ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বর্ণযুগের সুপ্রিয়া দেবী

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

স্বর্ণযুগের সুপ্রিয়া দেবী

বলা ঠিক হবে কী না বুঝতেছি না, তার পরও বলি, যখন শুনলাম ঋত্ত্বিক দা (ঋত্ত্বিক কুমার ঘটক) এ্যালকোহল বা মদে পুরোপুরি আসক্ত। তাঁর বাড়ি গেলাম। বললাম, তুমি এসব ছাড় এটা তোমাকে রুইন্ড করে দেবে। না না আমি বেশি খাই না! ঋত্ত্বিক দা। তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তুমি এসব বন্ধ কর। আমরা যখন যোদপুর পার্ক স্ট্রিটে থাকি তখন হঠাৎ একদিন ঋত্ত্বিক দা এলেন, বেনু (সুপ্রিয়া দেবীর ডাক নাম) ‘সুবর্ণরেখা’র পর আমি তো আর কোন কাজ পাচ্ছি না। তুই আমার একটা উপকার কর। তখন, আমার সঙ্গে উত্তম বাবুর (উত্তম কুমার) মোটামুটি একটা ইনভলমেন্ট হয়ে গেছে। তুই উত্তমকে বল আমাকে একটা সুযোগ করে দিতে। বললাম, ঠিক আছে! আমি নিশ্চয়ই করব। কিন্তু তার আগে তোমাকে কথা দিতে হবে, তুমি আর ড্রিং করবা না। হ্যাঁ, আমি কথা দিলাম। এরপর আমি উত্তম বাবুকে বললাম, তুমি ঋত্ত্বিক দার ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখ। হি ইজ রিয়েলি জিনিয়াস! সিনেমা দেখে সে তো ভীষণ মুগ্ধ! বললেন, তুমি আলাপ করার ব্যবস্থা কর। আমাদের যোদপুরের বাড়িতে একদিন সকাল সাড়ে আটটায় ঋত্ত্বিক দা এলেন আর ন’টায় উত্তম বাবু। ও দিন আমার শূটিং ছিল না। দু’জনকে পাশাপাশি বসিয়েছি; আলাপের শুরুতে ঋত্ত্বিক দা বললেন, স্ক্রিপ নিয়ে এখানে নয় আলোচনা হবে ভাল কোন হোটেলে। আমি বললাম, এখানেই কর আমি রান্না করছি তোমরা খেতে খেতে আলোচনা কর। বললেন, না হোটেলেই হতে হবে! তারা দু’জন বেরিয়ে গেল। আমি রান্না করে বারোটা, একটা, তিনটে, চারটে পর্যন্ত না খেয়ে তাদের অপেক্ষায়... শেষে সন্ধ্যে ছয়টা নাগাদ উত্তম বাবু এসে কড়া নাড়লেন আমি দরজা খুলে দিলাম। ঢুকেই দু’হাত জোর করে ক্ষমা চাওয়ার মতো করে বললেন, আমাকে মাপ কর! তাঁরে দিয়ে আর সম্ভব নয়! হোটেলে গিয়ে স্ক্রিপ নিয়ে আলোচনার শুরুতে প্রথমে একটা বিয়ার তারপর দুইটা বিয়ার! এভাবে সাড়াটা সময় কী সব বলে বলে মদে বুঁদ হয়ে গেল, আমিও লোড! শেষে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এই এলাম। ভাবতে ভীষণ কষ্ট হয়, এই জিনিয়াস মানুষটা মদের কছে জীবনটা শেষ করে দিল! কেউ তাকে ভাল করার চেষ্টা করল না, সবাই যেন তাকে মদের দিকেই ঠেলে দিল! এটা আমার একান্ত ধারণা, হয়ত ভুলও হতে পারে! মারা যাওয়ার কিছু দিন আগে অসুস্থ শরীর নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলেন, আমি তখন পীযূষ গাঙ্গুলীর ‘ভোল ময়রা’র কাজ করছি। বললাম, ঋত্ত্বিক দা তুমি এখন যাও পরে এসো। যখন গেলেন তখন বেশ খারাপ লাগছিল, মানুষটা এভাবে চলে যাবে। তারপর শূটিং-টুটিং করে তিন দিন পর কলকাতায় এলাম তখন পীযূষ গাঙ্গুলী জানাল, ঋত্ত্বিক দা মারা গেছেন। শুনে বিষয়টা আমি নিতেই