ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বছরের আলোচিত রোহিঙ্গা ইস্যু দেশের গ-ি পেরিয়ে বিশ্বময়

প্রকাশিত: ০৬:২১, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

বছরের আলোচিত রোহিঙ্গা ইস্যু দেশের গ-ি পেরিয়ে বিশ্বময়

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ থার্টি ফাস্ট নাইটে প্রতিবছর দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক আসেন কক্সবাজারে। নতুন বর্ষবরণ ও পুরনো বর্ষকে বিদায় জানাতে সমবেত হয় সমুদ্র তটে। তবে এবার ওই আনন্দের চেয়ে বেশি আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যু। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের পর্যটন নগরী কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আলাদাভাবে উঠে আসে বিশ্বময়। নতুন পুরনো মিলে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে মানবতার এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কক্সবাজারবাসী। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে বিশ্বের চোখ ছিল কক্সবাজারের। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে সামাল দিতে পারে কি-না, সরকারের জন্য তা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কক্সবাজারের ডিসি আলী হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা প্রবেশের বিষয়টা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তা আমরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছি। এখনও আমরা তা সামাল দিচ্ছি। পালিয়ে আসা এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ঠাঁই দিতে হিমশিম খেতে হয় বাংলাদেশকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিয়ে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে তা সামাল দিতে সক্ষম হয়েছেন। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা অভুক্ত রোহিঙ্গাদের তাৎক্ষণিক খাবার সরবরাহ করেছে সরকার। পাশাপাশি জরুরী মেডিক্যাল টিম গঠন করে অসুস্থ নারী-পুরুষ ও শিশুদের প্রদান করেছে চিকিৎসা সেবা। এদের অনেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধসহ নানাভাবে আহত ছিল। গুলিবিদ্ধ ওই রোহিঙ্গাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালে। এমন হৃদয়বিদারক মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলে আসেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তাঁর আহ্বানে বাংলাদেশের মানুষ শুধু ঠাঁই দিয়ে মানবতার দায়িত্ব শেষ করেনি। শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সাহায্য সংস্থাগুলো তাৎক্ষণিক সহযোগিতা দিতে না পরলেও বিপন্ন-বিপর্যস্ত রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে সাহায্য সহায়তায় এগিয়ে আসে তারা। মানবতাপ্রেমীরা রোহিঙ্গাদের সহায়তায় টন টন খাদ্য নিয়ে ছুটে আসে। বিপদে বন্ধুর পরিচয় দেয়া বাংলাদেশের মানুষ। সরকারের পাশাপাশি তাদের দেয়া ওইসব ত্রাণ সহায়তাই বিপন্ন রোহিঙ্গাদের প্রাণ বাঁচিয়েছে। পরে অবশ্য জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সাহায্য সংস্থা সহায়তা শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ ও ব্যবসায়ী মহল এগিয়ে আসে রোহিঙ্গাদের পাশে। বাংলাদেশের এই মানবিকতা বিশ্বজুুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। নিষ্ঠুর নির্যাতনের মুখে নিজভূমি থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখতে বাংলাদেশে আসেন তুরস্কের ফার্স্টলেডি ও জর্দানের রানী জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিরা। দেখতে এসে তুরস্কের ফার্স্টলেডি এমিনি এরদোগান রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও পুরুষের প্রতি সহানুভূতি ও সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জানান। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে এসে জর্ডানের রানী রানিয়া আল আব্দুল্লাহ আশ্রিত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের অবস্থা দেখেন এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে তিনিও বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানান। সর্বশেষ ডিসেম্বরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম। সেখানে তিনি তুর্কি সরকারের পক্ষে একটি মেডিক্যাল ক্যাম্প উদ্বোধন করেন এবং একটি এ্যাম্বুলেন্স হস্তান্তর এবং তুর্কি রেড ক্রিসেন্টের পক্ষে রান্না করা খাবার ও নন ফুড আইটেম বিতরণ করেন রোহিঙ্গাদের মাঝে। গত ২৫ আগস্ট ভোর রাতে রাখাইন রাজ্যের মংডুতে এক সন্ত্রাসী ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ-সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, নারীদের গণধর্ষণসহ নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়। এমনকি শিশুদের পর্যন্ত নির্মম কায়দায় নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে রোহিঙ্গারা বানের স্রোতের মতো বাংলাদেশে দিকে ধেয়ে আসে। উখিয়ার পালংখালী, রহমতের বিল, বালুখালী, নাইক্ষ্যংছড়ি সদর, ঘুমধুম, তুমব্র, টেকনাফের হোয়াইক্যং, উনচিপ্রাং, হ্নীলা, নাই্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, হারিয়াখালী, শামলাপুর ও শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত পয়েন্ট বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। সেই থেকে রোহিঙ্গা আসা এখনও পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। মানবতার স্বার্থে টেকনাফ ও উখিয়ার প্রায় ছয় হাজার একর বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দেয়া হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, মানবতার স্বার্থে আশ্রয় দেয়া হলেও রোহিঙ্গারা অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা প্রশাসন, গ্রামবাসীর ওপর হামলা, খুন, চুরি-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে বিষিয়ে তুলছে স্থানীয়দের জীবনযাত্রা। তাই রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে দাবী উঠেছে সর্বমহল থেকে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনে প্রায় ৭ হাজার রোহিঙ্গা নির্মম-নৃশংসতার শিকার হয়েছে। ওই গণহত্যার শিকার হয়ে অনেক রোহিঙ্গা হারিয়েছে তাদের মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানসহ পরিবারের অনেক সদস্যকে। মা-বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়েছে অনেক শিশু। স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হয়েছে বহু নারী। নিহতদের মধ্যে পাঁচ বছরের নিচের শিশুরাও রয়েছে। তবে মিয়ানমারের সরকারী কর্মকর্তারা সেনা অভিযানে মাত্র ৪শ’ রোহিঙ্গার প্রাণহানির তথ্য দেয়। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বলে তাদের দাবী। এসবের পেছনে মিয়ানমার দায়ী করছে তাদের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপকে (আরসা)। এদিকে অনুপ্রবেশের পর মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বসে থাকেনি সরকার। তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক আলোচনা অব্যাহত রাখে। বাংলাদেশ সরকারের যুক্তির প্রতি সমর্থন জানিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠে আন্তর্জাতিক মহল। এতে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ে মিয়ানমারের ওপর। পরিশেষে টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে মিয়ানমানার। ২৩ নবেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে এ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অব ডিসপ্লেসড পারসন্স ফ্রম রাখাইন স্টেট শীর্ষক ওই চুক্তি সই করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের দফতরের মন্ত্রী খিও তিন্ত সোয়ে। চুক্তি সই হওয়ার ২ মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন জন্য দু’দেশের মধ্যে ওয়ার্কিং কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সে হিসেবে ২২ জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের একটি দল মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কথা রয়েছে। প্রথমে এক লাখ রোহিঙ্গা ফেরত নেবে বলে জানিয়েছে মিয়ানমার। শুক্রবার মিয়ানমারের কাছে এক লাখ রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করেছে সরকার।
×