ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৩৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কেন্দ্র এলএনজি দিয়ে চালানো হবে

পায়রায় দেশের বৃহত্তম বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২ নভেম্বর ২০১৭

পায়রায় দেশের বৃহত্তম বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে

রশিদ মামুন ॥ দেশের সব থেকে বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে পায়রাতে। তিন হাজার ৬ শ’ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুত কেন্দ্রটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) দিয়ে চালানো হবে। পায়রায় নির্মাণাধীন কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের পাশেই আসছে জানুয়ারিতে নতুন এই কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ শুরু হবে। জার্মানির বিনিয়োগে যৌথভাবে রাষ্ট্রীয় নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং জার্মানির সিমেন্স এজি কেন্দ্রটি নির্মাণ করবে। আড়াই বিলিয়ন ডলার বা ২০ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে বিপুল ইউরোপীয় বিনিয়োগ আসছে। জানতে চাইলে বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জনকণ্ঠকে বলেন, এটি হবে দেশের সব থেকে বড় বিদ্যুত কেন্দ্র। তিনি একই সঙ্গে জানান, সিমেন্সের সঙ্গে মাসের শেষ দিকে আরও একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হবে। সেখানে পিডিবির সঙ্গে সিমেন্স একটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র বলছে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুত কেন্দ্রটির এমওইউ অনুমোদন করেছেন। আগামী রবিবার সিমেন্সের সঙ্গে এমওইউটি সই করবে এনডব্লিউপিজিসিএল। যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠনের পরেই কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ শুরু হবে। কেন্দ্রটির নির্মাণকারী হিসেবেও থাকছে পৃথিবীর বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণকারীদের মধ্যে সেরা প্রতিষ্ঠান সিমেন্স এজি। বিদ্যুত কেন্দ্রের অর্থায়ন, নির্মাণ সব কিছুর দায়িত্ব থাকছে সিমেন্সের কাঁধেই, তাই যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠনের পরেই নির্মাণ কাজ শুরু হবে। পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের অধিগ্রহণ করা এক হাজার একর জমি থেকে নতুন কেন্দ্রের জন্য ১০০ একর জমি ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সঙ্গত কারণেই কেন্দ্রটির জমি অধিগ্রহণ এবং উন্নয়ন জটিলতার সময় বাঁচানো সম্ভব হবে। এর আগে দেশে সর্বোচ্চ এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুটি কেন্দ্রের নির্মাণ কাজও চলছে। কিন্তু এখন বিশ^বাজারে জ¦ালানির দাম কম থাকায় এলএনজির দামও কমে এসেছে। জ¦ালানির দর বিশ্লেষণ করে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যানে এলএনজিকে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। তবে সরকারী অংশীদারিত্ব থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে এই প্রথম কোন এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে বাংলাদেশ সরকারের কোম্পানির ৫০ ভাগ মালিকানা থাকবে। এর বাইরে সিমেন্সের অংশীদারিত্ব থাকবে। ভবিষ্যতে এখানে তৃতীয় কোন পক্ষ অন্তর্ভুক্ত হতে চাইলে সিমেন্স তৃতীয় পক্ষকে অংশীদারিত্ব ছেড়ে দেবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব ঠিক থাকবে। পায়রাতে কোন প্রক্রিয়ায় এলএনজি আনা যায় তা সম্ভাব্যতা জরিপে নির্ধারণ করা হবে। ইতোমধ্যে পায়রা বন্দরে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে সমুদ্রে যথেষ্ট গভীরতা না থাকাকে দায়ী করা হচ্ছে। পায়রাতে টার্মিনাল নির্মাণ করা সম্ভব না হলে কেন্দ্রটির জন্য ছোট আকারের লাইটারেজে করে এলএনজি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। সেক্ষেত্রে গভীর সমুদ্রে একটি ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। সেখানে বড় জাহাজে এলএনজি এনে লাইটারেজে করে কেন্দ্র পর্যন্ত এলএনজি আনা হবে। তবে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ করলে বিদ্যুত কেন্দ্রের