ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফখরুদ্দীন মঈনুদ্দিনরা এখন কে কোথায়?

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

ফখরুদ্দীন মঈনুদ্দিনরা এখন কে কোথায়?

শংকর কুমার দে ॥ আজ থেকে ১১ বছর আগে ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে ঘটানো হয়েছিল বহুল আলোচিত- সমালোচিত ‘ওয়ান ইলেভেন’। ওয়ান ইলেভেনের নায়করা এখন কে কোথায় কি করছেন সেই বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থা। ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবদের অন্যতম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান লেঃ জেনারেল মঈন উ আহমেদ, ব্রিগেডিয়ার (চাকরিচ্যুত) এটিএম আমিন, ব্রিগেডিয়ার ফজলুল বারী। সেই ওয়ান ইলেভেনের নায়করা এখন কে কোথায় কেমন আছেন? জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির উপ-কমিটি চিঠি দিয়ে ডেকেছিলেন ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবদের। কারও কাছেই কমিটির চিঠি পৌঁছায়নি। চার কুশীলবের তিন জন আমেরিকায় এবং একজন মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে আছেন বলে জানা যায়। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব ছেড়ে দেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। আর প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। তৎকালীন সেনা কর্মকর্তাদের সমর্থনে ওই নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য এই সরকারকে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা হয়। ২০০৬ সালের ২৮ নবেম্বর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। কিন্তু শুরু থেকেই এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ জোর আপত্তি জানায়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকলে সরকারের উপদেষ্টারা একে একে পদত্যাগ করতে থাকেন। এরই মধ্যে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হলে আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। এক পর্যায়ে সেনাসমর্থনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশে ব্যাপক গণ আন্দোলনের সৃষ্টি হলে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় দেশে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দিয়ে জরুরী অবস্থা জারি করেন। তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদ জরুরী অবস্থা জারির পর থেকে সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বহুল আলোচিত ফখরুদ্দীন আহমদের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আভির্ভাব সেদিন। দেশের দুই নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপার্সন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের পর কারাগারে বন্দী করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নীল নক্সা তৈরি হয়। দুই নেত্রীর দুই দলের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাইকেই গ্রেফতার করা হয়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব ছেড়ে দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। আর প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। তৎকালীন সেনা কর্মকর্তাদের সমর্থনে ওই নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এজন্য এই সরকারকে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা হয়। তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদই এক অনুষ্ঠানে ১১ জানুয়ারির জরুরী অবস্থা জারির দিনটিকে ওয়ান-ইলেভেন বা এক-এগারো নামে আখ্যায়িত করেন। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, ওয়ান ইলাভেনের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে সেনা সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ ও পরবর্তীতে দেশব্যাপী উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির উপ-কমিটির সামনে ডাকা হয়েছিল ওয়ান ইলেভেনের নায়কদের। ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ব্রিগেডিয়ার (চাকরিচ্যুত) আমিন ও ব্রিগেডিয়ার (চাকরিচ্যুত) বারী দুই জনেই সেনা বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের পরিচালক পদে চাকরিরত ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে যেসব রাজনীতিক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন, অর্থ আদায় করা হতো তার নেপথ্য কুশীলব ছিলেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক এই দুই পরিচালক। ডিজিএফআইয়ের সাবেক দুই পরিচালককে কমিটির সামনে ডাকা হলেও তারা উপস্থিত হননি। অপরদিকে ড. ফখরুদ্দীন আহমদ ও মঈন উ আহমেদকে কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে তাদের বক্তব্য প্রদানের জন্য দিন ধার্য করা হলেও তারা উপস্থিত হননি। গোয়েন্দা সংস্থার নথি থেকে জানা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ দেশ ত্যাগের পর আমেরিকায় বিশ্বব্যাংকের অধীনে চাকরি নেন। সাবেক সেনা প্রধান মঈন উ আহমেদ আমেরিকায় তার নিকটাত্মীয়ের বাসায় অবস্থান করছেন। তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। অপরদিকে ব্রিগেডিয়ার (চাকরিচ্যুত) এটিএম আমিন ও ব্রিগেডিয়ার (চাকরিচ্যুত) ফজলুল বারীকে ইতোমধ্যেই কমিটির সামনে উপস্থিত হওয়ার দিনক্ষণ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। তারা কমিটির সামনে উপস্থিত হননি। এটিএম আমিন কোথায় অবস্থান করছেন তার