ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা-স্থানীয় বিরোধ, ৩০ জানুয়ারি ধর্মঘটের ডাক ॥ যুক্তরাষ্ট্র পাশে থাকবে

প্রত্যাবাসন থমকে যাওয়ায় সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮

প্রত্যাবাসন থমকে যাওয়ায় সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ সমঝোতা স্মারক ও দুদেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরও নির্ধারিত ২৩ জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় দেশ-বিদেশে নানা আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনা সৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার বিষয় হচ্ছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে থাকলে যে কোন মুহূর্তে উখিয়া টেকনাফের স্থানীয়দের সঙ্গে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে। এমনকি তা রক্তক্ষয়ীও হতে পারে বলে স্থানীয়দের মাঝে ধারণা হয়েছে। আগামী ৩০ জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে দাবি আদায়ে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে। অপরদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, দু’বছরের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করা যাবে। বুধবার তিনি এ ইস্যুতে বলেছেন, সমস্যা বহুবিধ। তবুও চেষ্টা চলছে। সরকার মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বলে তিনি আবারও উল্লেখ করেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিদিন ৩শ’ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করা হবে। সে হিসাবে সপ্তাহের ৫ কর্মদিবসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসিত হবে ১৫শ’। এভাবে চলতে থাকলে তা কয় বছর গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে উখিয়া টেকনাফ অঞ্চলে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও আগেই বলা হয়েছে, প্রতিসপ্তাহে ১৫শ’র স্থলে অধিকসংখ্যক রোহিঙ্গাও প্রত্যাবাসিত হবে। কিন্তু প্রত্যাবাসন প্রশ্নে মিয়ানমার এখনও যে নীতি অবলম্বন করে চলেছে তা রোহিঙ্গাদের পক্ষে নয়। আর এ কারণে রোহিঙ্গারা দলে দলে আওয়াজ তুলছে তারা ফিরে যাবে না। এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বের দিকে ধাবিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের একটি প্রতিনিধি দল এটি স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু আশিয়ান পার্লামেন্টিরিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের পক্ষে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সমস্যাটি গোটা আশিয়ানের সঙ্কট। এ সঙ্কটে মানব পাচার থেকে শুরু করে নিরাপত্তা হুমকির সমস্যাসহ নানা সমস্যায় এ অঞ্চলের আশপাশের সব এলাকায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। যা গোটা আশিয়ান অঞ্চলের জন্য হুমকি ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২৩ জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বড় ধরনের হোঁচট খাওয়ার পর বুধবার উখিয়া টেকনাফ অঞ্চলে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলোতে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে এই বলে যে, মূলত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার নেবে না।আর ফেরত নেয়ার কথা যতই বলুক রোহিঙ্গারা যাবে না। এ দুটি বাক্য নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে উখিয়া-টেকনাফ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও। মঙ্গলবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ার বিষয়ে সাধারণ লোকজন বিভিন্নজনের কাছে গিয়ে আগ্রহসহকারে জানতে চাইছে কেন রোহিঙ্গা ফেরত কার্যক্রম শুরু হলো না। এ নিয়ে প্রচ- ক্ষোভ স্থানীয়দের মাঝে দানা বেঁধেছে। মঙ্গলবার বিকেলে উখিয়া স্টেশন চত্বরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা ও এনজিওদের দুর্নীতি ও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কাজে বাধাপ্রদানকারী এনজিওর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশও করেছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি। আগামী ৩০ জানুয়ারি স্থানীয়দের দাবি দাওয়া পূরণের দাবিতে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের সম্মুখে অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। কক্সবাজারের আরআরআরসি কর্মকর্তা আবুল কালাম জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য দ্রুত কাজ চলছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত প্রদানের লক্ষ্যে পাঁচটি সীমান্ত পয়েন্টে ট্রানজিট ক্যাম্প তৈরির স্থানও নির্ধারণ হয়েছে। এদিকে প্রত্যাবাসন বিরোধী বেশকিছু রোহিঙ্গা ৬ দফা দাবি আদায়ের জন্য ক্যাম্পে বিক্ষোভ করে চলছে। প্রশাসন এসব নিয়ন্ত্রণ রাখতে তৎপর রয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ১৯৯২সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সময় নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত পয়েন্টে অর্থাৎ ওপারের লেফ্ট তুমব্রু এলাকায় একটি এবং টেকনাফের কেরুনতলী সীমান্ত পয়েন্টে একটিসহ মোট দুটি পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম হয়েছিল। পৌনে ১১ লাখ রোহিঙ্গা নিবন্ধিত ॥ টেকনাফ ও উখিয়ার ১২ অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রিত ১০ লাখ ৭৫ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। নতুন ও পুরনো মিলে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা ওসব ক্যাম্পে অবস্থান করছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এছাড়াও প্রতিদিন বিচ্ছিন্নভাবে আরও রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু না হলে অচিরেই রাখাইন রাজ্যের উত্তর অঞ্চল স¤পূর্ণ রোহিঙ্গা শূন্য হয়ে পড়বে বলে জানিয়েছেন সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার অধিবাসীরা। দুই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক ॥ র‌্যাব অভিযান চালিয়ে প্রত্যাবাসন বিরোধী দুই রোহিঙ্গাকে কিরিচসহ আটক করেছে। বুধবার মধ্য রাতে বালুখালী ক্যাম্প থেকে তাদের আটক করা হয়। ধৃত সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা যুবকদ্বয় তাজনিমার খোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সম্প্রতি হত্যাকা-ের শিকার হওয়া শেড মাঝি মোহাম্মদ ইউসুফ হত্যায় জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। পাসপোর্ট পেতে মরিয়া রোহিঙ্গারা ॥ রোহিঙ্গাদের হাতে যেন পাসপোর্ট না যায় এ বিষয়ে সরকার কঠোর হলেও নিজ দেশে মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে ধারণায় রোহিঙ্গারা গোপনে পাসপোর্ট হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কাজে এক শ্রেণীর দালাল ও কতিপয় ইউপি চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্রও পাচ্ছে রোহিঙ্গারা। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ১৩টি পাসপোর্ট শনাক্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ॥ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সিনিটের একটি প্রতিনিধি দল। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও অনুরূপ সমর্থন জানিয়েছে। গত মঙ্গলবার সিনেট প্রতিনিধিদলের সামনে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করে যুক্তরাষ্ট্রের সংসদীয় অনুসন্ধান দল। তারা গত নবেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের পর রিপোর্ট আকারে এ প্রস্তাব পেশ করে। রিপোর্টে বিস্তারিত তুলে ধরার পর আশা করা হয় মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এজন্য মিয়ানমারের বহু করণীয় আছে।
×