ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

২২ জানুয়ারি থেকে শুরু হতে পারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭

২২ জানুয়ারি থেকে শুরু হতে পারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ সবকিছু ঠিকমতো এগিয়ে গেলে আগামী ২২ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কর্মকা- শুরু হতে পারে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পক্ষে ৩০ সদস্যের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হয়েছে। এই গ্রুপ সুষ্ঠুভাবে সার্বিক প্রত্যাবাসন প্রশ্নে কাজ শুরু করেছে। প্রত্যাবাসন শুরু হতে যাচ্ছে এমন খবরে উখিয়া টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোও নড়েচড়ে উঠেছে। কেননা, প্রত্যাবাসন প্রশ্নে মিয়ানমার যেমন বহু আগে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে তেমনি রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকেও অনুরূপ প্রশ্নে কিছু দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। উভয় পক্ষের দাবিসমূহ প্রত্যাবাসন প্রশ্নে ইতিবাচক নয়। দু’পক্ষের একটি দাবিই পুরো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার কোনভাবেই অনুকূলে নয়। কেননা, মিয়ানমার শর্ত দিয়েছে, প্রত্যাবাসনকালে রোহিঙ্গাদের সে দেশে বসবাসের যে কোন একটি প্রমাণ দিতে হবে। অপরদিকে, রোহিঙ্গারা বলেছে, নাগরিকত্বের সনদ ছাড়া তারা রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাবে না। এ অবস্থায় প্রত্যাবাসনকালে কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা জল্পনাকল্পনার জন্ম দিয়েছে। কেননা, নতুন-পুরনো মিলিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গার অধিকাংশের কাছে মিয়ানমারের শর্ত অনুযায়ী সে ধরনের কোন প্রমাণপত্র নেই। আর মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ নামে আখ্যায়িত না করার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। নাগরিকত্ব দেয়ার ইচ্ছা তাদের কাছে মোটেও নেই। রোহিঙ্গাদের রাখাইনের মুসলিম নামে মিয়ানমার সরকার আখ্যায়িত করে আসছে। শুধু তাই নয়, এই রোহিঙ্গারা বাঙালী এবং তাদের দেশে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে অবৈধভাবে বসবাস করে আসছে বলে যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে তারা অটল রয়েছে। এদিকে, বিশ্ব চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও এর বাস্তবায়ন প্রশ্নে তারা কতটুকু আন্তরিক তা একটি বড় ধরনের জিজ্ঞাস্য হয়ে আছে। কেননা, গত ২৫ আগস্ট রাতের পর রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান চালিয়ে মিয়ানমার সরকার যে গণহত্যা চালিয়েছে এবং সঙ্গে চালিয়েছে বাড়িঘর জ্বালানো এবং নারী ধর্ষণ, যার কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা দেশান্তর হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ সরকারও রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করে তাদের আশ্রয় ও ত্রাণ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, এ আশ্রয় ও ত্রাণ সহায়তা কতদিন? আশ্রয় দিতে গিয়ে উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের সার্বিক পরিবেশ বিপর্যয়ে পড়েছে। দেশী-বিদেশী, সরকারী-বেসরকারী ত্রাণে রোহিঙ্গারা বেশ ভাল অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু বেসরকারী ও বিদেশী ত্রাণ ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে তাদের চাহিদা অনুযায়ী ত্রাণ মিলছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। মূলত রোহিঙ্গারা একদিকে আশ্রয় পেয়ে যেমন খুশি তেমন অঢেল ত্রাণসামগ্রী পেয়ে তারচেয়ে বেশি খুশি। এ ধরনের মুক্ত চলাচল, আশ্রয় ও ত্রাণ সহায়তা মিয়ানমারে তাদের জন্য কল্পনাতীত। অপরদিকে, প্রত্যাবাসন হলে সে দেশে তাদের কিভাবে রাখা হবে এবং প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা দেয়া হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ইতোমধ্যে তাদের অধিকাংশের ভিটেমাটি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। স্বজন হারিয়েছে অনেকে। ধর্ষিত হয়েছে বিপুল নারী ও যুবতী। রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান গুটিয়ে ফেলা হলেও উগ্র মগ সন্ত্রাসীদের অত্যাচার-নির্যাতন একেবারে বন্ধ হয়নি। সঙ্গত কারণে তাদের মাঝে প্রত্যাবাসিত হওয়ার কি হবে তা নিয়ে চরম ভীতি রয়েছে। এছাড়া নাগরিকত্ব পাওয়া সে তো আকাশ কুসুম কল্পনা। কারণ, মিয়ানমার সরকার তাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে স্বীকৃতিই দেয়নি। যাদের নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে। এসব মিলিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রত্যাবাসন নিয়ে বহুমুখী আলোচনা-সমালোচনা ও জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছে। শুধু তাই নয়, সাধারণ রোহিঙ্গার মাঝে ভীতির সঞ্চার ঘটাতে পুরনো এবং মিথ্যা ভিডিও প্রচার