ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিমান বাহিনীর প্যারেড

জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে ॥ শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ১ জানুয়ারি ২০১৮

জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে ॥ শেখ হাসিনা

ফিরোজ মান্না, যশোর থেকে ফিরে ॥ দেশের সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতির জন্য একটি আধুনিক বিমান বাহিনী অপরিহার্য। যারা দেশপ্রেমের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে দেশের মানুষের কল্যাণে সদা নিয়োজিত থাকবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্ভোগে জনগনের পাশে থাকাই হবে তাদের পবিত্র দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে আমাদের এই দেশ। এত রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের। আজ যারা কমিশন লাভ করেছ তারাও এই দায়িত্বের অংশীদার হলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার দুপুরে যশোর বিমান বাহিনী একাডেমিতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ৭৪তম বাফা কোর্স ও ডিরেক্ট এন্ট্রি ২০১৭ কোর্সের কমিশন উপলক্ষে আয়োজিত রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজ-২০১৭ (শীতকালীন) অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে একটি অত্যাধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে তার সরকার দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। বিমান বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিতে শীঘ্রই দেশে আরও দুটি বিমান ঘাঁটি গড়ে তোলা হবে। বরিশাল ও সিলেটে এ দু’টি ঘাঁটি করার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ দুটি ঘাঁটি হলে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী আরও শক্তিশালী হবে ও সক্ষমতা বাড়বে। ‘বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত দিক থেকে অচিরেই জাতির পিতার কাক্সিক্ষত অত্যাধুনিক, পেশাদার ও চৌকস বিমান বাহিনী হিসেবে দেশে এবং বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।’ সম্প্রতি বিমান বাহিনীতে সংযোজিত কে-এইট ডব্লিউ জেট ট্র্র্রেনার, ওয়াই এ কে-১৩০ কমব্যাট ট্রেনার এবং এল-৪১০ ট্রান্সপোর্ট ট্রেনার এই বাহিনীর উড্ডয়ন প্রশিক্ষণকে আরও উন্নত ও সমৃদ্ধ করেছে। বিমান বাহিনী একাডেমির পুনর্গঠিত সাংগঠনিক কাঠামোরও অনুমোদন দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজে বাফা কোর্সের ৬৮ জন ফ্লাইট ক্যাডেট ও ডিরেক্ট এন্ট্রি কোর্সের ১১ জন সদস্য কমিশন লাভ করেছেন। এর মধ্যে ১৩ জন মহিলা ক্যাডেটও কমিশন প্রাপ্ত হন। ফ্লাইট ক্যাডেট মির্জা জুবায়ের হোসেন ৭৪তম ফ্লাইট ক্যাডেট কোর্সে সেরা চৌকস কৃতিত্বের জন্য ‘সোর্ড অব অনার’ ও ফ্লাইট ক্যাডেট শাহরিয়ার তানজীম জেনারেল সার্ভিস প্রশিক্ষণ কৃতিত্বের জন্য ‘কমান্ডান্টস ট্রফি’ লাভ করেন। উড্ডয়ন প্রশিক্ষণে সেরা কৃতিত্বের জন্য ফ্লাইট ক্যাডেট মির্জা জুবায়ের হোসেন ‘বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ট্রফি’ অর্জন করেছেন। গ্রাউন্ড ব্রাঞ্চে সেরা কৃতিত্ব অর্জন করেছেন ফ্লাইট ক্যাডেট এফ এম শহীদুল ইসলাম সুজন। তিনি ‘বিমান বাহিনী প্রধান’ ট্রফি লাভ করেছেন। এছাড়া বিমান বাহিনী একাডেমির এক নং স্কোয়াড্রন চ্যাম্পিয়ান বিবেচিত হয়ে একাডেমি পতাকা লাভ করেছে। প্রধানমন্ত্রী প্যারেড গ্রাউন্ডে আসার আগে ’৭৪ সালে বিএমএতে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ক্যাডেটদের উদ্দেশে বাজিয়ে শোনানো হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌঁছলে বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল আবু এসরার ও বিমান বাহিনীর একাডেমির কমান্ড্যান্ট এয়ার কমডোর এ এস এম ফখরুল ইসলাম তাঁকে স্বাগত জানান। বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্য, সেনা ও নৌবাহিনী প্রধান, বিদেশী কুটনীতির, উচ্চ পর্যায়ের সামরিক বেসামরিক কর্মকতাসহ কমিশন প্রাপ্তদের বাবা মা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বিমান বাহিনীর পাসিং আউট ক্যাডেটদের মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন ও একটি খোলা জীপে করে প্যারেড পরিদর্শন করেন। তিনি অনুষ্ঠানে ক্যাডেটদের মধ্যে ট্রফি, সার্টিফিকেট এবং ফ্লাইং ব্যাজ বিতরণ করেন। ফ্লাইট ক্যাডেট একাডেমি আন্ডার অফিসার আহম্মেদ মুসা কমান্ড্যান্ট হিসেবে প্যারেড পরিচালনা করেন। পরে বিমান বাহিনী এয়ারক্র্যাফটের মনোজ্ঞ ফ্লাইপাস্টও প্রত্যক্ষ করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বিমান বাহিনী ক্যাডেটদের দেশ ও জাতির আকাক্সক্ষা পূরণে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিমান বাহিনী একাডেমি থেকে যে মৌলিক প্রশিক্ষণ তোমরা গ্রহণ করেছ কর্মজীবনে তার যথাযথ অনুশীলন ও প্রয়োগের জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকবে। সততা, একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তোমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে। তোমরা নিজেদের এমনভাবে গড়ে তুলবে, যাতে তোমরা দেশ ও জাতির আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পার। প্রশিক্ষণ শেষ করার পর আজ থেকে শুরু হচ্ছে তোমাদের বৃহত্তর কর্মজীবন। প্রিয় মাতৃভূমি রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালনে আজ থেকে তোমরাও অংশীদার। আমি আশাকরি, দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এবং পবিত্র সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তোমরা বাংলার আকাশ মুক্ত রাখার দৃঢ় অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সঙ্কল্পবদ্ধ থাকবে। শেখ হাসিনা বলেন, ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা অর্জনে ক্যাডেটদের সর্বদা সচেষ্ট থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, মনে রাখবে, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছি। