ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থবছরের প্রথম দু’মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ১৮১ কোটি ডলার

ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ॥ রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৭ নভেম্বর ২০১৭

ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ॥ রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বাড়ছে

রহিম শেখ ॥ রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বাড়ছে। যার ফলে দেখা দিয়েছে বাণিজ্য ঘাটতি। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৮১ কোটি ডলার; যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি। এই আমদানিজনিত চাপে দেশের ভেতরে বেড়েছে ডলারের চাহিদা। ফলে চাহিদার তুলনায় ডলারের যোগান কমে গেছে। এই অবস্থায় আমদানি খরচ মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার টানাটানিতে পড়েছে অনেক ব্যাংক। সঙ্কট উত্তরণে ডলার কেনার বদলে দেদার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ঘটছে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় এক টাকা। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে প্রায় ২ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, বর্তমানে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা ৭০ পয়সায়। এদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে গত তিন মাসে মূল্যস্ফিতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ, যা সরকারের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। এই অবস্থায় আমদানি ব্যয় অব্যাহত বাড়তে থাকলে মূল্যস্ফিতি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মূলত আমদানির ব্যয়ের চেয়ে রফতানি আয় কম হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে। শুধু বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধিই নয়, এ সময়ে চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) ঘাটতিতে রয়েছে দেশ। এই ভারসাম্যে ঘাটতি অর্থনীতির জন্য খারাপ না ভল ? এক কথায় এর কোন উত্তর নেই। এটি নির্ভর করে উদ্বৃত্ত বা ঘাটতির প্রকৃতির ওপর। সাধারণত কোন দেশের রফতানির তুলনায় আমদানি অনেক বেশি হলে বাণিজ্য ঘাটতি থেকে চলতি হিসেবে ঘাটতি তৈরি হয়। রেমিট্যান্সও এ হিসাবের একটা উপাদান। রফতানি ও রেমিট্যান্স বেশি হলে উদ্বৃত্ত থাকে। সামগ্রিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগ ও ঋণের বিষয়টি সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের লেনদেনের ঘাটতি মূলত আমদানি অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণেই হচ্ছে। রেমিট্যান্স কমে যাওয়াও একটা কারণ। চলতি অর্থবছরের মাত্র দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ১৮১ কোটি ডলার বা সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। গত অর্থবছরে পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ ৯৪৭ কোটি ডলার, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত অর্থবছরে চলতি হিসাবে ১৪৮ কোটি ডলারের ঘাটতি হয়। তবে সামগ্রিক লেনদেনে ৩১৭ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সামগ্রিক লেনদেনে প্রায় ২১ কোটি ডলার ঘাটতি হয়েছে। আর চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ৪৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশে গত অর্থবছরে রফতানি বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ। রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে ৯ শতাংশ। গত ২ মাসে আমদানি বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। বাণিজ্য ঘাটতির এই চিত্র উদ্বেগজনকই মনে করেন বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর যে হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে লেনদেন ঘাটতিকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেছে। কেননা, এর প্রভাবে ইতোমধ্যে টাকার দর কমে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অনেক সময় বিনিয়োগজনিত কারণে আমদানি বেড়ে লেনেদেন ঘাটতি তৈরি হলে তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়। তবে বাংলাদেশে বিনিয়োগের কারণেই বেশি আমদানি হচ্ছে তা বলা যাবে না। কারণ চাল সঙ্কটের কারণে খাদ্য আমদানি বেড়ে গেছে। জ্বালানি তেলের দামও বাড়ছে। আমদানি ব্যয় দ্রুত বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। তারা বলছেন, প্রকৃত আমদানি বাড়লে অর্থনীতিতে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু আমদানির নামে অর্থ যদি পাচার হয় তাহলে ফল নেতিবাচক হবে। এ বিষয়ে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, সাম্প্রতিক রফতানি ও আমদানির ধারা দেখলে দেখা যায় এ দুটির মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্য হচ্ছে না। আমদানির ক্ষেত্রে মূলধনী যন্ত্রপাতির বাইরে পেট্রোলিয়াম, খাদ্যপণ্য প্রভৃতি অনেক বেশি আমদানি হচ্ছে। বিনিয়োগেও শ্লথ অবস্থা দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, রফতানির ক্ষেত্রে যেভাবে মূল্যপতন হচ্ছে আমদানির ক্ষেত্রে সেভাবে হচ্ছে না। এতে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। আমদানি-রফতানির নামে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে কিনা সে বিষয়টা খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। এদিকে আমদানিজনিত চাপে দেশের ভেতরে বেড়েছে ডলারের চাহিদা। ফলে চাহিদার তুলনায় ডলারের যোগান কমে গেছে। এ কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ঘটছে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় এক টাকা। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে প্রায় ২ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, বর্তমানে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা ৮০ পয়সায়। আন্তঃব্যাংকের বাইরে অন্য ক্ষেত্রে ডলারের দর আরও বেশি। অবশ্য বাড়তি চাহিদার কারণে ব্যাংকগুলো কিছুটা টানাটানিতে পড়লেও দেশে বৈদেশিক মুদ্রার কোন সঙঙ্কট নেই বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রফতানি ও রেমিট্যান্সের বাইরে বিদেশী ঋণ-অনুদানসহ বিভিন্ন উপায়ে আসা বৈদেশিক মুদ্রা যুক্ত হয়ে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রয়েছে প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে আট মাসের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব।
×