ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাপান জার্মানি সুইডেন ও ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ক্যাম্প পরিদর্শন

রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতনের কথা শুনে তারা বিস্মিত

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২০ নভেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতনের কথা শুনে তারা বিস্মিত

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বর্বরোচিত কায়দায় হত্যা নিধন, ধর্ষণ ও বিতাড়নসহ মানবতাবিরোধী নানা ঘটনা নিয়ে রবিবার পর্যন্ত ৮৬ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এখনও দু’দেশের সীমান্ত এলাকা উন্মুক্ত। মিয়ানমার সীমান্ত খোলা রয়েছে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে আসার জন্য। আর টেকনাফ থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমান্ত পয়েন্টগুলো খোলা রয়েছে রোহিঙ্গাদের আগমনের জন্য। মিয়ানমার সরকার ও তাদের সামরিক জান্তা বাহিনীর প্রণীত নীলনক্সা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতা চালিয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য করছে। আর মানবিকতার বিষয়টি সবকিছুর উর্ধে রেখে বাংলাদেশ এসব অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ রবিবারও ৫ শতাধিক রোহিঙ্গার আগমন ঘটেছে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে। এছাড়া অন্য পয়েন্টগুলো দিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে রোহিঙ্গা আগমন অব্যাহত রয়েছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ৭ লাখ ছাড়িয়েছে বলে বেসরকারী বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বেরিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সারাবিশ্ব সোচ্চার। কিন্তু মিয়ানমার তার মানবতাবিরোধী নীতিতে অবিচল রয়েছে। একজন রোহিঙ্গাও যাতে সীমান্ত গলিয়ে সে দেশে যেতে না পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করে রেখেছে বিভিন্ন পন্থায়। অথচ রোহিঙ্গারা এদেশে চলে আসার ক্ষেত্রে মিয়ানমার সচেতনভাবেই কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না। দিন যতই গড়াচ্ছে রোহিঙ্গা আগমনের সংখ্যা ততই বাড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা বাংলাদেশে তাদের নিয়োজিত দূতাবাস কর্মী, আন্তর্জাতিক দাতা, সাহায্য সংস্থাসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে রোহিঙ্গাদের পাশে থেকে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার ইতোমধ্যেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যে চারটি শর্ত আরোপ করেছে এর একটিও বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের আগামীর পরিস্থিতি কোন্ পর্যায়ে যাচ্ছে ইতোমধ্যে নানা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়ে আছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা আগমনের ঘটনায় পুরো কক্সবাজার অঞ্চল এখন রোহিঙ্গাদের জন্য রীতিমতো চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। অসহায়ত্ব বরণ করে আছে সেখানকার স্থানীয়রা। যদিও মিয়ানমার দাবি করে যাচ্ছে, এই পরিস্থিতি রোহিঙ্গারা নিজেরাই সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সারাবিশ্ব বলছে মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার আসল ঘটনা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সর্বশেষ রবিবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জার্মানি, সুইডেন ও জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখে তারা বিস্মিত হয়েছেন। তাদের সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন। বিদেশী পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আসেম সম্মেলনে তারা কথা বলবেন। নতুন এসেছে ৫ শতাধিক ॥ রবিবার ভোরে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ, শামলাপুর ও উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়া পয়েন্ট দিয়ে নতুন করে ৫ শতাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাখাইনে ইতোপূর্বেকার মত জ্বালাও পোড়াও বা গণহত্যার ঘটনা না থাকলেও সে দেশের সেনাবাহিনী ও মগ সন্ত্রাসীরা যে আচরণ করছে তাতে সেখানে বসবাসের কোন পরিবেশ নেই। তারা বাধ্য হয়ে এদেশে চলে আসছে। জীবনবাজি রেখে এরা ভেলায় চড়ে আসা অব্যাহত রেখেছে। আগত নতুন রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখনও মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। এছাড়া সেখানকার গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত। তাই আসল ঘটনা মিয়ানমারবাসীও জানতে পারছে না। উল্টো প্রচার চালানো হচ্ছে, রাখাইন রাজ্য শান্ত। সেখানে ইতোপূর্বে যা ঘটেছে তা রোহিঙ্গারা নিজেরা ঘটিয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর একটি মিথ্যাচারের প্রতিবেদন দেশবাসীকে জানানো হচ্ছে। যেখানে দাবি করা হচ্ছে, সেনাবাহিনী গণহত্যা, গণধর্ষণ, জ্বালাও পোড়াও ও নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত নয়। অথচ রাখাইনে বিক্ষিপ্তভাবে রোহিঙ্গারা নানাভাবে হুমকির মুখে রয়েছে। কেন এখনও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ॥ গত ৮৬ দিন ধরে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এটা প্রমাণিত সত্য যে, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও উগ্র মগ সন্ত্রাসীরা যে বর্বরতা চালিয়েছে তা প্রমাণিত সত্য। বিশ্বজুড়ে বিষয়টি স্পষ্টভাবে ধরা পড়ার পর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও মগ সন্ত্রাসীরা তাদের নিপীড়নের মাত্রা কমিয়েছে। কিন্তু একেবারে বন্ধ করেনি। এসব তথ্য দিচ্ছে নতুন করে আগত রোহিঙ্গারা। তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের আর কিছুই নেই। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। কেড়ে নেয়া হয়েছে সহায় সম্পদ। নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে বহু আগে। ভোটাধিকারও নেই। এখন স্বাভাবিক চলাফেরাও তারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর অপরদিকে, আগে ভাগে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা তাদের চলে আসার জন্য প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিচ্ছে। কেননা, আশ্রয় ও জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা তারা পাচ্ছে। ফলে রাখাইন রাজ্যে সেনা ও মগ সন্ত্রাসীদের অত্যাচার এড়াতে এবং আগামীতে জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার বিষয়টি গভীর শঙ্কায় নিপতিত হয়ে থাকায় তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পথ বেছে নিচ্ছে। এখনও রাখাইনে সেনা ও মগ সন্ত্রাসীদের চোখ রাঙানি, হুমকি ধমকি, বিক্ষিপ্তভাবে মারধর, নিপীড়ন চলছে। এসব অনিশ্চিত পরিস্থিতি নিয়ে তাদের এদেশে পালিয়ে আসা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই। মিয়ানমারের চার শর্ত প্রত্যাবাসনে বড় অন্তরায় ॥ বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার ইতোমধ্যে যে চার শর্ত দিয়েছে তা বড় ধরনের অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কেননা, রোহিঙ্গাদের কারও কাছে নাগরিকত্বসহ সে দেশে বসবাসকারী হিসেবে কোন প্রমাণপত্র নেই। যাদের কাছে যৎসামান্য যেসব প্রমাণাদি ছিল তা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। এছাড়া অত্যাচার নিপীড়নের মাত্রা এত বেশি ছিল যে, ওরা সর্বস্ব ফেলে শুধু প্রাণ নিয়ে এদেশে চলে এসেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে চার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ॥ রবিবার সকালে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন জাপান, জার্মানি, সুইডেন ও ইইউর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। তাদের সফরসঙ্গী হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে ৩টি হেলিকপ্টারযোগে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনো, জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গেবরিয়েল, সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগট ওয়ালস্টার ও ইইউ পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান ফেদেরিকো মগেরিনি। তারা উখিয়া ও টেকনাফের বালুখালি, কুতুপালংসহ বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এসব ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। এর আগে শনিবার তারা ঢাকায় এসে পৌঁছান। ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে বিদেশী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের পক্ষে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনো এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের করুণ চিত্র তারা দেখেছেন। তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের কথা শুনেছেন। তারা জাতিগত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে। তাদের বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বিতাড়িত হতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে কাজ করে যাব। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে নাগরিকত্বসহ তাদের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আগামী ২০-২১ নবেম্বর মিয়ানমারে অনুষ্ঠিতব্য আসেম সম্মেলনে বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরবেন। বিকেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ঢাকা ফেরত যান। এইডস রোগী ৭৮ ॥ মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের মধ্যে রবিবার পর্যন্ত ৭৮ এইড রোগে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ২৮ পুরুষ, ৩৮ নারী ও ১২ শিশু রয়েছে। কক্সবাজারের সিভিল সার্জন আবদুস সালাম জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিকভাবে রেকর্ড অনুযায়ী মিয়ানমারে এইড রোগের প্রকোপ বেশি। আগত রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইডস রোগীর সংখ্যা আরও যে বাড়তে তা নিশ্চিত। কারণ এ রোগ আক্রান্তদের কাছ থেকে সংক্রমিত হচ্ছে তাদের শিশুদের মাঝেও। রোহিঙ্গা আধিক্যে বনাঞ্চলের পাশাপাশি বন্য প্রাণীকুলও ক্ষতিগ্রস্ত ॥ নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে টেকনাফ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের যত্রতত্র অবেধ বসতি গড়ে তোলার জের হিসেবে বনাঞ্চল যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি বন্যপ্রাণীকুলও হুমকির মুখে রয়েছে। বিশেষ করে হাতি চলাচলের উন্মুক্ত পথ রুদ্ধ হওয়ায় এখন হাতির পাল হানা দিচ্ছে টেকনাফ, হৃলা, হোয়াইকং ও বাহারছড়ার বিভিন্ন পয়েন্টে। এরা চাষাবাদের ফসলি জমি বিনষ্ট করছে। হোয়াইকংয়ের হরিকুলার লাবং সিং চাকমা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের অবৈধ বসতির কারণে বন্যপ্রাণীদের স্বাভাবিক অবস্থান নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে এরা লোকালয়ে পর্যন্ত হানা দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর দাবি ॥ এদিকে উখিয়া টেকনাফ অঞ্চলের স্থানীয়দের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের অনতিবিলম্বে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর দাবি জোরালো হচ্ছে। স্থানীয়দের বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হলে শুধু কক্সবাজার অঞ্চল নয়, গোটা দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া প্রত্যাবাসনের আগ পর্যন্ত এদের আলাদা করে রাখা অত্যন্ত জরুরী। অন্যথায় এরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় মিশে যাবে। এতে তাদের যে মাঝে যে জটিল রোগব্যাধি রয়েছে তা বাংলাদেশীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
×