ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

পরিবারতন্ত্র বিষয়ক

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ২৯ নভেম্বর ২০১৭

পরিবারতন্ত্র বিষয়ক

বত্রিশ বছর বয়সী সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সতের জন যুবরাজ, চার জন বর্তমান এবং বেশ ক’জন সাবেক মন্ত্রী গ্রেফতার হওয়ার পর রাজতান্ত্রিক সৌদি আরব আবার আলোচনায়। বছর দুয়েক আগে হজের আনুষ্ঠানিকতা শয়তানের উদ্দেশে পাথর ছোড়ার সময় বিশৃঙ্খলায় এক হাজার দুশো পঁয়ত্রিশ জন হাজী মারা গেলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সমালোচিত হয়েছিল সৌদি আরব। লেবাননভিত্তিক একটি আরবী দৈনিক এবং ইরানের তেহরান রেডিও ও অন্য একটি সংবাদ সংস্থা ওই ঘটনার পেছনে তখন দায়ী হিসেবে এই যুবরাজকে চিহ্নিত করেছিল। সে সময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রয়াত বাদশা আবদুল আজিজের এক পৌত্রির লেখা চিঠিও মিডিয়ায় এসেছিল। আলোড়ন তোলা দুই চিঠিতে হজের আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে মিনায় শয়তানের উদ্দেশে পাথর ছোড়ার সময়ের ‘দুর্ঘটনা’র বর্ণনা ছিল। পাশাপাশি ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িত হওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগে স্বজনপ্রীতির প্রসঙ্গও ছিল। সে বছরের শুরুতে বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ মারা গেলে তার জায়গায় ভাই সালমান আল সৌদের অভিষেক হয়। তিনি ভাইয়ের ছেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন নায়েফকে তার উত্তরাধিকারী এবং নিজের ছেলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমানকে তার ডেপুটি হিসেবে মনোনীত করেন। এ মনোনয়নের পেছনে নিকট-রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে কাজ করেছে এ দু’জনার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন নায়েফ যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ’র অন্যতম সহযোগী। এফবিআই এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অধীনে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রশিক্ষণ রয়েছে তার। শয়তানের উদ্দেশে পাথর ছুড়তে হাজীরা যখন মিনায় যাচ্ছিলেন তখন যুবরাজ সালমানও সেখানে গিয়েছিলেন বাবা বাদশা সালমান আল সৌদের সঙ্গে দেখা করতে। তার সঙ্গে ছিল প্রায় তিন শ’ পঞ্চাশ জন দেহরক্ষী এবং পুলিশের বিশাল এক বহর। যুবরাজের চলার পথ মুক্ত রাখতে হাজীদের জন্য নির্ধারিত পাঁচটি পথের দুটোই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এতে হাজীরা ভয়াবহ বিশৃঙ্খলায় পড়েন। হঠাৎই সামনের পথ রুদ্ধ দেখে তারা থমকে দাঁড়ান এবং অনেকে পেছনে ফেরার চেষ্টা করেন। কিন্তু এগিয়ে আসা লাখ লাখ মানুষের ভিড়ের চাপে পিষ্ট ও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেন এক হাজার দু’শ’ পঁয়ত্রিশ জন হাজী। আহতের সংখ্যাও মৃতের প্রায় কাছাকাছি। মৃতের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন পরিসংখ্যানও রয়েছে। শয়তানের উদ্দেশে পাথর ছোড়ার আনুষ্ঠানিকতা নিরাপদ ও সুসংগঠিত করার জন্য দু’হাজার ছয় সালে সৌদি সরকার মিনায় বারোতলা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে। যার কিছু অংশের কাজ এখনও চলছে। সেতুর বিভিন্ন তলায় দাঁড়িয়ে ঘণ্টায় প্রায় তিন লাখ হাজী পাথর ছুড়তে পারেন। এই সেতুতে যাওয়ার পাঁচটি পথের দুটি বন্ধ রাখা হয়েছিল যুবরাজের আগমন উপলক্ষে। এসব তথ্য ধামাচাপা দেয়ার অনেক চেষ্টা করলেও ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। দায়িত্বহীনতা এবং অব্যবস্থাপনার জন্য অভিযোগের তীর যখন হজ কর্তৃপক্ষের দিকে তখন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আল শেখ তাদের পিঠ বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। সবকিছু হয়েছে ‘আল্লাহর ইচ্ছায়।’ এই আপ্ত বাক্যে তিনি সব অভিযোগ নাকচ করার চেষ্টা করেন। হজের শেষ দিন তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সৌদি সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী মোহাম্মদ বিন নায়েফকেও সে কথাই বলেছেন যে, এদের নিয়তিতে যা লেখা ছিল তাই ঘটেছে। এ জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দায়ী হতে পারেন না। অর্থাৎ অব্যবস্থাপনার দায় তারা স্বীকার করেননি। সৌদি শাসনে গ্র্যান্ড মুফতির কাজ হচ্ছে মূলত সৌদি রাজতন্ত্রের স্বার্থরক্ষা করা। এ উদ্দেশ্যেই উনিশ শ’ তেপ্পান্ন সালে সৌদি বাদশা আবদুল আজিজ সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার এ পদ সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু মুফতি বা অন্যান্য নেতা আত্মপক্ষ সমর্থনে