শুরু করে দিয়েছে উগ্রবাদীরা। কূটনৈতিক আলোচনায় বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত নিতে শর্তসাপেক্ষে রাজি হওয়ার পর থেকে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নানামুখী তৎপরতা চলছে। ইতোমধ্যে রাখাইন রাজ্যে ঘটে যাওয়া নানা বর্বরতার কাহিনীর পাশাপাশি নানা কল্পকাহিনী ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। উদ্দেশ্য, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বানচাল করে দেয়া। এ প্রক্রিয়ায় তারা রাখাইন রাজ্যে ঘটে যাওয়া নানা ভিডিওচিত্র প্রদর্শনীও শুরু করেছে। এসব নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি সফল করার প্রশ্নে সন্দেহের দানা বাঁধছে। গত শুক্রবার জুমার নামাজের খুৎবা দেয়ার আগে বালুখালী, কুতুপালং, শফিউল্লাহকাটা, উনচিপ্রাং, লেদা, মুচনি, নয়াপাড়া ও শামলাপুর ক্যাম্প মসজিদে উপস্থিত রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে বিভ্রান্তিকর ও রাখাইন রাজ্যে ফিরে না যেতে সরাসরি উস্কানি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। নাগরিকত্বসহ সকল মৌলিক সুবিধা না পেলে কেউ যেন মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি না হয় এ মর্মেও প্রচার চালানো হয়েছে। শনিবার বিকেল থেকে ১২টি ক্যাম্পের অধিকাংশ আশ্রয় শিবিরে কতিপয় রোহিঙ্গা যুবক প্রতিটি ব্লকে গিয়ে পুরনো ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করেছে রোহিঙ্গাদের মাঝে। অনুরূপ পরিস্থিতিতেও শনিবার ভোরে টেকনাফের হাবিরছড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ৩২ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুর অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে। সীমান্তের ওপারে দংখালিতে যে সকল রোহিঙ্গা এখনও অবস্থান নিয়েছে তারাও যাতে বিভিন্ন ফাঁকফোকরে চলে আসতে পারে সে নিয়ে তৎপর রয়েছে রোহিঙ্গাদের কয়েকটি গ্রুপ। এরা নৌকার মাঝিদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে তাদের নিয়ে আসতে উৎসাহিত করছে। তবে বর্তমানে সীমান্তজুড়ে পূর্বের চেয়ে কড়াকড়ি বেড়েছে। এরপরও যারা টেকনাফের উপকূলে পৌঁছে যাচ্ছে তাদের মানবিক কারণে গ্রহণ করা হচ্ছে। শনিবার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বুিচদং লুদাইং ১ নম্বর ওয়ার্ডের ৫৬বছর বয়সের বাসিন্দা ইব্রাহীমকে রাতে ঘর থেকে ধরে নিয়ে স্থানীয় কয়েক মগ গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনা নিয়ে সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো শতভাগ নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে প্রচার রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরও প্রচার চলছে যে, বুচিদংয়ের ৫৫১নং সেনা ব্যাটালিয়নের সদস্যরা প্রতিদিন রোহিঙ্গা বসতঘরে আগুন দিচ্ছে। এনভিসি কার্ড না নেয়া, দাবিকৃত চাঁদা না দেয়ায় রোহিঙ্গা বাড়িতে আগুন দেয়া হচ্ছে। বুচিদংয়ে প্রতিদিন দুয়েকটি করে রোহিঙ্গা বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। উগ্র রোহিঙ্গা যুবক আটক ॥ উখিয়ার সিএ্যান্ডবি পুরাতন অফিস এলাকা থেকে র‌্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে এক উগ্র রোহিঙ্গা ডাকাতকে গ্রেফতার করেছে। শুক্রবার রাত সাড়ে দশটায় রোহিঙ্গাদের ডাকাতির প্রস্তুতির গোপন সংবাদ পেয়ে উখিয়ার সিএ্যান্ডবি পুরাতন অফিস এলাকায় অভিযান চালায় র‌্যাব সদস্যরা। র‌্যাব-৭ কক্সবাজারের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মোঃ রুহুল আমিন শনিবার বিকেলে জানান, র‌্যাব সদস্যদের অভিযানে আটক রোহিঙ্গা ডাকাত হচ্ছে মোঃ রশিদুল্লা বুচিদংয়ের চিংঢং এলাকার মোঃ শফির পুত্র। ধৃত রোহিঙ্গা ডাকাতের কাছ থেকে দেশীয় তৈরি ২টি ওয়ান শুটারগান, ৫টি ১২ বোর কার্তুজ, ২টি দেশীয় তৈরি কিরিচ উদ্ধার করা হয়েছে। ধৃত উগ্র রোহিঙ্গা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে লেদা ক্যাম্পের বাসিন্দা, বিভিন্ন সময়ে তারা এলাকায় ডাকাতি এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লোকজনকে জিম্মি করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে। উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সভা ॥ উগ্র ও সহিংসতা প্রতিরোধে সকলকে এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে স্থানীয় এনজিও সংস্থা হ্ল্পে কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী এমএ কাশেম। সংগঠনের পক্ষে এ ব্যাপারে এলাকাবাসীকে নিয়ে একটি সভাও করা হয়েছে। সভায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে কোন ধরনের অপপ্রচারে কর্ণপাত না করার আহ্বান জানানো হয়। এতে আরও বলা হয়, উগ্রপন্থায় লিপ্ত কিছু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বানচাল করার জন্য তৎপরতায় লিপ্ত। উভয় দেশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যাবাসন শুরু হলে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাবার আহ্বান জানানো হয় এ সমাবেশে।
×