পারিনি। তিন দিন কোন কাজ করতে পারি নাই। ভোলা ময়রার কাজ তিন দিন বন্ধ ছিল... সদ্য প্রয়াত বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের অভিনেত্রী, পদ্মশ্রী থেকে বঙ্গবিভূষণ সম্মানে ভূষিত হওয়া সুপ্রিয়া দেবীর এক দীর্ঘ সাক্ষাতকারের অংশ এটি। গত শুক্রবার ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পঁচাশি বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন, কালোউত্তীর্ণ এই অভিনেত্রী। বাংলা সিনেমায় এবং অগণিত দর্শকদের সুখানুভূতিতে এই অভিনেত্রীর ভূমিকা সত্যই অসামান্য। খুব অস্থির সময়ের মধ্যে যখন দেশ ভাগ এবং এর পরবর্তী সময় এগোছিল তখন, সুপ্রিয়া দেবী-উত্তম কুমারে মনোনিবেশ করে অসংখ্য সমস্যাসঙ্কুল মানুষ তাদের অস্থির সময় পাড়ি দিয়েছেন। এ সত্যটা অনেক প্রাজ্ঞজন এখনও অবলীলায় স্বীকার করেন, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘বন পলাশীর পদাবলী’, ‘যদি জানতেম’, ‘আপকি পাঁরছাইয়া’, ‘বসু পরিবার’, ‘চিরদিনের’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘দেবদাস’সহ প্রায় ত্রিশটি সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে সুপ্রিয়া দেবী নিজেকে নিয়েছেন হিমাদ্রী উচ্চতায়। তাঁর রাজকীয় রূপ, ভুবন ভোলানো হাসি, বলতে গেলে, এক রকম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দর্শকদের ভুলিয়েছে! সুপ্রিয়া দেবীর জন্ম ১৯৩৩ সালে তৎকালীন বার্মায় (বর্তমান মিয়ানমার)। মাত্র সাত বছর বয়সে বাবার হাত ধরে থিয়েটারের মঞ্চে; এরপর ১৯৫২ সালে ‘বসু পরিবার’ ছবিতে উত্তম কুমারের সঙ্গে পর্দায় আত্মপ্রকাশ। শুরুতে কৃষ্ণা তারপর বেনু পরবর্তীতে অন্তিম দিন পর্যন্ত সবার প্রিয় সুপ্রিয়া দেবী হয়েই রয়ে গেলেন! ব্যক্তিগত জীবনে বিভিন্ন সময়ে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করতে হয়েছে এই মানুষটিকে। অসময়ে বিয়ে, অপত্যাশিত বিচ্ছেদ পরবর্তীতে উত্তম কুমারের সঙ্গে আলোড়িত প্রেম এবং সংসার। অভিনয় জীবনের বাইরেও তাঁর ব্যক্তিজীবন ছিল অসংখ্য মানুষের কাছে গগনসম আগ্রহের বিষয়! খুবই সাহসী ছিলেন এই সুন্দর মানুষটি। নিজের এবং অন্যের ব্যাপারে অকপটে সত্য বলতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হতেন না। জীবদ্দশায় সুপ্রিয়া দেবীর লেখা, ‘আমার জীবন, আমার উত্তম’ আত্মজীবনী সম্পর্কে চিত্রনাট্যকার শিবাশিস চট্টোপাধ্যায় এমনটাই বলেছেন, ‘বাঙালী তাঁর আত্মজীবনীতে প্রেম, যৌন জীবন, যৌন প্রবণতা, স্ক্যান্ডেল লুকিয়ে যায়। সে বিচারে অকুতোভয়, খোলামেলা এই বই। বললে বা লিখলে অসংখ্য বিষয় তাঁর সম্পর্কে লেখার যোগ্য মনে হবে আমার এবং পাঠকের। কিন্তু, তা যে সম্ভব নয়! শুধু শেষে একটা কথা বলব। ভারতীয় বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার ভারতীয়রা কতটা আধুনিক কতটা উঁচুমার্গীয় চেতনাধারী তার উপযুক্ত প্রমাণ এই সদ্যবিদায়ী মানুষটি।
×