ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারী কর্মচারী আইন আবারও যাচাই বাছাই কমিটিতে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭

সরকারী কর্মচারী আইন আবারও যাচাই বাছাই কমিটিতে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সরকারী কর্মচারী আইন-২০১৭ অনুমোদন না দিয়ে আবারও যাচাই-বাছাই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি। আইনটিতে সরকারী কর্মচারীর বাইরের কাউকে উপসচিব থেকে সচিব পদ পর্যন্ত নিয়োগের বিধানের বিষয়টি আরও যাচাই-বছাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে অনুষ্ঠিক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ‘রাষ্ট্রপতির বিশেষ এখতিয়ার’ শিরোনামে প্রস্তাবিত খসড়া আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অন্যান্য বিধান, আপাতত বলবত অন্য কোন আইন বা আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন দলিলে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রপতি, জনস্বার্থে, বিশেষ মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও অপরিহার্যতা বিবেচনা করিয়া, সরকারের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদসংখ্যার অনধিক ১০ শতাংশ পদে, উক্তপদে নিয়মিতভাবে নিয়োগযোগ্য কর্মচারীগণের বাহির হইতে, কোন ব্যক্তিকে প্রেষণ বা চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ করিতে পারিবেন।’ এছাড়া অবসরে যাওয়া সরকারী কর্মচারীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রসঙ্গে প্রস্তাবিত আইনের ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি, জনস্বার্থে, যে কোন কর্মচারীকে, চাকরি হইতে অবসর গ্রহণের পর, প্রজাতন্ত্রের কর্মে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করিতে পারিবেন।’ প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে রাষ্ট্রপতির কোটায় সরকারী কর্মচারীদের মধ্য থেকে সচিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কিছু পদে রাজনৈতিক ব্যক্তিকেও নিয়োগের নজির রয়েছে। যে কোন ব্যক্তিকে নিয়োগের বিধান প্রশাসনে দলীয়করণ আরও বৃদ্ধি পাবে। এটি কার্যকর হলে প্রশাসনের সর্বত্রই রাজনৈতিক ও পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হবে। প্রশাসনে দলীয় প্রভাব আরও জোরালো হবে। বাড়বে দলীয়করণ। বিষয়টি সরকারের একটি অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ আখ্যা দিয়ে অবসরপ্রাপ্ত এক সচিব বলেন, এতে প্রশাসনে রাজনৈতিক প্রভাব বাড়বে। ভেঙ্গে পড়বে প্রশাসনের চেন অব কমান্ড। মেধা ও যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সার্বিকভাবে দক্ষতার মান অবমূল্যায়ন হবে। দেশের জন্য এটি ইতিবাচক হবে না। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষমতা থাকার পরও রাষ্ট্রপতির বিশেষ এ এখতিয়ার প্রশাসনে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়োগকে উৎসাহিত করবে। এটা প্রশাসনের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনবে। যাকে খুশি তাকে এনে প্রশাসনে বসিয়ে দেয়া যাবে। এতে প্রশাসনের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রায় একযুগ আগে প্রস্তাবিত এ আইনটি করার উদ্যোগ নিয়ে চার বার খসড়া তৈরি করা হয়। আইনের খসড়া বর্তমান সরকার আমলে সচিব কমিটি হয়ে মন্ত্রিসভায় দু’বার উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে মন্ত্রিসভায় একবার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়। পরে পুনরায় এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হয়। কিন্তু সেটি অনুমোদন না দিয়ে অধিকতর পর্যালোচনার জন্য ফেরত পাঠানো হয়। এরপর খসড়ার ওপর প্রয়োজনীয় সংশোধন চূড়ান্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনটির একটি খসড়া তৈরি করলেও নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে তা পাস করার জন্য রেখে যায়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ইউএনডিপির আর্থিক সহায়তায় সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের করা খসড়াকে যুগোপযোগী ও গ্রহণযোগ্য করতে ২০১০ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বর্তমানে জনপ্রশাসন) তৎকালীন যুগ্ম সচিব (বিধি) মোঃ ফিরোজ মিয়ার নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে খসড়া চূড়ান্ত করে ২০১১ সালের মার্চে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। আইনের খসড়া নিয়ে মতভেদ দেখা দেয় প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের। বিষয়টি সুরাহা করতে প্রকৃচিসহ (প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক) অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। তার আগে সব ক্যাডার ও কর্মচারী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া নিয়ে সংলাপ করার কথা বলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের ৩ জুন এবং ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রস্তাবিত খসড়ায় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সচিব নিয়োগের বিধান থাকার তীব্র বিরোধিতা করেন সব ক্যাডার কর্মকর্তারা। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সেখানে উপস্থিত থাকা প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন প্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী ঘোষণা দেন- সিভিল সার্ভিস আইন নয়, সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য একসঙ্গে সরকারী কর্মচারী আইন প্রণয়ন করা হবে। সরকারী কর্মচারী আইনের খসড়া চূড়ান্ত করতে ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান করা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নজমুল ইসলামকে। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রস্তাবিত খসড়া জমা দিতে বলা হয়। নানা প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই শেষে ২০১৪ সালের ২১ মে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই বছরের ৩ আগস্ট প্রস্তাবিত খসড়ায় অনুমোদন দেয় প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি। এর প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই প্রস্তাবিত খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এ সময় আইনের খসড়ার বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়। মন্ত্রিসভার পর্যবেক্ষণ পূরণ করতে গত বছরের এপ্রিলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিধি) আবদুল হাকিমকে প্রধান করে আবারও একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি বিদ্যমান ৪৬টি আইন, বিধিমালা, অনুশাসন ও আদেশাবলীর প্রয়োজনীয় ধারা প্রস্তাবিত আইনে অন্তর্ভুক্ত করে। ফলে ৭ পৃষ্ঠার খসড়া আইনটি ১৮ পৃষ্ঠায় রূপ নেয়। এতে ১৬ ধারার স্থলে ৬৭টি ধারায় পরিণত হয়। বিশাল এ আইনের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য গত বছরের ২৪ নবেম্বর মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে তা ফেরত পাঠানো হয়। এবার প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি অধিকদর যাচাই-বছাইয়ের জন্য আবার ফেরত পাঠাল।
×