ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শিশু নাগরিক হবে

জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিধান রেখে হচ্ছে নাগরিকত্ব আইন

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১০ নভেম্বর ২০১৭

জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিধান রেখে হচ্ছে নাগরিকত্ব আইন

তপন বিশ্বাস ॥ জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিধান অন্তর্ভুক্ত করে ‘নাগরিকত্ব আইন ২০১৭’-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। নতুন আইন অনুযায়ী যে কোন শিশু বাংলাদেশে জন্ম নিলে ওই শিশু জন্মসূত্রে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব লাভ করবে। ২০১৬ সালে মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদিত খসড়ায় এই বিধান ছিলনা। বর্তমান আইনটি বিলুপ্তির প্রস্তাব করে নতুন নাগরিকত্ব আইন ২০১৭ খসড়া প্রণীত হয়েছে। এই আইন কার্যকর হলে সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় লক্ষাধিক শিশু বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করবে। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে (মিয়ানমার) ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আইনগত জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, ২০১৬ সালে মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদিত খসড়ায় জন্ম সূত্রে নাগরিকত্ব লাভের ক্ষেত্রে ভূমিষ্ঠ শিশুর পিতা-মাতাকে ১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার বাধ্যবাধকতার বিধান রাখা হয়েছিল। মন্ত্রিসভার কতিপয় নির্দেশনা সংযোজনের জন্য নাগরিকত্ব আইনের ফাইলটি আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। এতে নতুন আইনের খসড়ায় জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব লাভের ক্ষেত্রে শিশুর পিতা-মাতার নাগরিকত্ব থাকার শর্তটি বাদ দিয়ে নতুন করে বিধানটি প্রস্তুত করা হয়েছে। ১৯৫২ সালের আইনে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব লাভের বিধান রয়েছে। বর্তমানে নতুন আইনের খসড়ায়ও এ বিধানটি রাখা হয়েছে। আইনটি বলবত হলে বিদ্যমান ‘দ্য সিটিজেনশিপ এ্যাক্ট ১৯৫১’ এবং ‘দ্য বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ (টেম্পোরারি প্রভিশন) অর্ডার, ১৯৭২’ (অর্ডার নং ১৪৯ অব ১৯৭২) রহিত হবে। বৈবাহিকসূত্রে নাগরিকত্ব খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কোন নাগরিকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে তাকে নির্ধারিত শর্ত সাপেক্ষে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রেও আবেদনকারীকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কমপক্ষে তিন বছর বাংলাদেশে বসবাস করতে হবে। উক্ত তিন বছরের মধ্যে চিকিৎসা, শিক্ষা অথবা জরুরী প্রয়োজনে বাংলাদেশের বাইরে গমন করতে সাময়িক অবস্থানকাল পরবর্তীতে তাকে বাংলাদেশে অবস্থান করে প্রথম আগমনের সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের মধ্যে মোট তিন বছর পূর্ণ করতে হবে। এ সময়কে বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে বসবাসের আওতাধীন বলে গণ্য হবে। এই ধারায় আরও বলা হয়েছে, নাগরিকত্ব লাভের পর কোন কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী স্বামী বা স্ত্রীর নাগরিকত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সন্তানদের নাগরিকত্ব বহাল থাকবে। নিবন্ধনসূত্রে নাগরিকত্ব কোন সাবালক এবং সমর্থ ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিবন্ধন করা যাবে। যদি তার পূর্বপূরুষ (জীবিত অথবা মৃত) অবিভক্ত ভারতে জন্মগ্রহণ করেন; তিনি বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হন এবং আবেদনপত্র অব্যবহিত পূর্বে কমপক্ষে পাঁচ বছর বাংলাদেশে বসবাস করেন। তবে শর্ত থাকে যে-উল্লেখিত পাঁচ বছরের মধ্যে তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে তিন বছর বাংলাদেশে বসবাস করতে হবে। বাংলাদেশের বাইরে তার অবস্থান একাধারে ছয়মাসের বেশি হতে পারবে না। আবেদনের আগে একাধারে কমপক্ষে তিন মাস বাংলাদেশে বসবাস করতে হবে। এ সকল শর্ত পূরণ করতে তিনি বাংলাদেশের স্থায়ী আবাসিক অধিকার সনদ অর্জন করার যোগ্য হবেন। অপরাধ সংঘটন ও পুনঃ সংঘটনের দ- এই আইনের অধীনে অসদুদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়ে মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য