কাছেই এলএনজির বড় জাহাজ আনা সম্ভব। সাধারণত এলএনজির বড় জাহাজের জন্য ১৬ থেকে ১৮ মিটার ড্রাফট প্রয়োজন হয়। কিন্তু পায়রা বন্দর থেকে ৩৫ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অগভীর সমুদ্রে সাড়ে চার থেকে ১০ মিটার ড্রাফট রয়েছে। বন্দর এলাকা থেকে ৩৫ নটিক্যাল মাইল এলাকা ড্রেজিংয়ের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি বেলজিয়ামের কোম্পানির সঙ্গে এমওইউ সই করলেও কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। এতে পায়রা বন্দর ঘিরে বড় প্রকল্প নির্মাণকারীরা বিপাকে পড়ছে। সূত্র বলছে, অন্য এলএনজি চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের তুলনায় এই কেন্দ্রটির উৎপাদন খরচ অনেক কম হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এমনকি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের চেয়েও এই কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় কম হবে। এখন পর্যন্ত সিমেন্স তাদের প্রতিবেদনে প্রতি ইউনিটের দর সাত সেন্ট হবে বলে উল্লেখ করেছে। এতে দেশী মুদ্রায় দাম পড়ে ৫ টাকা ৬০ পয়সা। সম্প্রতি সরকার ভারতের রিলায়েন্স পাওয়ারকে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। রিলায়েন্স থেকে নতুন এই কেন্দ্রের উৎপাদন খরচ কম হবে। বলা হচ্ছে বিদ্যুত কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ হবে এক দশমিক ৮ সেন্ট/ইউনিট। সেখানে রিলায়েন্সের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট ১ দশমিক ৯৮ সেন্ট। গত জুলাইতে সিমেন্স জার্মান দূতাবাসের মাধ্যমে বিদ্যুত বিভাগে আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য একটি আগ্রহপত্র পাঠায়। সরকার সিমেন্সের আগ্রহ বিবেচনা করে আলোচনায় বসে। আলোচনার প্রেক্ষিতে গত ১০ অক্টোবর সিমেন্স একটি এমওইউ এর খসড়া পাঠায়। ওই খসড়ার উপর আলোচনা করে এমওইউ চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন চাওয়া হয়। প্রসঙ্গত সিমেন্স বিশ^খ্যাত নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। সিমেন্সের গ্যাস টারবাইন, স্টিম টারবাইন, জেনারেটর এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপতি নির্মাণের সুদীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এরপরও প্রকল্পটিতে সিমেন্স জার্মান বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়। জানা গেছে, দ্রুত বিদ্যুত কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ শুরু করতে চায় এনডব্লিউপিজিসিএল। এজন্য ডিসেম্বরের মধ্যে যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠন করা হবে। আর আগামী জুনের মধ্যেই কেন্দ্রটির অর্থায়ন নিশ্চিত করা হবে। তবে অর্থায়ন নিশ্চিত হওয়ার আগেই যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠনের পর থেকেই কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এর আগে এনডব্লিউপিজিসিএল পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ দ্রুততার সঙ্গে করার জন্য ঋণের অর্থ ছাড়ের আগেই ঠিকাদারকে নির্মাণ ব্যয়ের ১৫ ভাগ খরচ করার বাধ্যবাধকতা দিয়েছিল। এখনও ঋণের অর্থ ছাড়ের আগেই ২৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের। সেই সাফল্য এখানেও কাজে লাগানো হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির মোট উৎপাদন ক্ষমতা তিন হাজার ৬ শ’ মেগাওয়াট। কেন্দ্রটিতে এক সঙ্গে ৬ শ’ মেগাওয়াটের ছয়টি ইউনিট স্থাপন করা হবে। দেশে এর আগে ৬০০ মেগাওয়াটের গ্যাসচালিত ইউনিটও স্থাপন করা হয়নি। বিদ্যুত কেন্দ্রটি প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে চালানো হবে বলেই পরিবেশ দূষণের আশঙ্কাও নেই। সঙ্গত কারণেই কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে তা এই কেন্দ্রকে স্পর্শ করবে না। বিদ্যুত মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সিমেন্স বাংলাদেশে আট হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। একই সঙ্গে তারা কেন্দ্রের জন্য অর্থায়নেরও নিশ্চয়তা দিচ্ছে। দেশে গ্যাসের স্বল্পতা থাকায় সরকার এলএনজি দিয়ে এসব কেন্দ্র চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
×