ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

২০১৯ থেকে ’২৩ সালের মধ্যে বৃহৎ এসব বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসবে পায়রা ’১৯ সালে, রামপাল একই বছরের ডিসেম্বরে, মাতারবাড়ি ’২০ সালে এবং রূপপুর ’২৩ সালে

পায়রা রামপাল মাতারবাড়ি রূপপুর- চার বিদ্যুত কেন্দ্রের জিডিপিতে অবদান থাকবে॥ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭

পায়রা রামপাল মাতারবাড়ি রূপপুর- চার বিদ্যুত কেন্দ্রের জিডিপিতে অবদান থাকবে॥ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা

রশিদ মামুন ॥ পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের মূল পর্বের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে, চলছে পায়রা এবং রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ। কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে মাতারবাড়ি বিদ্যুত কেন্দ্রের। আগামী ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বৃহৎ এসব বিদ্যুত কেন্দ্রের সবক’টি উৎপাদনে আসবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো জিডিপিতে চার লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা অবদান রাখবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে যে সাহসিকতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ এই সাহস বদলে দিয়েছে বিনিয়োগ খাতকে। মাত্র বছর পাঁচেক আগেও বাংলাদেশ প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই বিভিন্ন দাতা সংস্থাকেই অর্থায়নের একমাত্র নির্ভরযোগ্য মনে করত। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। একটু বেশি সুদে হলেও দাতাসংস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঋণ নেয়া হচ্ছে। যাতে সহজে দ্রুত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও দেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। চারটি কেন্দ্রের মধ্যে পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ি চলবে আমদানি করা কয়লা দিয়ে। রূপপুর পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র। বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো মোট ৭ হাজার ৫৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করবে। জানতে চাইলে বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন রূপকল্প বাস্তবায়ন করছেন। সেই রূপকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশ মধ্য আয় থেকে উন্নত দেশে পরিণত হবে। এজন্য ব্যাপক শিল্পায়ন দরকার। শিল্পায়নের প্রধান শর্তই হচ্ছে বিদ্যুত জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করা। বৃহত বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো নির্মাণের কাজ নিয়মিত তদারক করা হচ্ছে। এসব বিদ্যুতকেন্দ্র উৎপাদনে এলে দেশের অর্থনীতিতে কত বড় অবদান রাখবে তা এখনও অনেকে ভাবতে পারছেন না। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল তিন হাজার ২০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে সেটি তিনগুণ বেড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। আর স্থাপিত বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষমতা হয়েছে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। নয় বছরে বিদ্যুতখাতের এই বদলের পরও লোডশেডিং পিছু ছাড়েনি। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুত দেয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এসডিজি বাস্তবায়ন বিষয়ক বৈঠকে জানানো হয়, প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুত জিডিপিতে ৫৬ কোটি টাকার অবদান রাখে। এ হিসেবে ৪ বিদ্যুতকেন্দ্রের ৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার অবদান রাখবে জিডিপিতে। দেশের প্রথম আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র পায়রার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এরই মধ্যে কেন্দ্রটির এক চতুর্থাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। কেন্দ্রের এক নম্বর বয়লার স্থাপনের স্টিলের কাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে, দুই নম্বর বয়লারের ভিত তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তিন হাজার মানুষ দিনরাত কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য কাজ করছে। কেন্দ্রের সমান যৌথ মালিক বাংলাদেশের সরকারী প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও চীনের প্রতিষ্ঠান সিএমসি। ইপিসি ঠিকাদার এনইপিসি এবং সিইসিসি কনসোর্টিয়াম। নির্মাণ চুক্তি সইয়ের দিন থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ খরচ করার শর্ত দেয়া ছিল ঠিকাদারকে। যাতে চুক্তি সইয়ের পরপরই কেন্দ্রের কাজ শুরু করা গেছে। এখানেই আরেকটি সমান ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ করা হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণে দুই হাজার ৭০০ জন এক সঙ্গে কাজ করছেন। এরমধ্যে এক হাজার ২০০ জন চীনা নাগরিক রয়েছেন। ইতোমধ্যে অস্থায়ী কোল ইয়ার্ড নির্মাণ হয়েছে। এক নম্বর বয়লার কাজ শেষ হয়েছে, দুই নম্বর বয়লার কাজ শুরু হয়েছে। মেইন পাওয়ার বিল্ডিংয়ের ভিত্তি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ সার্ভিস রোড, পয়ঃনিষ্কাশন গড়ে তোলা হয়েছে। কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৫০ পুলিশের একটি ব্যারাক কাজ শেষ পর্যায়ে। এ ছাড়া পুনর্বাসন প্রকল্পে প্রায় সবগুলো বাড়ির কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। আলোচিত রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা ছিল ২০১৬ সালে। এ কেন্দ্র নির্মাণে পরিবেশবাদীদের সঙ্গে সরকারের ব্যাপক মতবিরোধ থাকায় কেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগোতে পারেনি বলে সরকারের দাবি। তবে এখন যেভাবে কাজ চলছে তাতে কেন্দ্রটির কাজ শেষ হবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর নাগাদ। এ কেন্দ্রের সমান মালিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও ভারতের সরকারী প্রতিষ্ঠান এনটিপিসি। কেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইপিসিএল) গঠন করা হয়েছে। গত ২৪ এপ্রিল থেকে কেন্দ্র নির্মাণের কাজ পুরোপুরি শুরু হয়েছে। সীমানা দেয়াল, অফিস ঘর নির্মাণ শেষ হয়েছে, পাইলিংয়ের কাজ চলছে। মূল কেন্দ্রের ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ শুরু হবে খুব শীঘ্রই। রামপাল প্রকল্পে ১৩২০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণের কথা ছিল। বর্তমানে সেখানে ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট নির্মাণের কাজ হচ্ছে। দ্বিতীয় ইউনিটটি নির্মাণ করা হবে না। তার বদলে সেখানে ২০০ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এদিকে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার বিদ্যুত কেন্দ্রটির মূল পর্বের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেছেন। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এরমধ্য দিয়ে বিদ্যুতকেন্দ্রটির মূল পর্বের অর্থাৎ পরমাণু চুল্লি বসানোর কাজ (ফাস্ট কংক্রিট পোরিং ডেট বা এফসিডি) শুরু হচ্ছে। এর আগে রূপপুরে আবাসন ছাড়াও অন্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদনে আসবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। আর দ্বিতীয় ইউনিট আসবে পরের বছর। পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^ ৩২তম দেশ হিসেবে নিউক্লিয়ার ক্লাবে যুক্ত হতে যাচ্ছে। দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক প্রকল্প পাবনার রূপপুরে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে বাংলাদেশ সরকার ঋণ নিচ্ছে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। তবে এ জন্য সুদে-আসলে রাশিয়াকে ফেরত দিতে হবে ২০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় রাশিয়ার কাছ থেকে নেয়া ৯১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার শুধু সুদ বাবদই সরকারকে ফেরত দিতে হবে ৬৯ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। প্রথম পর্যায়ের কাজের এখন পর্যন্ত চারটি চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তির আওতায় বিদ্যুত কেন্দ্রের নানা ধরনের সমীক্ষা থেকে শুরু করে প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত নির্মাণ করা অবকাঠামোর মধ্যে কংক্রিট মিক্সিংয়ের দুটো ইউনিট ছাড়াও এ্যামিনিটি বিল্ডিং, ক্যান্টিন, ওয়ার্কশপ, মালামাল উঠানামার জন্য নদী তীরবর্তী স্থাপনা, বহিস্থ সংরক্ষণাগার, কংক্রিট মিক্সিং ট্যাংক ও গাড়ি ধৌতকরণ এলাকা, বহিস্থ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্র এলাকায় দুটি ২০তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আরও এমন ১৯টি ভবনের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য রেল এবং নৌপথ উন্নয়ন করতে হবে। মংলা বা চট্টগ্রামের সঙ্গে সরাসারি রেলযোগাযোগ এবং নৌপথ খনন করতে হবে। এই পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে ৬০ বছর ধরে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যাবে। কেন্দ্রের এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিটটি ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার জন্য কার্যক্রম চলছে।
×