প্রদান বা তথ্য গোপন করলে তিনি সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত কারাদ- অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। যদি কোন ব্যক্তি পুনরায় একই অপরাধ সংঘটন করেন সে ক্ষেত্রে প্রথমবারে কৃত অপরাধের জন্য বর্ণিত দ-ের পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রবাসে অর্জিত নাগরিকত্বের কারণে এই আইনে নিজ দেশের অর্জিত নাগরিকত্বের অবসান ঘটবে না। সে ক্ষেত্রে নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় আবেদনের পর তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা যাবে। এটি দ্বৈত নাগরিকত্ব হিসেবে গণ্য হবে। কোন বাংলাদেশী নাগরিক কোন কারণে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের অবসান ঘটানোর পর বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পন্থায় তার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পুনর্বহালের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করলে তা বিবেচনায় নিয়ে অন্য কোন আইন দ্বারা বারিত না হলে তার নাগরিকত্ব পুনর্বহাল করার বিধান রাখা হয়েছে। জন্মসূত্রে নাগরিক আইনটি বলবত হলে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি জন্মসূত্রে নাগরিক হবেন। আগের খসড়ায় বলা ছিল বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি জন্মসূত্রে নাগরিক হবেন, যদি তার পিতা বা মাতা এই আইন বলবত হওয়ার তারিখে বা এর পরে অথবা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে এই আইন বলবত হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হন বা থাকেন। এখন এই শর্তটি উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, এই আইন বলবত হওয়ার পর দুই বছর বয়স পর্যন্ত কোন শিশু বাংলাদেশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেলে এবং যদি সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু প্রকাশ না পায় তাহলে ওই শিশু বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে বলে ধরে নিয়ে তাকে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক করা যাবে। বংশসূত্রে নাগরিকত্ব কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের বাইরে অন্য কোন দেশে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হবেন। তবে তার পিতা বা মাতা বংশসূত্র ছাড়া ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে এই আইন বলবত হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অন্য কোনভাবে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকলে, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হবেন। তবে কোন ব্যক্তির পিতা বা মাতা কেবল বংশসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার কারণে উক্ত ব্যক্তি এই আইনের অধীনে বাংলাদেশের নাগরিক হবেন না, যদি বাংলাদেশী কনস্যুলেট বা দূতাবাসে তার জন্মের এক বছরের মধ্যে নিবন্ধন করা না হয়; তিনি যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন সে দেশের নিয়ম অনুযায়ী জন্মনিবন্ধন সনদপ্রাপ্ত না হন; অথবা জন্মকালে তার পিতা বা মাতা বাংলাদেশ সরকারের অধীনে কিংবা প্রেষণে/লিয়েনে অন্যত্র চাকরিতে না থাকেন। বাংলাদেশে স্থায়ী আবাসিক অধিকার যদি কোন ব্যক্তি নির্ধারিত অঙ্কে বৈদেশিক মুদ্রায় বা বৈদেশিক মূলধন ও যন্ত্রপাতি বা উভয় প্রকারেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেন বা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ও অঙ্কে বাংলাদেশের কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন এবং এতদুদ্দেশ্যে বাংলাদেশে নির্ধারিত সময়কাল অবস্থান করেন, তাকে বাংলাদেশে স্থায়ী আবাসিক অধিকার সনদ প্রদান করা যাবে। তবে তিনি এই ধারার অধীনে নাগরিকত্ব অর্জন না করা পর্যন্ত, তাকে বাংলাদেশের একজন স্থায়ী নিবাসী বলে গণ্য করা হবে। এ ছাড়া খসড়ায় নাগরিকত্ব প্রদান সংক্রান্ত বিষয়ে-নিবন্ধিত বা অনিবন্ধিত জাহাজ বা উড়োজাহাজে জন্মগ্রহণ, দেশীয়করণসূত্রে নাগরিকত্ব, ভূখ- সংযোজনসূত্রে নাগরিকত্ব, স্থায়ী নিবাসের সনদ, নিবন্ধন এবং দেশীয়করণের মাধ্যমে অর্জিত নাগরিকত্বের কার্যকারিতা, নিবন্ধন বহি, নিবন্ধন সনদ, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নিবন্ধন সংশয়ের ক্ষেত্রে প্রদত্ত নাগরিকত্ব সনদ, নাগরিকত্ব পরিত্যাগ, নাগরিকত্বের অবসান পুনর্বিবেচনা ইত্যাদি ধারা সংযোজিত হয়েছে।
×