ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ- শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধনে স্থিতিশীলতা

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ- শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধনে স্থিতিশীলতা

অপূর্ব কুমার ॥ দেশের পুঁজিবাজার ২০১৭ সালে বিনিয়োগকারীদের জন্য একরাশ আশার আলো নিয়ে আসে। বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধন। রাজধানীসহ সারাদেশেই এই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে পরবর্তীতে। বিনিয়োগের অ আ ক খ নামের এই শিক্ষা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এছাড়া পুঁজিবাজারের গতি ফেরাতে নেয়া হয়েছে নানা সরকারী উদ্যোগ। সবমিলিয়ে বাজারে ফিরে আসে স্বস্তি। গত ২০১০ সালের বড় ধরনের ধসের পর প্রথমবারের মতো স্থিতিশীল পরিস্থিতি ফিরে আসে। যদিও এই ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব বছর শেষ হয়ার কারণে এখন কিছুটা হলেও মুনাফা তোলার চাপে রয়েছে। যে কারণে চলতি মাসের পুরোটাই বলতে গেলে এক ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে। তারপরও বিনিয়োগকারীদের চোখে মুখে আগের হতাশা ছিল না। তবে এই বছরে মূলধন উত্তোলনের নতুন নীতিমালায় আইপিও কিছুটা কমেছে। অধিকারমূলক শেয়ার বা রাইট শেয়ার ছেড়ে টাকা উত্তোলনের প্রবণতা বেশি ছিল। এছাড়া ব্যাসেল-২ বাস্তবায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বন্ড ছাড়ার অনুমোদন পেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে। গত ৮ জানুয়ারি শেয়ারবাজারের বিদ্যমান ও সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ জন্য দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা বা ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি শীর্ষক কর্মসূচী হাতে নেয় সংস্থাটি। আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশব্যাপী এই কর্মসূচী ও বিএসইসির জন্য দশতলা নিজস্ব ভবন উদ্বোধন করেন। সারাবছর এই বিনিয়োগ শিক্ষা কর্মসূচীর আওতায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়। স্বল্প মেয়াদে চলতি বছর বিদ্যমান বিনিয়োগকারী, পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মরত ব্যক্তি, বিচারক, প্রশিক্ষক, সেনাবাহিনী, পুলিশ, আইনজীবী, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বর্তমান সরকারের দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফল হিসেবে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসে বছরের শুরু থেকেই। বাজারে নতুন টাকার প্রবাহ বাড়ায় সূচক ও লেনদেনেও গতি আসে। এরই ফল হিসেবে চলতি বছরে ২৬ নবেম্বর ঢাকা স্টক একচেঞ্জের প্রধান সূচকটি সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৩৩৬.৮৯ পয়েন্টে পৌঁছায়। নতুন সংশোধিত সূচক চালুর পর এটিই সূচকের সর্বোচ্চ অবস্থান। একইভাবে ব্লু চিপস শেয়ারগুলো নিয়ে ডিএস-৩০ সূচকটি সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছিল ২২৯০.৩০ পয়েন্টে চলতি ১৯ নবেম্বর। শরীয়াভিত্তিক কোম্পানিগুলো নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ১৩৯৪ পয়েন্টে পৌঁছায় ২৬ নবেম্বর। গত নবেম্বরে প্রধান বাজারে সূচকের অবস্থান থাকলেও লেনদেনের গতি সবচেয়ে বেশি ছিল গত জানুয়ারি মাসে। ২০১০ সালের পর অর্থাৎ সাড়ে ছয় বছরের সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছিল গত ২৩ জানুয়ারি। এই সময়ে ডিএসইর সার্বিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৮০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর আগের ১৭ জানুয়ারি সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এই বছরে ৩০ আগস্ট প্রথমবারের মতো ডিএসইর বাজার মূলধন ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এই বাজার মূলধন এখন রবিবার লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকায়। তবে এই বছরের সবচেয়ে বেশি বাজার মূলধন ছিল ২৩ নবেম্বর। এই দিনে ডিএসইর মোট বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ২৬ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। পুঁজিবাজারে বড় ধরনের ধসের পর বর্তমান সরকার সিকিউরিটিজ আইন সংক্রান্ত বেশ কিছু আইনে পরিবর্তন আনে। এই মেয়াদে সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন আন্তজার্তিক মানের অর্থাৎ এ ক্যাটাগরিতে উন্নীত হয়। এছাড়া সুশাসন নিশ্চিত ও কারসাজি রোধে সার্ভিলেন্স সিস্টেমের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। ফলে এখন আর কারসাজি চক্রের সদস্যরা খুব সহজে পার পেয়ে যেতে পারে না। তবে এর মাঝেও বাজারে লেনদেন ও সূচক বৃদ্ধির সময়ে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ যায়নি। এমনকি বিবিএস কেবল ও জাহিন স্পিনিং নামের দু’টি কোম্পানির ক্ষেত্রে ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তদন্ত কমিটি গঠন করে সত্য উৎঘাটনও করেছে। চলতি ২০১৭ সালে নতুন পাবলিক ইস্যু রুলসের কারণে শুরুতে আইপিও অনুমোদন কমেছিল। যার কারণে আইপিও আবেদনকারীদের মধ্যে কিছুটা হতাশা ছিল। তবে বছরের মাঝামাঝি এসে কিছুটা হলেও তা পুষিয়ে গেছে। কারণ এই বছরে আইপিওতে আসা কোম্পানিগুলোর শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগকারীরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১ হাজার শতাংশের ওপর মুনাফা করেছে। চলতি বছরে এক মিউচুয়াল ফান্ডসহ মোট সাতটি কোম্পানি বাজারে আইপিও ছেড়ে টাকা উত্তোলন করেছে। কোম্পানিগুলো বাজার থেকে ৩৯০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। কিন্তু আগের বছরে এই উত্তোলিত টাকার পরিমাণ ছিল ৮৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন আইনে এক বছরে মোট ৫৫ শতাংশ টাকা উত্তোলন কমেছে। নতুন আসা কোম্পানিগুলো হলো শেফার্ড ইন্ড্রাস্টিজ, নূরানী ডাইং, বিবিএস কেবল, আমরা নেটওয়ার্ক, ওয়াইম্যাক্স ইলেক্ট্রোড, নাহি এ্যালুমিনিয়াম ও আইসিবি এএমসিএল ফার্স্ট অগ্রণী মিউচুয়াল ফান্ড। অন্যদিকে আইপিও কমলেও এই বছরে রাইট শেয়ার বা অধিকারমূলক শেয়ার ছেড়ে মূলধন উত্তোলন করেছে। রাইট শেয়ার ছেড়ে এই বছরে মূলধন উত্তোলন বেড়েছে চারগুণ। চার কোম্পানি রাইট শেয়ার মোট ১ হাজার কোটি টাকার বেশি উত্তোলন করেছে। কোম্পানিগুলো হলো ইফাদ অটো, আইডিএলসি, সাইফ পাওয়ারটেক ও আইএফআইসি ব্যাংক। এছাড়া লঙ্কাবাংলা ফাইনান্স ও আলিফ ম্যানুফ্যাকচারিং নামের কোম্পানি দু’টির রাইট অনুমোদন হলেও টাকা উত্তোলন বা চাঁদা গ্রহণ শুরু হয়নি। তাই এগুলোকে হিসাবে আনা হয়নি। আগের বছরে এই রাইট শেয়ার ছাড়ার হার কম ছিল। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে। কারণ লভ্যাংশ নেয়ার পর তালিকাভুক্ত বেশ কিছু ব্যাংকের শেয়ার দর দ্বিগুণ তিনগুণ হয়েছে। এছাড়া ব্র্যাক ব্যাংকও বড় মূলধনী কোম্পানির তালিকায় উঠে এসেছে। ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক এবং সর্বশেষ এবি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক পদে বড় ধরনের রদবদল শেয়ার দরবৃদ্ধি ও হ্রাসে বড় ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া অন্যান্য খাতের বেশ কিছু কোম্পানির ফু-ওয়াং সিরামিক, সিএমসি কামাল, সুহৃদ ইন্ড্রাস্ট্রিজের মালিকানা বদল ঘটেছে। তারপরও ব্যাংকের শেয়ারের বিনিয়োগকারীরাই শেষ হাসিটা হাসতে পেরেছেন। দীর্ঘদিন লোকসানে থাকা বিনিয়োগকারীরাও মুনাফার মুখ দেখেছেন। ব্যাংকগুলোর আমানতের বিপরীতে সুদের হার কমে যাওয়া এবং নতুন বিনিয়োগের সুযোগ কমে যাওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারমূখী হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এছাড়া ধসপরবর্তী বিভিন্ন সংস্কার এবং আইন কানুন পরিবর্তনের ইতিবাচক প্রভাবেও বাজারে দেশী-বিদেশী নতুন বিনিয়োগ এসেছে। এছাড়া গত বছরে উল্লেখযোগ্যহারে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। গত মাসে বিদেশীরা ১ হাজার ২৫৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন করেছেন। পুঁজিবাজারের ইতিহাসে এক মাসে বিদেশীরা এত বেশি টাকার শেয়ার লেনদেন আগে কখনো করেনি। এর আগে বিদেশীদের এক মাসে সর্বোচ্চ লেনদেন ছিল গত মার্চে। মাসটিতে বিদেশীদের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। তার আগে বিদেশীরা এক মাসে সর্বোচ্চ লেনদেন করে ১ হাজার ৩৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। বিদেশীরা এই শেয়ার লেনদেন করে চলতি বছরের জানুয়ারিতে। ফলে এক বছরে তিনবার বিদেশীদের শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি হল। শুধু তাই নয়, চলতি বছরে বিদেশীরা পাঁচ মাসে হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন করেছেন। ২০১৭ সালের আগে কখনও বিদেশীরা এক মাসে এক হাজার কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন করেননি। ২০১৭ সালে বিভিন্ন ক্যাটাগরির কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে জেড ক্যাটাগরির বা জাঙ্ক কোম্পানিগুলো। এসব কোম্পানির কিছু কিছুর দর কয়েকশ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষ করে ছোট মূলধনী জেড ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলোর ঝলক ছিল বেশি। ঝুঁকির মাত্রা বেশি জেনেও তারা এসব শেয়ারে অস্বাভাবিক বিনিয়োগ করেছে। জানতে চাইলে বাজার বিশ্লেষক প্রফেসর আবু আহমেদ বলেন, চলতি বছর পুঁজিবাজারের জন্য বেশ ভালই ছিল। সব ধরনের কোম্পানিতেই মুনাফা করেছেন বিনিয়োগকারীরা। তবে যেহেতু নিজের টাকার সুরক্ষা নিজেকেই দিতে হবে, তাই বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সম্পর্কে আরও সতর্ক হতে হবে। সব সময় লেনদেন না করে নগদ অর্থ ধারণ করার ধৈর্য রাখতে হবে। জেনে বুঝে লেনদেন করলে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া কম হবে।
×