ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল মালেক

আমেরিকান রাজনীতিতে ঘটনার ঘনঘটা

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮

আমেরিকান রাজনীতিতে ঘটনার ঘনঘটা

এদেশে কথায় কথায় বলা হয়, তিন ডব্লিউকে বিশ্বাস করা যায় না যথা ওম্যান, ওয়েদার এ্যান্ড ওয়ার্ক। কিন্তু ইদানীংকালের আমেরিকান পলিটিক্সে ঘটনার ঘনঘটা দেখে মনে হয়, পলিটিক্সের পি অক্ষরটিও এতে নতুনভাবে সংযোজিত হতে পারে কি? কদিন যাবত শুরু করা লেখাটি অবশেষে ২৬ জানুয়ারি যখন মরিয়া হয়ে একেবারে গুটিয়ে ফেলেছি তখন সকালেই এলো একটি বোম্ববাস্টিক নিউজ- প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাকি সে সময় নতুন নিয়োজিত স্পেশাল কাউন্সিলের প্রধান রবার্ট মুলারকে ফায়ার করতে চেয়েছিলেন। এর আগে ২৪ তারিখে একই লেখা শেষ করার প্রাক্কালে প্রেসিডেন্টের নিজমুখে ঘোষণা এসেছিল, তিনি রবার্ট মুলারের সেই বহুল কথিত স্পেশাল কাউন্সিলে সাক্ষ্য দিতে রাজি। ট্রাম্প তো বরাবরই বলে আসছিলেন নির্বাচন ’১৬-র সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ান যোগসাজশের ব্যাপারটা তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাজানো। এবার আরও বললেন, রাশিয়ানদের সঙ্গে আঁতাত করে তিনি নির্বাচনে জিতেননি, জিতেছেন তার নিজ যোগ্যতায়। প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের চাইতে যোগ্যতর প্রার্থী বলেই লোকে তাকে ভোট দিয়েছেন। এরপর ২৫ তারিখে যখন এই লেখা শেষের ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলতে উদ্যত সেই সকালে তার এক কৌঁসুলি বললেন, ব্যাপারটা এককভাবে প্রেসিডেন্টের ওপর নির্ভর করছে না। এর ওপর হঠাৎ করে এক সময়ের রিয়ালিটি টিভি স্টার ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিলেন ডেমোক্র্যাটদের দাবি অনুযায়ী আমেরিকান ড্রিমারদের বৈধতা দিতে সম্মত। ব্যাপারগুলো যেন এদেশের কোন কোন দিনের আবহাওয়া। সকালে হয়ত কিছু ঈষদুষ্ণতায় হালকা কাপড় পরেছে লোকজন কিন্তু দুপুরেই ফিরে এলো প্রচণ্ড শীতের দাপট। পূর্ব লেখার সূত্র ধরে বলি, ইতোমধ্যে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পূরণ করে ফেললেন নিজ প্রেসিডেন্সির একটি বছর। কিন্তু অভিষেকের সময় থেকেই তার বিরুদ্ধবাদী আন্দোলন শুধু আমেরিকা নয়, রাস্তা দখল করেছিল প্যারিস, লন্ডনসহ আরও কিছু বড় শহরের। তার এক বছরের এই শাসনামলে সুযোগ পেলেই সেটি তার বিরুদ্ধে মাথা তুলেছে বার বার। এতদ্ব্যতীত নির্বাচন ’১৬তে রাশিয়ান হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে যে তদন্ত জাল বিস্তার করা হয়েছিল সেটি বর্তমানে প্রেসিডেন্টকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে। ভূতপূর্ব এফবিআই ডিরেক্টর রবার্ট মুলারের নেতৃত্বে স্পেশাল কাউন্সিল ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে প্রায় সকলেরই জেরা শেষ করে হোয়াইট হাউসমুখী হয়েছেন। ইতোপূর্বের জেরার মুখে প্রেসিডেন্সিয়াল ট্রান্সিশনের সময় রাশিয়ান সরকারের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল