ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অনন্য সেনাবাহিনী জানিসারী

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৩ নভেম্বর ২০১৭

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অনন্য সেনাবাহিনী জানিসারী

জানিসারী বাহিনী বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে দুর্জয় ও চৌকস বাহিনী হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র পরিচিত ছিল। এই বাহিনীর দুর্বার গতিরোধ করার মতো সাহস ও শক্তি কারোরই ছিল না। উসমানী সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ রমাদান ইন্তেকাল করলে তাঁর পুত্র ওরহান (১৩২৪-১৩৬২) খ্রি.) স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি পিতার মতোই যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। অতিশয় দূরদর্শী ও বিচক্ষণ এই মহান সুলতান ব্যক্তিজীবনে সুফী ছিলেন। ইসলামের বিজয় পতাকা সবখানে স্থাপন করার লক্ষ্যে, খিলাফতের সমৃদ্ধি, মানমর্যাদা এবং ঐতিহ্য সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে তিনি একটি সুশৃঙ্খল, সুবিন্যস্ত শক্তিশালী সেনাদল গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এই লক্ষ্যে তিনি যে সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন সেই বাহিনীই জানিসারী বাহিনী। জানা যায়, এই বাহিনী গড়ার ব্যাপারে তিনি তাঁর ভাই আলাউদ্দীন ও উজির সুলায়মানের পরামর্শ গ্রহণ করেন। জানিসারী বাহিনীর অভিনব যুদ্ধকৌশল শক্তিমত্তা, বীরত্ব, শৃঙ্খলা, সাহসী পদক্ষেপ, দুর্বারগতি ও শৌর্য-বীর্য সারাবিশ্ব কয়েক শতাব্দী ধরে বিস্ময়ের সঙ্গে অবলোকন করে। এই বাহিনীর দুর্বার ও সুদৃঢ় পদচারণায় অতিদ্রুত অঞ্চলের পর অঞ্চল উসমানী সালতানাতভুক্ত হয়ে যায়। মুসলিমগণের বিজয় গৌরবের নিদর্শন এই নবীন বাহিনী সুলতানের পীর তৎকালীন বিখ্যাত সুফী ওলীয়ে কামিল হাজী বেকতাশের (রহ.) দোয়া লাভ করেছিল। তিনি এই নবীন বাহিনীকে দাঁড় করিয়ে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর মহান দরবারে হাত তুলে দোয়া করেন : হে আল্লাহ্! আপনি এদের চেহারা উজ্জ্বল করে দিন, এদের বাহুকে শক্তিশালী করে দিন, এদের তলোয়ারকে সুতীক্ষ্ন করে দিন, এদের তীরকে প্রাণনাশক করে দিন এবং প্রতিটি অভিযানে এদের বিজয় দান করুন। জানিসারী বাহিনী গঠনের ইতিহাসও অভিনব। এই বাহিনী গঠনে দীর্ঘমিয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। যুগোসভিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, বসনিয়া, গ্রীসসহ বলকান উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অল্প বয়স্ক, সুন্দর সুন্দর চেহারার স্বাস্থ্যবান বালকদের এই বাহিনী গঠনের জন্য সংগ্রহ করা হতো। এসব বালককে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে আদব-কায়দা, দীনি ইল্ম, যুদ্ধবিদ্যা প্রশিক্ষণ দেয়া হতো এবং কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে রেখে তাদের মানসিক, আত্মিক ও চারিত্রিক উন্নতি সাধন করা হতো। বিশেষ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে তারা কয়েক বছরের মধ্যেই ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে পা-িত্য অর্জন করত, তরিকতের জ্ঞানে উদ্ভাসিত হতো এবং যুদ্ধের নানামাত্রিক কৌশলে পারদর্শী হয়ে উঠত। আর এমন করেই তারা সকল বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে এক দুর্জেয় বাহিনীতে পরিণত হতো। উসমানী দ্বিতীয় সুলতান ওরখান সর্বপ্রথম এক হাজার বালককে সংগ্রহ করে তাঁর পীর সাহেব কেবলা হাজী বেকতাশ ওলীর খানকা শরীফে নিয়ে যান এবং এই বাহিনীর একটা সুন্দর নাম দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। পীর বেকতাশ এই বাহিনীর নাম দেন ইয়াকীচেরী বা ইয়ানীচেরী অর্থাৎ নবীন সেনাদল। এই জানিসারী বা ইয়াকীচেরী বা ইয়ানীচেরী বাহিনীর প্রধান রেজিমেন্ট পীর সাহেব বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। এই পীর সাহেব বাহিনী দারুণ প্রভাবশালী ছিল। জানিসারী বাহিনীর প্রধানকে বলা হতো আগা এবং তার পরের জনকে বলা হতো বুলকেতখুদাসি। অন্যদিকে পীর বেকতাশের ইন্তিকালের পর তাঁর খলিফাকে চেলেবি বলা হতো। এখনও তুরস্কে বিশেষ করে আলবেনিয়াতে বেকতাশিয়া তরিকার ব্যাপক চর্চা রয়েছে এবং বহু মুরিদ রয়েছে। জানিসারী বাহিনীর সংগঠক সুলতান ওরহান ১৩৬২ খ্রিস্টাব্দে সালতানাতকে দক্ষ হাতে বিন্যস্ত করে ইন্তেকাল করলে তাঁর পুত্র প্রথম মুরাদ (১৩৬২-১৩৮৯ খ্রি.) পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। এই সুলতান মুরাদ জানিসারী বাহিনীকে আরও সম্প্রসারিত ও সুবিন্যস্ত করেন। উসমানী খিলাফত প্রায় ৬২৩ বছরকাল স্থায়ী হয়েছিল। দীর্ঘকাল এই খিলাফতকে সুসংহত করায় এবং এর অখ-তা রক্ষায় জানিসারী বাহিনী বিশেষ অবদান রাখে। এই বাহিনী উসমানী খিলাফতের শৌর্ষ-বীর্য ও শক্তি প্রতিপত্তির ইতিহাসে প্রধান সামরিক শক্তি হিসেবে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় সৃষ্টি করে। ৫০২ বছর এই বাহিনী সাহস, শৌর্য ও বীরত্বের অনন্য স্বাক্ষর রেখে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে বিলুপ্ত হয়। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)
×