যাই বলুন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবরাজের চিঠি সৌদি সরকারের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও অব্যবস্থাপনার চিত্রই তুলে ধরেছিল। ব্রিটিশ দৈনিক ‘ইন্ডিপেন্ডেট’কে এই যুবরাজ বলেছিলেন, সৌদি আরবের বারো যুবরাজের আটজনই বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজকে চান না। ঊনআশি বছর বয়সী সালমানকে সরিয়ে এক সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যুবরাজ আহমেদ বিন আবদুল আজিজকে সিংহাসনে বসাতে চান। তার মতে, শতকরা পঁচাত্তর ভাগ উলামা এবং ধর্মীয় নেতাও আহমেদকে পছন্দ করেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক ‘দুর্নীতিবিরোধী অভিযান’ ওই অব্যবস্থাপনারই আরেক চিত্র। অন্য খবরও আসছে। সপ্তাহ কয়েক আগে যুবরাজ সালমান আন্তর্জাতিক পরিম-লের কয়েকজন ব্যবসায়ীকে নিয়ে রিয়াদে বিনিয়োগ সম্মেলন করেছিলেন। সেখানে তিনি সৌদি আরবের আধুনিকায়নের কথা বলেন। তেলের বাইরে সৌদি অর্থনীতির জন্য ভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা খোঁজার কথা বলেন। সালমান বিন আবদুল আজিজ বাদশাহর দায়িত্ব নেয়ায় রাজপরিবারে বিদ্রোহের গুঞ্জন চলছে। পত্র লেখক ওই যুবরাজ ইন্ডিপেন্ডেন্টকে বলেছিলেন, শাসক হিসেবে সালমানের কিছু সিদ্ধান্তে তার ‘কাছের লোকেরা’ও অসন্তুষ্ট। নিজের ছেলে তিরিশ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন সালমানকে ‘ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স’ বানানো, ইয়েমেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানো এবং হজ অব্যবস্থাপনায় সালমানের জনপ্রিয়তা আরও কমেছে। এসব কথা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনায় রাজপরিবারে বিদ্রোহের সুর শুধু নয়, গোটা সৌদি রাজতন্ত্রই কেঁপে উঠতে পারে বলে সে সময় অনেকে বলেছিলেন। সতেরো শ’ চুয়াল্লিশ সালে মোহাম্মদ বিন সৌদ সৌদি রাজপরিবারের গোড়াপত্তন করেন। তার নামে দেশের নাম হয় সৌদি আরব। বর্তমান সময়ে এসে সারাদেশে এ পরিবারের পনেরো হাজার সদস্য থাকলেও রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত রয়েছে দু’হাজার সদস্যের মধ্যে। এই দীর্ঘ কালপরিক্রমায় সৌদি রাজবংশের শাসন স্থায়ী করতে রাজতান্ত্রিক এ ব্যবস্থাকে ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। পদাধিকার বলে সৌদি বাদশাহ মক্কা এবং মদিনায় মুসলমানদের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ দুই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ-উল হারাম এবং মসজিদ-ই নববীর রক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এতে ‘মুসলিম বিশ্বে’র শাসন ব্যবস্থাকে ইসলামসম্মত এবং রাজপরিবারকে ইসলামের রক্ষক হিসেবে পবিত্র একটি ভাবমূর্তি তৈরি হয়। ওই ভাবমূর্তি সৌদি আরবকে মুসলিম বিশ্বের নেতা বানিয়েছে এবং সৌদি রাজতন্ত্রকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। এর পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপরিসীম অবদান রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক সৌদি আরব। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন ইত্যাদি দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক যেসব চক্রান্ত বাস্তবায়ন করেছে তার প্রত্যক্ষ সহযোগী সৌদি আরব। তেলসমৃদ্ধ দেশ কাতার, কুয়েত, বাহরাইন ও আরব আমিরাতকে সঙ্গে নিয়ে ইয়েমেনের রাজধানী সানায় হুতি জনগোষ্ঠীর ওপর আগ্রাসন চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে এফ-পনেরো জঙ্গী বিমান, এ্যাপাচে হেলিকপ্টার গানশিপ, সাঁজোয়া যান এবং আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ ক্লাস্টার বোমা যোগান দিয়েছে। অনেক আগ্রাসন প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর সে চালায় যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসা চাঙ্গা রাখতে। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, নারী অধিকার, মানবাধিকার, পরমত সহিষ্ণুতা সৌদি আরবে নেই। সংবাদপত্র ও সরকারী বিধিনিষেধের পরিধির মধ্যে থেকে সংবাদ পরিবেশন করে। খবর প্রকাশের স্বাধীনতা নেই, এরপরও আশ্চর্যজনকভাবে দেশটি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্যানেলের প্রধান নিয়োজিত হয় এবং এ সিদ্ধান্তকে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র তার দেশের পক্ষে স্বাগত জানালে বিশ্ববাসী বুঝে নেয় মাসতুতো ভাইয়ের বড় ভাই যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস-আগ্রাসন চালানোর বেলায় ভাল মানুষী একটি মুখোশ পরে নিলেও সৌদি আরব ওসব বালাইয়ের ধার ধারে না। তাতে দু’দেশের মধ্যে গলায় গলায় ভাব রাখায় কোন অসুবিধাও হয় না।
×