খোঁজ পাওয়া না গেলেও মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে অবস্থান করছেন বলে জানতে পারেন গোয়েন্দা সংস্থা। ফজলুল বারী পলাতক অবস্থায় নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন বলে জানা গেছে। পলাতক থাকায় কমিটির ডাকে সাড়া দেননি তিনি। পলাতক অবস্থায় তিনি এখন কোথায় কেমন আছেন, কি করছেন সেই সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর খবর পাওয়া গেছে। ওয়ান ইলেভেনের সময়ে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষজনকে সেনা সদর দফতরে অবস্থিত ডিজিএফআই অফিসে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক কোটি কোটি টাকা আদায় করে সেই টাকা আমেরিকায় পাচার করে এখন সেখানে রমরমা পিৎজা ব্যবসা করছেন ফজলুল বারী। ‘ডমোনিজ পিৎজা স্টোর’ নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব কিনে নিয়ে এই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটি এখন সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রের তৎপরতার আখড়ায় পরিণত করেছেন ফজলুল বারী। নিউইয়র্কে অবস্থানরত সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এই খবর জানা গেছে। নিউয়র্কের লং আইল্যান্ডের ভেলিস্ট্রিম শহরের ‘ডমোনিজ পিৎজা স্টোর’ নামক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব কিনে ব্যবসা করছেন ফজলুল বারী। সিলেটের বিরানী বাজারের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ডমোনিজ পিৎজা স্টোরটির মালিকানার অংশীদারিত্ব কিনে নিয়ে তার সঙ্গে ব্যবসা করছেন। কোন বাংলাদেশী এই পিৎজা স্টোরে গেলে বারী নিজেই খবার দাবার পরিবেশন করে নিজেকে ডেলিভারিম্যান পরিচয় দিয়ে অতীত কুকর্মকা- ধামাচাপা দিচ্ছেন। ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের প্রভাবশালী পরিচালক ছিলেন ফজলুল বারী। ধনাঢ্য ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষজনকে তখন তিনি সেনা সদর দফতরের ডিজিএফআইয়ের অফিসে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক কোটি কোটি টাকা আদায় করে আমেরিকায় পাচার করে দেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিস্থ বাংলাদেশে দূতাবাসের সামরিক এ্যাটাচির চাকরি নিয়ে কৌশলে দেশ থেকে কেটে পড়েন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে দেশে ফিরে আসার জন্য নির্দেশ দিলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আত্মগোপন করেন। সম্প্রতি তিনি নিউইয়র্কস্থ বিএনপির সাবেক এক এমপির মালিকানাধীন সাপ্তাহিক পত্রিকায় সাক্ষাতকার দিয়ে তার তৎপরতার বিষয়টি আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। বারী বর্তমানে নিউইয়র্কের কুইন্স এলাকার ফ্লেশমেডেতে বসবাস করছেন। জ্যাকসন হাইটস এলাকায় তাকে ঘুরাফেরা করতেও দেখা যায়। বারী যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ স্ট্যাটাস নিয়ে বসবাসের জন্য চেষ্টা করছেন। আমেরিকার বিএনপি-জামায়াত পন্থী কিছু রাজনীতিক, যুদ্ধাপরাধীর আত্মীয়স্বজন, বঙ্গবন্ধুর খুনী চক্রের সদস্যরা তাকে সহায়তা করে যাচ্ছে। এ কারণে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তাকে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও দেশে ফিরে না এসে আমেরিকায় বসে দেশের ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতায় লিপ্ত আছেন ফজলুল বারী। ফজলুল বারীর আমেরিকায় বসে ষড়যন্ত্র করার তৎপরতার বিষয়টি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু হওয়ার পর ফাঁস হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পরিবারের নিকটাত্মীয় শেখ ফজলুল হক মনির পুত্র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের ওপর বোমা হামলার ঘটনার তার জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ পায় তদন্তে। বঙ্গবন্ধু হত্যার মৃত্যুদ- সাজাপ্রাপ্ত খুনী কর্নেল (চাকরিচ্যুত) আবদুর রশীদের মেয়ে মেহনাজকে ঢাকা মহানগর পুলিশ গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বারী সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। বিএনপি-জামায়াতপন্থী সামরিক বাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্যদের দিয়ে এই বোমা হামলা করানো হয়। ফজলুল বারী আমেরিকায় বসে ষড়যন্ত্র করে তার নির্দেশ মোতাবেক এই বোমা হামলা করানো হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারে গোয়েন্দা সংস্থা। ওয়ান ইলেভেনের সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বারী ডিজিএফআইয়ের পরিচালক থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর খুনী মৃত্যুদ- সাজাপ্রাপ্ত কর্নেল (চাকরিচ্যুত) আবদুর রশীদের কন্যা মেহনাজের মাধ্যমে বিদেশে পলাতক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। দেশে জঙ্গী সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে জঙ্গীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন তিনি। মেহনাজের সঙ্গে এসব বিষয়ে শলাপরামর্শ করার সুবাদে তার সঙ্গে গড়ে ওঠে পরকীয়া সম্পর্ক। পরকীয়া সম্পর্কের এক পর্যায়ে মেহনাজকে বিয়ে করেন ফজলুল বারী। আমেরিকায় আত্মগোপনরত অবস্থায়ও বারী মেহনাজের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। ফজলুল বারী বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থান করে বঙ্গবন্ধুর খুনী চক্র ও যুদ্ধাপরাধীদের আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা চালানোর খবর পাওয়া গেছে।
×