ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চৌদ্দ বছরের বিস্ময় বালক আজমাঈন আকমাল

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭

চৌদ্দ বছরের বিস্ময় বালক আজমাঈন আকমাল

আজমাঈন আকমাল। চৌদ্দ বছরের বিস্ময় বালক, দেশের প্রথম মিলিটারি রেসকিউ রোবট বানাচ্ছেন। বগুড়ার কিশোর আকমাল ৩টা আইটি ফার্মের সঙ্গে যুক্ত আর ‘উদ্ভাবকের খোঁজে’ টিভি রিয়েলিটি শোতে টপ টেনে রয়েছে। ডিপ্রজন্ম পাঠকদের জন্য অনুপ্রেরণার গল্প হয়েই থাকবে এই প্রাণবন্ত সাক্ষাতকার। আজমাঈন আকমালের সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন-বেনজির আবরার ডিপ্রজন্ম : আজমাঈন আকমাল সম্পর্কে জানতে চাই? আকমাল : আমি আজমাঈন আকমাল, একজন ১৪ বছর বয়সী কিশোর। বগুড়া জেলা স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। খুব ছোটবেলা থেকেই ভালবাসি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে। আমার প্যাশন একটাই, সেটা হলো উদ্ভাবন। চেষ্টা করি আমাদের সমাজের বিদ্যমান যেসব সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধান করার; উদ্ভাবনের মাধ্যমে। আমি যখন প্রথম শ্রেণীতে পড়ি তখন বাসায় একটা কম্পিউটার কেনা হয়। কম্পিউটার পাওয়ার পরেই এই বাক্সটির প্রতি একটা ভালবাসা জন্মে যায়। কম্পিউটার পাওয়ার ঠিক এক বছর পরই পেয়ে যাই যাদুর হরিণ ইন্টারনেট। কিন্তু কম্পিউটার আর ইন্টারনেট পাওয়ার পর প্রথম যে বিষয়টা মাথায় আসে সেটি হলো, ‘এসব কাজ করছে কিভাবে?।’ আগ্রহ থেকেই শেখা শুরু করি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। শুরুটা ছিল ঝপৎধঃপয চৎড়মৎধসসরহম খধহমঁধমব দিয়ে, তখন পড়তাম তৃতীয় শ্রেণীতে। তারপর শিখি ঈ চৎড়মৎধসসরহম খধহমঁধমব. কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের পাশাপাশি ভাল লেগে যায় রোবটিক্স। শেখা শুরু করি রোবটিক্সের বেসিক বিষয়গুলো। সবকিছু জানতে এবং শিখতে ভালবাসি খুব। ডিপ্রজন্ম : এত কম বয়সে উদ্যোক্তাদের প্লাটফর্মে তুমি, এটা কবে থেকে শুরু? আকমাল : ২০১৬ সালে নিজের একটা ওয়েবসাইট করতে চেয়েছিলাম। কিভাবে ওয়েবসাইট বানাতে হয় খুব একটা জানা ছিল না। এখান থেকেই উদ্যাক্তা হওয়ার গল্পটা শুরু, শেখা শুরু“করি ওয়েবসাইট ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্ট। প্রথমে নিজেই বানিয়ে ফেলি বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট। প্রথমে নিজেই কিছুটা অবাক হয়েছিলাম বটে, তারপর আমার পরিচিত একজন বড় ভাই বললেন তার একটি ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট করে দিতে (কোম্পানির জন্য)। আমি সফলভাবে কাজটি করেছিলাম এবং সেটি ছিল আমার প্রথম অর্থপ্রাপ্তির কাজ। তারপর নিজেই প্রতিষ্ঠা করি একটি আইটি কোম্পানি যেখানে আমি এবং আমাদের বন্ধুরা (সবাই কিশোর এবং আমরা সমবয়সী) মিলে বিভিন্ন ডিজিটাল সার্ভিস দিতে শুরু“করি। এভাবেই শুরু“হয়েছিল একজন উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প। এখন আমার একটি সফল আইটি কোম্পানির পাশাপাশি একটি সফল ওয়েব হোস্টিং কোম্পানিও রয়েছে। এছাড়া নিজের আইটি ফার্মের পাশাপাশি যুক্ত আছি ঙনড়হরষ ওঞ এবং ৯৯উড়ষষধৎডচ এর সঙ্গে। উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পগুলো সবার সঙ্গে বিনিময় করার জন্য গত সেপ্টেম্বর মাসে এষড়পধষ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঞববহ ঈড়হভবৎবহপব এ একজন স্পিকার হিসেবে গিয়েছিলাম নেপালে। এছাড়া আমার নতুন একটি ঝঃধৎঃঁঢ় ইঁংরহবংং ওফবধ নিয়ে অংশ নিয়েছিলাম ঝঃধৎঃঁঢ় ওংঃধহনঁষ– ২০১৭ তে ইস্তাম্বুল এ। ঝঃধৎঃঁঢ় ওংঃধহনঁষ ইউরোপ এবং এশিয়ার বৃহত্তম ঝঃধৎঃঁঢ় ইভেন্ট। ডিপ্রজন্ম : উদ্যোক্তা শব্দটার অর্থ তোমার কাছে কি? আকমাল : আমি বিশ্বাস করি, উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পটা শুরু হয় কোন একটা ছোট্ট আইডিয়া থেকে, নতুন কিছু করার আইডিয়া থেকে। সেটা হতে পারে নতুন কোন উদ্ভাবন, নতুন কোন প্রযুক্তি কিংবা কোন সংগঠন। নতুন কোন আইডিয়া পেলেই আমাদের উচিত সেটাকে বাস্তবায়নের পেছনে শ্রম দেয়া। তবে একজন কিশোর বা টিনেজার যখন একজন উদ্যোক্তা হতে চায় তখন তাকে অনেক রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সামাজিক এবং পারিবারিক সমস্যার মূলেই থাকে পড়াশোনার পাশাপাশি ‘উদ্যোক্তা’ নামক নতুন শব্দের কিছু একটা হতে না দেয়া। ডিপ্রজন্ম : দেশের প্রথম মিলিটারি রেসকিউ রোবট বানাচ্ছো তুমি- এটার সম্পর্কে জানতে চাই আর এটুআই প্রকল্পের সঙ্গে যেভাবে কাজ করছ? আকমাল : ২০১৪ সালের কথা, রাজধানীর একটি উন্মুক্ত অবস্থায় থাকা নলকূপের পাশে খেলতে খেলতে পাইপের ভেতর পড়ে শিশু জিহাদের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি কারণ আমাদের কাছে ছিল না তাকে বাঁচানোর মতো পর্যাপ্ত সরঞ্জাম। ঘটনাটির পর আমার মাথায় আসে একটি রোবটের কথা। রোবটটি ব্যবহার করতে পারব আমরা এমন উদ্ধার কাজে। নিজেই ডিজাইন করে ফেলি একটি গঁষঃরঢ়ঁৎঢ়ড়ংব জড়নড়ঃ. রোবটটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে দূর থেকে এবং এটিকে ব্যবহার করা যাবে প্রায় সব উদ্ধার কাজে। ২০১৫ সালের শুরুর দিকেই বানিয়ে ফেলি আমার রোবট ‘দুর্বার’ এর প্রোটোটাইপ। প্রটোটাইপটি উদ্ধার কাজের জন্য উপযুক্ত না হলেও আমার রোবটটি কিভাবে কাজ করবে এবং কিভাবে আমার মূল রোবটটিকে উদ্ধার কাজে ব্যবহার করতে পারব তা সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম। দুর্বারের প্রোটোটাইপ ভার্সনটি বানিয়েছিলাম অৎফঁরহড় গরপৎড়পড়হঃৎড়ষষবৎ এবং ঈ প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে। রোবটটিকে ব্লুটুথের মাধ্যমে কন্ট্রোল করা যায় এবং রোবটটিতে ছিল একটি গ্রিপার যার মাধ্যমে কোন বস্তুকে ধরা যায় বা সেটিকে ব্যবহার করে নিষ্ক্রিয় করা যায় বোমা। কিন্তু দুর্বারের প্রোটোটাইপ ভার্সনটি উদ্ধার কাজের উপযুক্ত না হওয়ায় লেগে যাই দুর্বারের মূল ভার্সনটি বানানোর কাজে। দুর্বারের মূল ভার্সনটি পারবে প্রকৃত উদ্ধার কাজ করতে, কিন্তু এটি বানাতে প্রয়োজন হবে বেশকিছু টাকার। প্রকৃত দুর্বারের ডিজাইন এবং পরিকল্পনাসহ অংশ নেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ২রÑ অপপবংং ঃড় ওহভড়ৎসধঃরড়হ এর ঝবৎারপব ওহহড়াধঃরড়হ ঋঁহফ প্রকল্পে। ঝবৎারপব ওহহড়াধঃরড়হ ঋঁহফ থেকে উদ্ভাবন বাস্তবায়ন করার জন্য আমার মতো উদ্ভাবকদের দেয়া হয় ফান্ড। ঝবৎারপব ওহহড়াধঃরড়হ ঋঁহফ এ নির্বাচিত হয়ে যাই এবং দুর্বারকে বাস্তবায়ন করার জন্য পেয়ে যাই ফান্ড। বর্তমানে দুর্বার প্রায় ৭০% কমপ্লিট এবং এটি বাস্তবায়নের পর ব্যবহার করা যাবে সকল প্রকাল জবংপঁব, ওহংঢ়বপঃরড়হ এবং ঝঁৎাবরষষধহপব কাজে। উল্লেখ্য, অ২র থেকে ঠিক করা মেন্টরগণ আমাকে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাহায্য করছেন দুর্বারকে বানাতে। ডিপ্রজন্ম : পরিবারের সমর্থন কেমন পেয়েছ? আকমাল : আব্বু-আম্মুর সাপোর্ট সব টিনেজারদের মতোই একেবারেই পেতাম না কাজের শুরুতে। তবে এখন সবচেয়ে বেশি তারাই সাপোর্ট করে, আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার নানু। তিনিও ভালবাসেন ইনোভেশন এবং নতুন কিছু করতে, তার