ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

কোটি টাকার জেনারেটর গায়েব

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭

কোটি টাকার জেনারেটর গায়েব

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ পাঁচ বছর আগে ক্রয় করা বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের কোটি টাকার জেনারেটর মেশিন কয়েক বছরের ব্যবধানে গায়েব গেছে। জনস্বার্থে ক্রয় করা ওইসব মেশিন ক্রয় থেকে শুরু করে স্থাপন পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াই জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছিল বলে বিসিসির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিশেষ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য। সিটি মেয়র আহসান হাবীব কামাল এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান জানিয়েছেন, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে পুরো বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সূত্রমতে, তৎকালীন সময়ের মেয়র শওকত হোসেন হিরন একবার এ সংক্রান্ত ঠিকাদারের পেশ করা একটি বিল আটকে দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর পুরো দৃশ্যপট পাল্টে যায়। কোন এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় জেনারেটরগুলো সচল দেখিয়ে কোটি টাকার বিল উত্তোলন করে নেয়া হয়েছে। আর এ ভাগাভাগির অর্থ দিয়ে কেউ পদোন্নতি আবার কেউবা কয়েক লাখ টাকা দিয়ে বেসরকারী একটি সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে বরিশাল নগরী ব্যাপক লোডশেডিংয়ের কবলে পরে। এর প্রভাবে পানির পাম্পগুলো সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। লোডশেডিংয়ের কারণে পানির জন্য নগরবাসী বিক্ষোভ পর্যন্ত করেছিল। বিষয়টি ওই সময়ের মেয়র শওকত হোসেন হিরনের নজরে আসলে তিনি নগরবাসীর ভোগান্তি লাঘবে মন্ত্রণালয়ে ১০টি জেনারেটর সরবরাহের আবেদন করেন। যেগুলো দিয়ে বিদ্যুত না থাকলেও পানির পাম্পগুলো সচল রেখে জেনারেটরগুলোর মাধ্যমে পানি সাপ্লাই দেয়া সম্ভব হতো। সেমতে বরিশাল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর বিদেশী অর্থায়নে প্রায় দুই কোটি টাকা বরাদ্দ আনে। ওই বছরেই স্থানীয় ঠিকাদার মনজুরুল আহসান ফেরদৌসকে দরপত্রের মাধ্যমে জেনারেটর ক্রয়ের কার্যাদেশ দেয়া হয়। দরপত্রে উন্নতমানের মেশিন ক্রয়ের জন্য জার্মান, ইউকে এবং আমেরিকার কথা উল্লেখ করা হয়। তবে বিপত্তি দেখা দেয় মেশিন বরিশালে আনার পরে। যন্ত্রাংশ সঠিক মানের কেনা হয়েছে কিনা তা দেখতে তিনটি জেনারেটর নগর ভবনে আনা হয়েছিল। নগর পিতার সামনে বসে তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুজ্জামান এবং সহপ্রকৌশলী কাজী মনিরুল ইসলাম স্বপনসহ অন্য কর্মকর্তাগণ মেশিনগুলো সচল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র শওকত হোসেন হিরন ঠিকাদারের বিল আটকে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে বহু তদবির চালিয়েও ওই বিল ছাড় করাতে পারেনি ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা। সূত্রমতে, যে তিনটি দেশের কথা কার্যাদেশে উল্লেখ করা হয়েছিল সেখান থেকে মেশিনগুলো ক্রয় করা হয়নি। বরং নিম্নমানের চায়না মেশিন সরবরাহ করা হয়েছিল। যার সর্বোচ্চ দর ছিল ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা। সে হিসেবে ১০টি মেশিনের দাম হয় ১০ লাখ টাকা। বাকি অর্থ সংশ্লিষ্টরা মিলে হজম করেছে বলেও সূত্রগুলো দাবি করে। এদিকে সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের মৃত্যুর পর পুনরায় ওই চক্রটি নতুন মেয়রের সামনে মেশিনগুলো সচল দেখিয়ে সব বিল উত্তোলন করে নিয়ে মেশিনগুলো নগরীর কয়েকটি পানির পাম্পে স্থাপন করে দেয়। এ বিষয়ে বিসিসির বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুজ্জামান জানান, পিডব্লিউডিসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছিল। কমিটির প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করেই বিলের ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। এখানে তার (নির্বাহী প্রকৌশলীর) কোন দায়ভার নেই। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র এবং তথ্য প্রাপ্তির জন্য আবেদন করা হলে তাদের নিকট কোন কাগজপত্র নেই বলে তিনি উল্লেখ করলেও পরে অবশ্য বলেন, সব পানি শাখায় রয়েছে। পানি শাখার চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত (নির্বাহী প্রকৌশলী পানি) কাজী মনিরুল ইসলাম স্বপনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে মেশিনের ক্যাটালগের কাগজপত্র থাকার কথা স্বীকার করলেও পরে অদৃশ্য কারণে তিনি সব দায়ভার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে ওপর চাপিয়ে সকল কাগজপত্র তাদের দফতরে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে সিটি কর্পোরেশন থেকে তাহলে কাগজপত্র কেন জনস্বাস্থ্য দফতরে এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর মেলেনি বিসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, স্থাপনকৃত মেশিনগুলো অতি নিম্নমানের হওয়ার কারণে স্থাপনের কয়েক মাসের মধ্যেই অকেজো হয়ে পড়ে। আর বর্তমানে মেশিনগুলো কি অবস্থায় রয়েছে তার কথা বিসিসির কেউ বলতে পারছেন না। এমনকি আদৌ বহাল আছে কিনা তারও কোন হদিস নেই। সূত্রমতে, নগরীতে মোট পানির পাম্প রয়েছে ৩২টি, আর জেনারেটর কেনা হয়েছিল ১০টির জন্য। ম্যানুয়ালের তথ্য অনুযায়ী ৪৪ হর্স পাওয়ারসম্পন জেনারেটর ক্রয় করতে বলা হলেও ঠিকাদার চায়না থেকে অতি নিম্নমানের জেনারেটরগুলো ক্রয় করেছিলেন। যে কারণে সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের বাতিল করা বিল বর্তমান মেয়রের সময়ে উত্তোলন করে ঠিকাদার নিম্নমানের যন্ত্রাংশসমৃদ্ধ মেশিনগুলোই যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় উচ্চ মানসম্পন্ন করে স্থাপন করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, তৎকালীন সময়ে ঠিকাদারের কাছ থেকে প্রাপ্ত কমিশনের অর্থে একজন সংশ্লিষ্ট দফতরে চলতি দায়িত্ব ও অন্য এক কর্মকর্তা একাই ৪০ লাখ টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি ওই কর্মকর্তা কমিশনের অর্থে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ টাকা দিয়ে একটি সংগঠনের সদস্যপদ ক্রয় করেছেন। সূত্রগুলো আরও জানিয়েছেন, বর্তমান সরকারের সময়ে বিদ্যুতের লোডশেডিং কমে আসায় মেশিনগুলো চালানোর প্রয়োজন পড়েনি। আর এ কারণেই দুর্নীতির পুরো অর্থ হালাল করে নিয়েছেন কতিপয় কর্মকর্তা। এ বিষয়ে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সচেতন নগরবাসী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দুদকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
×