কিনা মর্মে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভূতপূর্ব এবং বরখাস্তকৃত ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার জেনারেল মাইকেল ফ্লিন এফবিআইর কাছে মিথ্যা জবানবন্দী দিয়েছিলেন মর্মে নিজেকে দোষী বলে স্বীকার করেছেন। একই বিষয়ে বর্তমান এ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনকে গত সপ্তাহে এই বিশেষ কাউন্সিল তদন্তের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বেশ কয়েক ঘণ্টা। ট্রাম্প বা তার কোন সহকর্মী রাশিয়ান যোগসাজশের বিষয়ে সহায়তা করেছেন কি-না এই মর্মে ক্রিমিনাল এনকোয়ারির জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। স্মরণ করিয়ে দেয়া ভাল, সেশন হচ্ছেন এরকম জেরার মুখেপড়া ট্রাম্প মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সদস্য। প্রেসিডেন্ট নিজে কিংবা তার অধীনস্থ ব্যক্তিবর্গ এই বিষয়ে এফবিআই তদন্তের সময় বিচার কর্মে বাধা বা অবস্ট্রাকশন অব জাস্টিস করেছিলেন কিনা সেটাও তার কাছ থেকে বের করার চেষ্টা করেছে কাউন্সিল। এখানে স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার, নির্বাচনী প্রচার চলাকালে ট্রাম্পের বৈদেশিক বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন তদানীন্তন সিনেটর সেশন। নির্বাচনকালীন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ট্রাম্প শাসনামলের শুরুর দিকেই বরখাস্ত হওয়া বহুল আলোচিত এফবিআই প্রধান জেমস কোমির জেরা শেষ হয়েছে আরও আগে। এবার জিজ্ঞাসাবাদের পালা ট্রাম্প কর্তৃক আর এক পদচ্যুত ব্যক্তি হোয়াইট হাউস চীফ স্ট্রাটেজিস্ট স্টিভ ব্যাননকে। এ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশন এবং প্রাক্তন এফবিআই ডিরেক্টর কোমি বিষয়ক প্রশ্ন ছাড়াও তাকে সম্ভবত প্রশ্ন করা হবে মাইকেল ফ্লিন এবং কোমিকে ফায়ার করার পেছনে তার ওপর ট্রাম্পের কোন চাপ ছিল কিনা। বলা ভাল, স্টিভ বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যতম শত্রু। বরখাস্ত হবার পর তার বরাতে যে বইটি প্রকাশিত হয়ে বর্তমানে বাজারে সরগরম সেটিতে তিনি কুৎসা গেয়ে বিষোদ্গার করেছেন একসময়ের প্রিয়ভাজন ট্রাম্প এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে। এবার প্রেসিডেন্টকে শপথ নিয়ে জবাব দিতে হবে স্পেশাল কাউন্সিল কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদের। কাউন্সিল তাকে জেনারেল মাইকেল ফ্লিন ও কোমির বরখাস্তে অবস্ট্রাকশন অব জাস্টিস করেছিলেন কি-না সে বিষয়েও প্রশ্ন করবে। গত ২৪ জানুয়ারি বুধবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন শপথ নিয়ে তিনি মুলারের বিশেষ কাউন্সিলের কাছে ইন্টারভিউ দিতে প্রস্তুত। তবে প্রেসিডেন্ট কি সরাসরি কৌঁসুলিদের প্রশ্নের মুখোমুখি জবাব দেবেন নাকি সেটা হবে লিখিত, এ বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্প সারাজীবন ধরে ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে কয়েক ডজন জবানবন্দী দিয়েছেন; তদুপরি স্পেশাল