দেখেই অনুপ্রেণিত হই নতুন কিছু করতে। বাবা- মোঃ শহিদুল ইসলাম, পেশায়- জেলা মহিলা ও শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা, বগুড়া। মা- আখতার জাহান, গৃহিণী। নানু এ কে এম আবদুল কাদের আজাদ, পেশায়- অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, লেখক-কবি-সাহিত্যিক। ডিপ্রজন্ম : এ বয়সেই তুমি আইটি ফার্মে কাজ করছ, এতকিছু একসঙ্গে কিভাবে সম্মিলন ঘটাচ্ছ? আকমাল : পড়াশোনার পাশাপাশি কিন্তু আমাদের সবারই অবশিষ্ট অনেক সময় থাকে। কিন্তু আমরা একেকজন একেকভাবে সেই সময়টাকে ব্যয় করে থাকি। আমি সর্বদা পড়াশোনাকে মূল কাজ হিসেবে বিবেচনা করে আসছি এবং পড়াশোনার পাশাপাশি আমি অনেকটাই সময় পেয়ে থাকি এবং সে সময়ের প্রায় পুরোটাই ব্যবহার করি আমার চধংংরড়হ-এর জন্য। আমি বিশ্বাস করি, ‘অমব রং লঁংঃ ধ হঁসনবৎ রভ ুড়ঁ পধহ ফড় যিধঃ ুড়ঁ ধিহঃ ঃড় ফড়’ এবং এমন বিশ্বাস রেখেই সামনে এগিয়ে যেতে চাই। তবে আমাদের দেশের বেশিরভাগ টিনেজারদের বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাদের পরিবার থেকে, যদি তাদের প্যাশন থাকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের বাহিরে অন্য কিছু হওয়ার। টিনেজারদের এমন সমস্যার সমাধান করার জন্য এবং টিনেজারদের অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করতে আমার প্রিয় ইউসুফ মুন্না ভাইয়া প্রতিষ্ঠা করেন জবভষবপঃরাব ঞঊঊঘঝ নামের একটি এনজিও। সংগঠনটি থেকে আমরা বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে টিনেজারদের প্যাশনকে অনুসরণ করাতে অনুপ্রাণিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে আমি জবভষবপঃরাব ঞঊঊঘঝ-এর চিফ টেকনিকাল অফিসার হিসেবে কাজ করছি। ডিপ্রজন্ম : যদি বলা হয়, তোমার উদ্ভাবনী সবচেয়ে বড় উদ্যোগ কোনটি? আকমাল : বাক এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য করা আমার উদ্ভাবন ‘উরমরঃধষ ঝরমহ খধহমঁধমব ওহঃবৎঢ়ৎবঃবৎ.’ উদ্ভাবনটির বিস্তারিত- ক’জন বাক বা শ্রবণ প্রতিবন্ধী, যে কথা বলতে পারে না বা শুনতে পারে না সে কথা বলার জন্য ইশারা ভাষা ব্যবহার করে। কিন্তু ইশারা ভাষা ব্যবহার করে একজন প্রতিবন্ধী শুধুমাত্র আরেকজন ইশারা ভাষা জানা ব্যক্তির সঙ্গেই কথা বলতে পারবে। অর্থাৎ, আমি যদি ইশারা ভাষা না জানি তাহলে আমি একজন বাক বা শ্রবণ প্রতিবন্ধীকে কিছু বলতে পারব না বা তার কথা বুঝতে পারব না। এই সমস্যাটি সমাধানের জন্য আমি উদ্ভাবন করেছি একটি ডিভাইস যেটি কাজ করবে ইন্টারপ্রিটার হিসেবে। আমার ডিভাইসটি ইশারা ভাষাকে শনাক্ত করতে পারে এবং ইশারা ভাষাকে টেক্সট এবং কথাকে কনভার্ট করে দেখাতে পারে। এটি ব্যবহারের মাধ্যমে একজন বাক বা শ্রবণ প্রতিবন্ধী আরেকজন ইশারা ভাষা না জানা স্বাভাবিক ব্যক্তিকে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবে। আবার, ডিভাইসটিতে কথাকে বা টেক্সটকে ইনপুট দিলে তা ঝরমহ খধহমঁধমব-এর গ্রাফিক্স জেনারেট করে আউটপট হিসেবে দেখাবে। যার মাধ্যমে একজন ইশারা ভাষা না জানা স্বাভাবিক ব্যক্তি তার মনের ভাব একজন বাক বা শ্রবণ প্রতিবন্ধীর কাছে প্রকাশ করতে পারবে। উদ্ভাবনটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাক এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধীরা পাবে আরও একটু উন্নত জীবন। ডিপ্রজন্ম : বগুড়া থেকে রাজধানী, জয়রথ চলছেই। অনুভূতি কেমন? আকমাল : অনুভূতি সর্ববদাই অসাধারণ। তবে যতটুকু আসতে পেরেছি তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ আল্লাহ তায়ালার প্রতি এবং তার পরেই আমার পরিবারের প্রতি।
×