ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুইদিনের সফর শেষে সুষমা স্বরাজের ঢাকা ত্যাগ

মোদির আমলেই তিস্তা চুক্তি চায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৪ অক্টোবর ২০১৭

মোদির আমলেই তিস্তা চুক্তি চায় বাংলাদেশ

তৌহিদুর রহমান ॥ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলেই তিস্তা চুক্তি চায় বাংলাদেশ। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দিল্লীর কাছে তাগাদাও দিয়েছে ঢাকা। এছাড়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে প্রতিবেশী ভারতের জোরালো সমর্থন আদায় করতেও সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এদিকে দিল্লীর পক্ষ থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে জোর দেয়া হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠকে এসব আলোচনা হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ দুদিন সফর শেষে সোমবার দুপুরে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। ঢাকা ত্যাগের আগে সুষমা স্বরাজ রাজধানীর বারিধারায় ভারতের নতুন চ্যান্সারি ভবন উদ্বোধন করেছেন। এছাড়া তিনি ১৫টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সুষমা স্বরাজ বলেন, ভারতের কাছে প্রতিবেশী আগে, কিন্তু বাংলাদেশ সবার আগে। সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের আগেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আলোচনা তোলার প্রস্তুতি নেয়া হয়। সফরের প্রথম দিন রবিবার দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে এ বিষয়ে ভারতের সমর্থন থাকবে বলেও জানানো হয়। গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাবিরোধী দমন-পীড়ন শুরুর পর ৫ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফর করেন। তখন দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোন মন্তব্য না থাকলেও পরে ভারত একটি বিবৃতি দেয়। একই সঙ্গে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে একটি বিবৃতি পেশ করে। সেখানে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত। তবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফরের সময় রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া ও কোফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন চেয়েছে ভারত। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। বৈঠকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে ভারতের জোরালো সমর্থন প্রত্যাশা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় সুষমা স্বরাজ রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে ভারত বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে জানিয়েছেন। এদিকে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পর দীর্ঘদিন ধরেই তিস্তা চুক্তির দাবি জানিয়ে আসছিল বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে এখন বাংলাদেশ ব্যস্ত থাকলেও তিস্তা চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিতেও ভুল করেনি। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সুষমা স্বরাজকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেয়া প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দেন। উভয় দেশের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের পাশাপাশি তিস্তা চুক্তির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গত ৮ এপ্রিলে দেয়া বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এছাড়া গঙ্গার পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষ্যে ভারতের কাছ থেকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, মোদি-হাসিনার আমলেই তিস্তা চুক্তি হবে। মোদির দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ীই তার আমলেই তিস্তা চুক্তি চায় বাংলাদেশ। একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের বিষয়েও আলোচনা করেন তারা। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতে পাটপণ্য প্রবেশের ক্ষেত্রে এন্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করা হয়। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি সীমান্ত হাট স্থাপনে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান (বিবিআইএন) সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়নে এ মুহূর্তে ভুটানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল (বিআইএন) বাস্তবায়নে জোর দেয়া হয়েছে। তবে ভুটান ইচ্ছা করলে পরবর্তীতে এ প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে পারবে। এছাড়া ভারতীয় ক্রেডিট লাইনের আওতায় বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়। বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে জোর দেয়া হয়। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে আবারও আশ্বাস দেয়া হয়, ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মাটি কোন সন্ত্রাসী ও জঙ্গীগোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। এছাড়া বাংলাদেশে বিদ্যুত ও জ্বালানি সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারত বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত সরবরাহ করছে। বিদ্যুত সরবরাহের পরিমাণ আরও বাড়াবে বলে জানিয়েছে দেশটি। যৌথ পরমর্শক কমিটির বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া হয়। ঢাকা-কলকাতার মধ্যে চালু মৈত্রী ট্রেন সার্ভিসে আরও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও কলকাতা-খুলনা বন্ধন ট্রেন সার্ভিস বাণিজ্যিকভাবে দ্রুত চালুর বিষয়ে আলোচনা করা হয়। চ্যান্সারি ভবন উদ্বোধন ॥ সোমবার ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের নতুন চ্যান্সারি কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। এ সময় সুষমা স্বরাজ বলেন, ভারত সব প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বাংলাদেশকেই অগ্রাধিকার দেয়। বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো ইমানদারির সঙ্গে মিটিয়ে ফেলার আগ্রহের কথাও তিনি বলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্কর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ইংরেজীতে বক্তৃতা দিতে শুরু করে সুষমা স্বরাজ একপর্যায়ে হিন্দিতে বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ভারতের কাছে প্রতিবেশী আগে, কিন্তু বাংলাদেশ সবার আগে। সুষমা স্বরাজ বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বর্তমানে অসাধারণ। দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত যে বিষয়গুলো রয়েছে, তার সমাধানে দুপক্ষই বন্ধুত্বের মেজাজে সঠিক পথে কাজ করছে। তিনি বলেন, আমি আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমরা দুই দেশ মিলে সব বিষয় ইমানদারির সঙ্গে মিটিয়ে ফেলব। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে উদ্দেশ করে সুষমা স্বরাজ বলেন, তিনি আমাকে দিদি বলেন, আমি তাকে দাদা বলি। সম্পর্কটা এখন পারিবারিক হয়েছে। সম্পর্ক যখন পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক হয় তখন সেটা ভিন্নমাত্রা পায়। তিনি আরও বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর আমার কাছে ভারত সরকারের প্রস্তাব আসে, সবার প্রথমে আপনি কোন্ দেশে সফর যেতে চান। তখন আমি বলি, সবার আগে প্রতিবেশী বাংলাদেশে সফরে যাব। সে অনুযায়ী বাংলাদেশেই প্রথম সফরে আসি। ১৫ প্রকল্প উদ্বোধন ॥ সোমবার ভারতের চ্যান্সারি কমপ্লেক্স উদ্বোধন শেষে বাংলাদেশে ১৫টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করেন সুষমা স্বরাজ। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও উপস্থিত ছিলেন। প্রকল্পগুলো হলোÑ পিরোজপুরের ভা-ারিয়া উপজেলায় পানি শোধনাগার প্লান্ট, ৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক, সাভারে পাঁচতলাবিশিষ্ট বৃদ্ধাশ্রম, আর কে মিশনে শিক্ষার্থীদের জন্য বিবেকানন্দ ভবন, সিলেটে ইসকন পাঁচতলা ভবন, রামকৃষ্ণ মিশন ময়মনসিংহ ভবন, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১৫০ গভীর নলকূপ স্থাপন, চাঁদপুরের ফারাক্কাবাদ ডিগ্রী কলেজে মহাত্মা গান্ধী ভবন ছাড়াও কয়েকটি স্কুলে কম্পিউটার ও খেলার সামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম। উদ্বোধন হওয়া প্রকল্পগুলোর বিষয়ে সুষমা স্বরাজ বলেন, এক বছরের মধ্যে প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হবে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে যা সুপারসনিক গতিতে সম্পন্ন হবে। এর আগে সুষমা স্বরাজ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ফটোকপি মেশিনসহ বিভিন্ন শিক্ষাসামগ্রী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসিসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ রবিবার দুপুরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ পরামর্শক কমিশনের সভায় যোগ দিতে ঢাকায় আসেন। দুদিনের সফর শেষে সোমবার দুপুরে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। গত এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ভারতের কোন শীর্ষ মন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলেন। এর আগে গত ৩ অক্টোবর ঢাকায় আসেন ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। ২০১৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর করেন। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। দুই প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যেসব সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সই হয়েছে, তার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লীতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তৃতীয় যৌথ কমিশনের বৈঠক হয়েছিল। সে বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অংশ নিয়েছিলেন।
×