কাউন্সিল কর্তৃক নির্বাচন ’১৬ এবং রাশিয়ান যোগসাজশের এই জিজ্ঞাসাবাদ তাকে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন করতে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে। এরই ভেতর ঝড় তুলেছে বহুল কথিত ফেডারেল গবর্নমেন্ট শাটডাউন সঙ্কটটি। যখন মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য আপাত একটি সমাধান মিলেছিল তখন আশা ছিল সেই পথেই হয়ত মিলে যাবে সঙ্কট উদ্ধারের সম্পূর্ণ পালাটি। কিন্তু সেটা হয়নি এই কারণে যে, বিবাদের শেকড়টা তলে তলে তরতাজা রাখতে চাচ্ছেন উভয় দলই। সরকারের এই বাজেট পাস নিয়ে ওয়াশিংটন রাজনীতির যে নগ্ন রূপ প্রকাশিত হলো তাতে রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা বলছেন : আমেরিকার দুটি দলের দলীয় সঙ্কীর্ণতার কাছে পরাস্ত হচ্ছে মানুষের স্বার্থের অধিকার। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে এই শাটডাউন সংবাদটি পাঠকদের কাউকে কাউকে বেশ ধোঁয়াশায় ফেলেছে। আমাকে দেশ থেকে এক বন্ধু টেলিফোনে বললেন, এরকম শাটডাউন কেন এবং আমেরিকায় আগে কি কখনও ঘটেছে? তাছাড়া দুই দলের মধ্যে এ বিষয়ে কোন সমঝোতা না হলে কি ঘটতে যাচ্ছে সামনে? এরকম ধারণা আরও কয়েকজনের কথাতেও ছায়া ফেলল। তাদের আগ্রহের জবাবে জানাইÑযুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যখন ফেডারেল গবর্নমেন্ট অপারেশন ও এজেন্সির ফান্ডিংয়ের জন্য বাজেটটি পাস করতে কংগ্রেস ব্যর্থ হয় অথবা প্রেসিডেন্ট স্বাক্ষর করতে ব্যর্থ হন তখনই এমন ঘটনা ঘটে থাকে। সর্বপ্রথম রোনাল্ড রিগ্যানের আমলে ১৯৭৬ সালে শাটডাউন ঘটেছিল একদিনেরও কম সময়ের জন্য। কিন্তু ১৯৯০ সাল থেকে বিষয়টি যেন প্র্যাকটিসে পরিণত হয়েছে। ’৯০ সালে জর্জ বুশের আমলে যেটা দাঁড়ায় একটি উইকেন্ডে এবং বিল ক্লিনটনের আমলে ’৯৫-৯৬ সালে ৫ দিন এবং ২১ দিনের জন্য। বারাক ওবামার আমলে ওবামা কেয়ার নিয়ে শাটডাউন হয়েছিল ১৬ দিন। জানানো ভাল, এর ফলে ফেডারেল সরকারের ৮ লাখ কর্মচারী-কর্মকর্তার বেতন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার মধ্যরাতের পর থেকে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ৯৯ মিলিয়ন ডলার। প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলে ২০১৩ সালে যে ক্ষতি ছিল এক দশমিক পাঁচ মিলিয়ন ডলার। উল্লেখ, ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রক্রিয়ায় এ পর্যন্ত ১৯ বার শাটডাউন হয়েছে আমেরিকা। চলতি সময়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে শাটডাউন ঘটার কেন্দ্রে রয়েছে ইমিগ্র্যান্টদের বৈধকরণ ও মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলার বিষয়। ডেমোক্র্যাটরা দাবি তুলেছে আমেরিকান ড্রিমারদের এই দেশে বৈধ করা হোক। কেউ এ বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারেনÑ আমেরিকায় বৈধ-অবৈধ ব্যাপারটি তো আছেই কিন্তু কারা এই ড্রিমার? উত্তরে বলা যায়Ñ এরা হচ্ছে তারাই যারা অবৈধভাবে আগত পিতা-মাতার সঙ্গে শিশুবয়সে একদিন আমেরিকায় প্রবেশ করেছিল এবং বর্তমানে ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তাদেরই বলা হয় আমেরিকান ড্রিমার। ডেমোক্র্যাটরা দাবি তুলেছে তাদের বৈধতা দিতে আইন পাস করতে হবে। অন্যদিকে রিপাবলিকানরা দাবি তুলেছে আমেরিকার দক্ষিণে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলা এবং ৯ মিলিয়ন শিশুর স্বাস্থ্য বীমার জন্য অর্থ বরাদ্দ । সমালোচকরা বলছেন, সাম্প্রতিক এই বাজেট পাসে বাধার মূল গেরোটাই হলো উভয় দলের ব্লেম রাজনীতি-পারস্পরিক দোষারোপ জিইয়ে রাখার তাগিদ। এর নেপথ্যে যথারীতি রয়েছে চলতি বছরের নবেম্বর মাসে অনুষ্ঠিতব্য মিড টার্ম ইলেকশন। এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কংগ্রেসের উভয় কক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে স্ব-স্ব দলের নিয়ন্ত্রণে রাখার বাসনাটি। সামনের ভোটাভুটিতে দু’দলই এবার বাজাবে একই বাজনা যে, তাদের অপরপক্ষ আন্তরিক সহযোগিতা না করার কারণে তাদের পক্ষে কোন কাজ করা সম্ভব হলো না। জনগণকে তারা আরও বোঝাবে, এই কারণেই তাদের নিজ দলকে ভোট দিয়ে বসাতে হবে মেজরিটি আসনে। যাই হোক, সব শেষে প্রেসিডেন্ট স্বয়ং বললেন আমেরিকান ড্রিমারদের বিষয়ে তিনি ডেমোক্র্যাটদের দাবি মেনে নিচ্ছেন এবং এর ফলে বৈধতা পাবে ১.৮ মিলিয়ন স্বপ্নদ্রষ্টা তরুণ-তরুণী। কিন্তু বিপরীতে মেক্সিকো দক্ষিণ সীমান্তে দেয়াল নির্মাণে তাদের দাবিটিকেও তাদের মেনে নিতে তবে এর বিপরীতে কোন ইমিগ্র্যান্ট তাদের ভাই-বোন, পিতা-মাতাকে এদেশে আনতে পারবেন না। ইমিগ্রেশন লটারিও বন্ধ করে দিতে হবে। মার্কিন দক্ষিণ সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের জন্য ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার বাজেটে রাখার দাবি রিপাবলিকানদের। সমঝোতার ফলাফল ইতিবাচক বা যেটি বাচক যাই হোক না কেন সেটি জানা যাবে কংগ্রেসের মাধ্যমে। আজকের লেখাটি শেষ করতে গিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট ডেভিড ব্রুকসের উক্তিটি উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না- ‘বর্তমানে আমেরিকান রাজনীতি চলছে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিভক্তির রাজনীতি। যদি কোন ডেমোক্র্যাটকে প্রশ্ন করা হয়, রিপাবলিকান পার্টি সম্পর্কে তুমি কি ধারণা পোষণ কর? সে উত্তরে বলবে তাদের ভেতরে কোন নৈতিকতা নেই, ওরা অলস, স্টুপিড এবং সঙ্কীর্ণ মনমানসিকতার অধিকারী। আবার একই প্রশ্ন যদি অন্য একজন রিপাবলিকানকে করা হয় সে উত্তরে যা বলবে সেটাও হুবহু একই। তাদের ভেতরে কোন নৈতিকতা নেই, ওরা অলস. স্টুপিড এবং সঙ্কীর্ণ মনমানসিকতার অধিকারী ইত্যাদি ...। আরেকটি মজার কথা বলেছেন ব্রুকসÑ ‘১৯৬০ সালে যদি তাদের জিজ্ঞেস করা হতো তোমার মতাদর্শের বিরোধী রাজনৈতিক দলের কারও পুত্র বা কন্যার সঙ্গে যদি তোমার পুত্র-কন্যার বিবাহ হয় তবে তুমি কি আপত্তি করবে? তার উত্তরে ৫% ভাগ আমেরিকান হ্যা সূচক জবাব দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই উত্তর ৪০% আমেরিকাবাসীর। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক [email protected]
×