলতি সপ্তাহেই ছিনতাইকারীরা এক নারী ও দুই ব্যবসায়ীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ছিনতাইকারীদের এমন লোমহর্ষক হত্যাকা-ের ঘটনা নগরবাসীর মনে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে রাজধানীতে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। যদিও শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তিনটি ঘটনায় জড়িত ছিনতাইকারীদের কেউই গ্রেফতার হয়নি। গত ২৬ জানুয়ারি শুক্রবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ঢাকার ধানম-ির ৭ নম্বর সড়কে ছিনতাইকারীরা একটি সাদা প্রাইভেটকারযোগে হেলেনা বেগম (৩৫) নামে এক নারীর ব্যাগ ছিনিয়ে নিলে ওই নারী রাস্তায় পড়ে যান। ছিনতাইকারীরা তার ওপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে যায়। গাড়ির চাকায় হেলেনার মাথা পিচঢালা রাস্তায় পিষে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় তার। এত দ্রুততার সঙ্গে ঘটনাটি ঘটে যে, দেখা ছাড়া আর কারও কিছুই করার ছিল না। একই দিন শুক্রবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে যাত্রাবাড়ির সায়েদাবাদ রেললাইনের পাশে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী ইব্রাহিম (৩৬) মারাত্মক আহত হন। প্রায় এক কিলোমিটার দৌড়ে রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি সালাউদ্দিন হাসপাতালে যান। সেখান থেকে চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করলে তার মৃত্যু হয়। গত ১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় ছিনতাইকারীরা প্রাইভেটাকারযোগে আল আমিন (২২) নামে এক বিকাশ এজেন্টকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে তার কাছে থাকা প্রায় ৮ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এর আগে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর ভোর সোয়া ছয়টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ রেলসেতুর কাছে ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার সময় মায়ের কোল থেকে পড়ে সাড়ে পাঁচ মাস বয়সী আরাফাত নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়। এই ছিনতাইকারী গ্রেফতার হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্র বলছে, বছরের শুরুতেই ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের গ্রেফতারে চলছে সাঁড়াশি অভিযান। অভিযানের মুখেও তাদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। কারণ অধিকাংশ ছিনতাইকারী কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটার পর এবং সাঁড়াশি অভিযানের মুখে আত্মগোপনে চলে গেছে। ছিনতাইকারীরা সাধারণত ঢাকা ছেড়ে জেলা শহরগুলোতে আত্মগোপন করে। যারা ঢাকায় আত্মগোপনে করে, তাদের অধিকাংশের পছন্দ বস্তি। কারণ বস্তিতে বসবাসকারীদের সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য নেই কোন সংস্থার কাছেই। এ ছাড়া পেশাদার ছিনতাইকারীদের অনেকেই ইচ্ছে করে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে না। এ জন্য অনেক ছিনতাইকারী গ্রেফতার হলেও বা দুর্ঘটনায় মারা গেলেও তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় মেলে না। তাদের বিরুদ্ধে থাকা চাঞ্চল্যকর মামলা সম্পর্কেও তেমন তথ্য মেলে না। ফলে ছিনতাই মামলাগুলোর তদন্ত চলতেই থাকে। এ জন্য অনেক মামলার শেষ পর্যন্ত ফাইনাল রিপোর্ট দিতে হয়। ছিনতাইকারীদের দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক রয়েছে। ছিনতাইকারীরা অনেক বেশি কৌশলী। ঢাকায় যারা ছিনতাই করছে, তাদের অধিকাংশই ঢাকার বাইরে থেকে আসা। মোটা অঙ্কের টাকা ছিনতাই করার পর আবার তারা আত্মগোপনে চলে যায়। অনেকেই গ্রামে চলে যায়। এসব ছিনতাইকারীদের টার্গেট ব্যাংক থেকে উত্তোলিত মোটা অঙ্কের টাকা। আবার জমা দেয়ার উদ্দেশে বের হওয়ার পর মোটার অঙ্কের টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে। এসব ছিনতাইয়ের সঙ্গে ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লোকজন জড়িত থাকে। ছিনতাইকারীরা মোটা অঙ্কের টাকা ছিনতাই করার পরেই ঢাকা ছেড়ে চলে যায়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় ছিনতাইকারীদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। মাদকের টাকা যোগাড় করতেই তারা ছিনতাই করে থাকে। মাদকের মধ্যে ইয়াবা মারাত্মক বিস্তার লাভ করেছে। অল্প বয়সীদের মধ্যে ইয়াবা সেবনের হার বেশি। তাদের অধিকাংশই মাদকের টাকা যোগাড় করতে ছিনতাই করে থাকে। যেসব এলাকায় ইয়াবা সহজলভ্য, সেসব এলাকায় তুলনামূলকভাবে ছিনতাইয়ের ঘটনাও বেশি ঘটে। এ জন্য এবারের অভিযানে গ্রেফতারের অন্যতম টার্গেটে রয়েছে অল্প বয়সী বা মাঝামাঝি বয়সী মাদকাসক্তরা। ঢাকায় থাকা মাদকের স্পষ্টগুলোতে এবং বস্তিগুলোতে ব্লক রেইড পদ্ধতি অভিযান চালানো হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ছিনতাইকারীসহ নানা ধরনের অপরাধীদের গ্রেফতারে সারাদেশেই অভিযান চলছে। ছিনতাইকারীদের হাতে বেশ কয়েকটি হত্যাকা-ের পর অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। অভিযানে প্রয়োজনে গুলি চালানোর নির্দেশও রয়েছে। ছিনতাইকারী ও অপরাধীদের গ্রেফতারে প্রয়োজনে গুলি চালানোর নির্দেশ রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. জাভেদ পাটোয়ারী, র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশ মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়াসহ পুলিশ ও র‌্যাবের প্রতিটি ইউনিটের প্রধানরা সন্ত্রাসী, অপরাধী ও ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে প্রয়োজনে সব ধরনের পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান এবং র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, সম্প্রতি ভোরে ও গভীর রাতে ছিনতাই হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ জন্য দিন ও রাতের অন্যান্য সময়ের পাশাপাশি ভোরে ও গভীর রাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। টহল জোরদার করা হয়েছে। সাধারণত সেসব স্থানে ছিনতাই হওয়ার সম্ভবনা আছে বা হয়, সেসব জায়গায় টহল বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি ওইসব জায়গাগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মাদকস্পট ও বস্তিগুলোতে নিয়মিত অভিযান চলছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই ছিনতাইকারীদের হাতে চাঞ্চল্যকর তিনটি হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে।
×