ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

এনসিটিবির অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১৬ নভেম্বর ২০১৭

এনসিটিবির অনিয়ম

দেশে প্রতিবছর পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ ও সরবরাহ নিয়ে যে ব্যাপক অনিয়ম হয়ে থাকে তার ভয়াবহ ও আশঙ্কাজনক বিবরণ উঠে এসেছে টিআইবির এক প্রতিবেদনে। উল্লেখ্য, এই কাজটির দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি। প্রতিষ্ঠানটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়টি সুবিদিত। ইতোপূর্বে মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কট্টর মতাদর্শ ও পরামর্শে পাঠ্যপুস্তকের মর্জিমাফিক পরিবর্তনসহ ভুল মুদ্রণের অভিযোগ উঠেছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। এবার উঠেছে ব্যাপক আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ। বছরে দুটি উৎসব বোনাস সব সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ থাকলেও এনসিটিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতি বছর নিয়ে থাকেন ৬টি উৎসব বোনাস। নানা ছুতোয় উর্ধতন থেকে শুরু করে কর্মচারী পর্যন্ত নিয়ে থাকেন সম্মানী ভাতা, যার পরিমাণ প্রায় ৩০ লাখ। প্রতি বছর পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ এবং সরবরাহের নামেও চলে ব্যাপক দুর্নীতি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ কেউ অর্থের বিনিময়েই মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে আগাম জানিয়ে দেন প্রাক্কলিত ব্যয়। কেউ কেউ এমনকি নামে- বেনামে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মালিক। পা-ুলিপি প্রণয়নের নামে স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ চাপিয়ে দেয়াসহ অফিসে বসেই শেয়ার ব্যবসা, এনজিও পরিচালনাসহ মুদ্রণকাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার অভিযোগও আছে। আছে নিম্ন মানের কাগজ ও মুদ্রণের অভিযোগ। এর সঙ্গে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো রয়েছে বিপুল আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে সহায়ক পাঠ্যপুস্তক ও গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্য। সত্যি বলতে কি এনসিটিবির এই বিষয়টি একরকম ওপেন সিক্রেট, যা নিয়ে প্রতিবছরই বিস্তর লেখালেখি হলেও প্রায় কোন প্রতিকারই মেলে না। শিক্ষামন্ত্রী এ নিয়ে যৎসামান্য সাফাই গাইলেও প্রতিষ্ঠানটির সর্বত্র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই বললেই চলে। এও সত্য যে, দেশের প্রবীণ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। তবে তাদের সবাই যে অনিয়মকে প্রশ্রয় দেন তা ভাবা ঠিক নয়। এনসিটিবির ভাবমূর্তি রক্ষার্থে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট, সতর্ক ও উদ্যোগী হতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। দেশের শিক্ষানীতি নিয়ে বোলচাল চলছে স্বাধীনতার পর থেকেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষাও কিছু কম হয়নি। সবচেয়ে যা দুঃখজনক তা হলো, একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী গঠনমূলক ও স্বনির্ভর একমুখী শিক্ষানীতি আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, প্রণয়ন করা পর্যন্ত সম্ভব হলো না। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষাই চলছে কয়েক স্তরে। একদিকে প্রাথমিক শিক্ষা, অন্যদিকে এবতেদায়ী শিক্ষা ও কওমী মাদ্রাসা। কিন্ডার গার্টেনসহ ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলও চলছে। কোনটির সঙ্গে কোনটির সমন্বয় নেই। পাঠ্যপুস্তকসহ সিলেবাসও আলাদা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থাও তথৈবচ। কোন সমন্বয় নেই। কে কি কোথায় কখন কিভাবে বাস্তবায়ন করবেন তা জানে না কেউই। দেশে শিক্ষা নিয়ে সৃজনশীল ও মৌলিক চিন্তার অভাব আছে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নত ও সমৃদ্ধ একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নসহ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নেও সমস্যা বিরাজমান। প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে মাদ্রাসা ও কিন্ডার গার্টেন শিক্ষার সমন্বয় সাধন ও আধুনিকীকরণ অত্যাবশ্যক ও জরুরী। শিশুদের জন্য একাধিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত থাকলে, শুরুতেই তা হোঁচট খেতে বাধ্য। সে অবস্থায় ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের আলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। এর পাশাপাশি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাস্তর বাস্তবায়নের সমস্যাগুলো দূর করতে হবে ধাপে ধাপে। অবকাঠামো বিনির্মাণসহ শিক্ষকদের নিবিড় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তদনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক, যা হবে আধুনিক ও যুগোপযোগী। একাধিক মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের পরিবর্তে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা আনতে হবে একক মন্ত্রণালয়ের অধীনে। বর্তমানে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আশানুরূপ নয়। দীর্ঘদিন থেকে কায়েমী একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এর পেছনে কাজ করছে। শিক্ষার মান উন্নয়নসহ যথাযথ শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে এসবই দূর করতে হবে অবিলম্বে।
×