ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনে সতর্কতা

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২৯ নভেম্বর ২০১৭

ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনে সতর্কতা

সরকার ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রস্তাবিত সংশোধনের খসরা ইতোমধ্যে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে এবং জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার অপেক্ষায়। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন এই প্রথম নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার এই আইনের সংশোধনী আনা হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন যেমন হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন বা নেগোসিয়েবল ইন্সট্রুমেনট এ্যাক্ট ১৮৮১ যেখানে একবারও সংশোধন করা হয়নি, সেখানে ব্যাংক কোম্পানি আইনে একাধিকবার সংশোধনী আনা হয়েছে। এটা মোটেই দোষের কিছু নয়, বরং স্বাভাবিক এবং এটাই হওয়া উচিত। ব্যাংকিং ব্যবসা আর দশটা সাধারণ ব্যবসা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বতন্ত্র। ব্যাংক শুধু যে জনগণের গচ্ছিত অর্থ নিয়ে ব্যবসা করে তাই নয়, এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথেষ্ট নিয়মনীতি মেনে ব্যবসা পরিচালনা করতে হয়। প্রতিটা ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দেশীয় একাধিক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা কর্তৃক প্রণীত অনেক নিয়ম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে ব্যবসা পরিচালনা করতে হয়। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, আইসিসি (ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স), ব্যাসেল কমিটি, বিআইএস (ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট) সহ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক প্রণীত বিধিবিধান মেনে চলা প্রতিটি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধ্যতামূলক। তাছাড়া, ব্যাংকিং ব্যবসার ধরন এমন যে, এককভাবে বা দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসা করে খুব বেশি সুবিধা করা যায় না। বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বিশ্বের অনেক ব্যাংকের সঙ্গে সহযোগিতা বা পারস্পরিক লেনদেনের মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে বিধিবিধান মেনে চলার এবং একটা নির্দিষ্ট মান বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এসব কারণে ব্যাংককে বলা হয়ে থাকে সর্বাধিক নিয়ন্ত্রিত বা ওয়েল রেগুলেটেড এবং ওয়েল কমপ্লায়েন্ট একটি প্রতিষ্ঠান। আবার এসব বিধিবিধান, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক প্রণীত বিধিবিধানগুলো দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের দেশের ব্যাংক সংক্রান্ত নিয়মনীতি পরিবর্তন করতে হয়। এর অধিকাংশই বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় পরিপত্র বা সার্কুলার জারির মাধ্যমে করে থাকে। পরিবর্তনের ধরন আইনগত বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ারের বাইরে চলে যায় এবং তখনই ব্যাংক কোম্পানি আইনসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেই বিবেচনায় এই উদ্যোগের যথেষ্ট যথার্থতা রয়েছে। তবে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে যে ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কতা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে- ১. একই পরিবার থেকে পরিচালকের সংখ্যা দুই থেকে চারে বৃদ্ধি করা, ২. পরিচালকের একটানা দুই টার্মের পরিবর্তে তিন টার্ম অর্থাৎ ছয় বছর বৃদ্ধি করে নয় বছর থাকার বিধান এবং ৩. ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নেয়ার পরিবর্তে পরে অনুমতি নেয়ার বিধান প্রবর্তন করা। ব্যাংকের পরিচালকের মেয়াদ বৃদ্ধি তেমন কোন উল্লেখযোগ্য বিষয় নয়। পরিচালকরা হলেন ব্যাংকের মালিক পক্ষ বা বিনিয়োগকারী অথবা শেয়ারহোল্ডারদের প্রতিনিধিত্বকারী, তাই তারা নির্বাচিত হলে যতদিন খুশি ততদিন পরিচালনা পর্ষদে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। এতে কোন নির্দিষ্ট টার্ম বা সীমারেখা না রাখাই ভাল। একটা সর্বোচ্চ বয়স সীমা অবশ্যই থাকতে পারে। কিন্তু পরিচালকের সর্বাধিক মেয়াদের পরিবর্তে সবার আগে প্রয়োজন ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিচালকদের ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করা। শুধুমাত্র মূলধনের অংশ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ারের মালিক হওয়া বা শেয়ারহোল্ডারদের দ্বারা নির্বাচিত হওয়াই ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা হতে পারে না। পূর্বেই উল্লেখ করেছি ব্যাংকিং ব্যবসা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক নিয়মনীতি মেনে পরিচালিত হয়। তাছাড়া ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীসহ যে সকল পেশাদার ঊর্ধ্বতন ব্যাংকার ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন তাদের সঠিকভাবে বুঝতে পারা এবং যথাযথভাবে মূল্যায়ন করার সক্ষমতা প্রতিটা ব্যাংক পরিচালকের থাকা বাঞ্ছনীয়। অনভিজ্ঞ বা ন্যূনতম যোগ্যতা ছাড়া কোন ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালক হলে কি অবস্থা হয় তার বড় উদাহরণ সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক, বেসিক