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তোমরা এ দেশেরই সন্তান। নিজেদের কখনোই সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন ভাববে না। তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সব সময় চেষ্টা করবে। তার সরকারের সময়ে বিমান বাহিনীর অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরেন। বিমান বাহিনী একাডেমির জন্য আন্তর্জাতিক মানের ‘বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স’ নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এই কমপ্লেক্সের কাজ শেষ হলে বিমান বাহিনী একাডেমির কর্মপরিধি বৃদ্ধিসহ প্রশিক্ষণের মান আরও বাড়বে। তাছাড়াও এই একাডেমির প্রশিক্ষণ আধুনিকায়ন ও ভবিষ্যত চাহিদা মেটানোর জন্য নতুন স্থাপনা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তার সরকার সচেষ্ট রয়েছে উল্লেখ করেন, এসব উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একাডেমি শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সুনাম বয়ে আনতে সক্ষম হবে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মাত্র তিনটি বিমান নিয়ে যে বাহিনীর জন্ম, সে বাহিনী আজ অত্যাধুনিক বিমান, আকাশ প্রতিরক্ষা রাডার, ক্ষেপণাস্ত্র, এমনকি বিমান রক্ষণাবেক্ষণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ। দেশের পররাষ্ট্র নীতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- বঙ্গবন্ধু প্রণীত এই নীতির আলোকে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। আর্থ-সামাজিক খাতে আমরা দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন করেছি। এই অর্জনকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই। এখন আর কেউ আমাদের অবজ্ঞার চোখে দেখে না, আমাদের এখন বিশ্ব সম্মানের দৃষ্টিতেই দেখে। ইনশাআল্লাহ, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। প্রধানমন্ত্রী পাসিং আউট ক্যাডেটদের উদ্দেশে বলেন, এই মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজে পুরুষদের পাশাপাশি নারী ক্যাডেটদের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণে আমি সত্যিই আনন্দিত ও গর্বিত। তাদের এই কমিশন প্রাপ্তি বর্তমান সরকারের নারীর ক্ষমতায়নের দৃঢ় নীতিরই প্রতিফলন। আমরা বিশ্বাস করি জাতীয় অগ্রগতিতে নারীর অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এজন্য সশস্ত্র বাহিনীতেও নারীদের ব্যাপকহারে অংশগ্রহণের বিষয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী স্বাধীন দেশের মান উপযোগী একটি বিমান বাহিনী গড়ে তুলতে জাতির পিতার উদ্যোগের কথা স্মরণ করে বলেন, স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি শক্তিশালী এবং প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার জন্য জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করেন। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও সামরিক কৌশলগত দিক বিবেচনায় রেখে তিনি একটি আধুনিক বিমান বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে সে সময়কার অত্যাধুনিক মিগ-২১ জঙ্গী বিমান, এমআই-৮ হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রন, এএন-২৪ পরিবহন বিমান এবং রাডার বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে সংযোজন করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫-এ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৯৬ সালে আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নে কেউ কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আমরা বিমান বাহিনীকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করার কার্যক্রম হাতে নিই। আমরা ২০০০ সালে বিমান বাহিনীতে চতুর্থ প্রজন্মের অত্যাধুনিক মিগ-২৯ জঙ্গী বিমান, বড় পরিসরের সি-১৩০ পরিবহন বিমান এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন আকাশ প্রতিরক্ষা রাডার সংযোজন করি। ২০০০ সালে আমরাই সর্বপ্রথম সশস্ত্র বাহিনীতে নারীদের কমিশন্ড অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া শুরু করি। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী সদস্যদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি দেশ ও জাতির যেকোন প্রয়োজনে ভূমিকা রাখতে সদা প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ-বিদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা, উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে আমাদের বিমান বাহিনী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর তাৎপর্যপূর্ণ অবদান বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন এবং স্বাধীনতার পর দেশ ও জাতির কল্যাণে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এবছর বিমান বাহিনী স্বাধীনতা পদক পেয়েছে। বিমান বাহিনী দেশের এ সর্বোচ্চ পদক অর্জন করায় তিনি বিমান বাহিনীর সকল সদস্যের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন জানান। রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজ- ২০১৭-এ ৭৪তম বাফা কোর্সের ৬৮ জন ফ্লাইট ক্যাডেট এবং ডিরেক্ট এন্ট্রি ২০১৭ কোর্সের ১১ জনসহ মোট ৭৯ জন কমিশন লাভ করেছেন। এদের মধ্যে ১৩ জন মহিলা ক্যাডেটও কমিশন লাভ করেন। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে নৌবাহিনীর দু’জন পাইলট এবং বিমান বাহিনীর দু’জন মহিলা পাইলটকে ফ্লাইং ব্যাজ পরিয়ে দেন।
×