ব্যাংকসহ নানা ব্যাংকিং অনিয়ম। আমাদের দেশে ব্যাংকিং ব্যবসার শক্ত ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও এই খাতে আজ যে অব্যবস্থা বিরাজ করছে তার অন্যতম একটি কারণ ব্যাংকের পরিচালকদের ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারিত না থাকা। যে কেউ অর্থ থাকলেই ব্যাংকের শেয়ার ক্রয় করে পরিচালক হয়ে যাবে এমনটা হওয়া উচিত নয়। কেউ ব্যাংকের পরিচালক হতে চাইলে তাকে সবার আগে পরিচালকের ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন করতে হবে এবং তার পর প্রয়োজনীয়সংখ্যক শেয়ারের মালিক হবেন বা শেয়ারহোল্ডারদের সমর্থন আদায় করবেন। যদি কোন বিনিয়োগকারী বা শেয়ারমালিকের নিজের সেই ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকে তাহলে তিনি নিজে পরিচালক না হয়ে তার বিশ্বস্ত ন্যূনতম যোগ্যতাসম্পন্ন কাউকে পরিচালক হিসেবে মনোনীত করতে পারবেন যিনি সেই বিনিয়োগকারীর বা শেয়ারহোল্ডারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন। এই ব্যবস্থায়ই বিশ্বের অনেক দেশের ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয়ে থাকে। এভাবে আমাদের দেশের ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হলে একদিকে যেমন ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, অন্যদিকে তেমনি আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যবসা পরিচালনায় বিশেষ সুবিধা পাবে। তাই ব্যাংকের পরিচালকের সর্বোচ্চ সময় বা টার্মের বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে পরিচালকের ন্যূনতম যোগ্যতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এই প্রস্তাবিত সংশোধনীতে সংযুক্ত করা প্রয়োজন। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে অনেকেই মনে করতে পারেন যে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হলে ব্যাংকের মালিক বা শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুণœ হতে পারে। ধারণাটা আদৌ সঠিক নয়। কেননা তাদের মনোনীত ব্যক্তিরাই পরিচালনা পর্ষদে থেকে তাদের স্বার্থ রক্ষা করবেন। যদি তারা মনে করেন যে সেই মনোনীত ব্যক্তি তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করছেন না, তাহলে তারা চাইলে তাকে পরিবর্তন করে অন্য কোন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে পরিচালক হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারবেন। পরিচালকের ন্যূনতম যোগ্যতার বিষয়টি ব্যাংক কোম্পানি আইনে সন্নিবেশিত করার পাশাপাশি এ রকম বিধান সংযুক্ত করে মালিকপক্ষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা যেতে পারে। একই পরিবার থেকে পরিচালকের সংখ্যা দুই থেকে চারে উন্নীত করার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর এবং আধুনিক ব্যাংক ব্যবসার সঙ্গে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখার দাবি রাখে এবং প্রয়োজনে এই ধরনের সংশোধনী না আনাই শ্রেয়। তবে এই সংশোধনীর কারণে আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক বা বিদেশী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। যদি প্রস্তাবিত সংশোধনী পাস হয় এবং দুই সহোদর ভাই কোন একটি ব্যাংকের মালিক হন এবং তারা যদি পৃথক পরিবার হিসেবে বাস করেন, তাহলে সেই দুই ভাইয়ের পরিবার থেকে মোট আটজন পরিচালক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে থাকবেন যাদের পারিবারিক নাম (লাস্ট নেম) একই হবে। আর সেই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের মোট সদস্য সংখ্যা যদি বারজন হয় তাহলে দেখা যাবে যে মাত্র একটি পরিবারই পরিচালনা পর্ষদের ৬৭ শতাংশ দখল করে আছে। এই ধরনের মালিকানা সংবলিত ব্যাংককে আন্তর্জাতিক মহল সাধারণত পারিবারিক (ফ্যামিলি ওনড) ব্যাংক হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। আর বিশ্বের কোন ভাল ব্যাংকই পারিবারিক ব্যাংকের সঙ্গে কোন রকম ব্যবসায়িক লেনদেনে অংশ নিতে বা করসপনডেন্ট ব্যাংকিং করতে চায় না। উল্লেখ্য, কোন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চল্লিশ শতাংশ বা ততোধিক সদস্য একই পরিবারের হলে সেই ব্যাংককে আন্তর্জাতিক মহল পারিবারিক ব্যাংক হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের সঙ্গে লেনদেন সম্পর্ক স্থাপন করা থেকে বিরত থাকে। গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের কিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একেকটি শেখ পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি থাকায় সেসব ব্যাংকগুলোর সঙ্গে উন্নত বিশ্বের অনেক ব্যাংক লেনদেন সম্পর্ক ছিন্ন করে। এর ফলে সেই ব্যাংকগুলো ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ করে বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সেই ব্যাংকগুলো দ্রুত তাদের মালিকানা কাঠামোয় পরিবর্তন এনে কর্পোরেট পর্ষদ গঠন করে। যে ব্যবস্থা মধ্যপ্রাচ্যের সমৃদ্ধশালী দেশগুলো অনেক আগেই পরিহার করেছে তা কেন আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো এখন গ্রহণ করতে যাচ্ছে তা বোধগম্য নয়। এই বিষয়টির পরিণতির কথা বিবেচনা করে প্রস্তাবিত সংশোধনী থেকে এই মুহূর্তে একই পরিবার থেকে পরিচালকের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি বাদ দেয়াই বাঞ্ছনীয়। লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা [email protected]
×