ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

ফিশ এ্যাকুয়াকালচারে নতুন দিগন্ত

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২২ অক্টোবর ২০১৭

ফিশ এ্যাকুয়াকালচারে নতুন দিগন্ত

আশার খবর দিয়েই শুরু করি। ১৬ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে ৬০ ভাগ আমিষের চাহিদা পূরণ হয় এই খাত থেকে। এর পাশাপাশি মাছ রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সঙ্গে সঙ্গে বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এর ‘দ্য গ্লোবাল এ্যাকুয়াকালচার প্রডাকশন স্ট্যাটিস্টিকস ফর দ্য ইয়ার-২০১৫’ প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে চাষকৃত মাছের বার্ষিক উৎপাদন ১৬ লাখ টন। তাদের জরিপে ফিশ এ্যাকুয়াকালচার বা চাষকৃত মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার পরই পঞ্চম স্থানটি বাংলাদেশের। শীর্ষস্থানে থাকা চীনের বার্ষিক উৎপাদন ৩৮ লাখ ৬২ হাজার টন, ভারত ৩৫ লাখ ৭৩ হাজার, ভিয়েতনাম ২৮ লাখ ৪৫ হাজার ও ইন্দোনেশিয়া প্রতিবছর গড়ে ২৭ লাখ ১৮ হাজার টন। এই আশার খবরের প্রতিফলন হচ্ছে মাছ থেকে দেশে আমিষের চাহিদার ৬০ শতাংশের জোগানই আসছে। আমরা জানি, বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে মৎস্য খাতের অবদান ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ বা দেড় কোটির বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের ওপর নির্ভরশীল। বিপ্লবের পথে যাত্রা : দেশে জলাশয় হিসেবে আমাদের স্থানীয় মৎস্য চাষের আওতায় রয়েছে ৪৭ লাখ হেক্টরের বেশি জমি। নদী ও মোহনা, সুন্দরবন, বিল, কাপ্তাই লেক ও প্লাবনভূমিকে মুক্ত জলাশয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব এলাকার মোট বিস্তৃতি প্রায় ৪০ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর। অন্যদিকে বদ্ধ জলাশয় হিসেবে ধরা হয় পুকুর, আধাবদ্ধ জলাশয়, বাঁওড় ও চিংড়ি খামারগুলোকে। এসব এলাকার বিস্তৃতি ৬ লাখ ৭৮ হাজার হেক্টর। মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে দেশের ৮২ শতাংশের বেশি মাছ উৎপাদন হয়। বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে পুকুর, আধাবদ্ধ জলাশয়, বাঁওড় ও চিংড়ি খামারে উৎপাদন হচ্ছে ৪৮ শতাংশ মাছ। এছাড়া মুক্ত জলাশয়ে উৎপাদন হচ্ছে ৩৪ শতাংশ। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- দেশে চাষকৃত মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেসরকারী উদ্যোগ। যদিও এই উৎপাদন বাড়ার পেছনে সরকারী ও বেসরকারী উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মৎস্য খাতের অবদানের পেছনে বিশেষত সরকারের মাছের অভয়াশ্রম ও প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণ এবং মৎস্য আইন বাস্তবায়নও বেশ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া পোনা অবমুক্তি, বিল ও নার্সারি স্থাপন, পোনা সংরক্ষণ কর্মসূচী, পরিবেশবান্ধব চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ, বদ্ধ জলাশয়ে নিবিড় মৎস্য চাষ, সামাজিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণ ও মৎস্য চাষীদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কারণে মাছ উৎপাদন বাড়ছে। এছাড়া মৎস্য জেলা হিসেবে ময়মনসিংহে রেণু ও পোনা উৎপাদনে হ্যাচারি শিল্প গড়ে উঠেছে, যা দেশের প্রায় সব জেলায়ই মৎস্য চাষ সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে জেলেদের পরিচয়পত্র বা আইডি কার্ড দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, যার মাধ্যমে জেলেরা নিরবচ্ছিন্নভাবে সরকারী সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবেন। বহুবিদ সম্ভাবনা আর অবারিত সুযোগের কারণেই এখন কৃষকদের মধ্যেও মৎস্য চাষে আগ্রহ বাড়ছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে- দেশে পোনা উৎপাদনকারী জেলাগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে যশোর, ময়মনসিংহ, বগুড়া, কুমিল্লা ও নরসিংদী। তবে মৎস্য চাষের এলাকা এখন বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, নেত্রকোনা ও টাঙ্গাইল জেলায়ও বিস্তৃতি লাভ করেছে। নানামুখী উদ্যোগের পাশাপাশি অন্যান্য জেলায়ও ব্যক্তি পর্যায়ে পুকুরে মাছ চাষের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক সাফল্য আসতে শুরু করেছে। তারচেয়েও বড় আশাবাদের খবরটি হলো প্রকৃতপক্ষে সারাদেশে পুকুরে মাছ চাষে বিপ্লবের লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অব্যবস্থাপনায় উৎপাদন বিনষ্ট : হতাশার খবরটি হচ্ছে- অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় অপচয় হচ্ছে উৎপাদিত মাছের এক-তৃতীয়াংশ বা বছরে প্রায় ১১ লাখ টন। কারণ দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও সে সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ কথার প্রমাণ হিসেবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য অধিদফতরের গবেষণায় জানানো হয়েছে দেশে উৎপাদিত মাছের বিরাট অংশই অপচয় হয়ে যাচ্ছে। বলা হয়েছে মাছ নষ্ট হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী পরিবহন এবং সংরক্ষণে অদক্ষতা। সঠিক মাত্রায় পরিবহন এবং সংরক্ষণ করতে না পারাতেই ১৫-১৭ শতাংশ মাছ নষ্ট হচ্ছে। অপরপক্ষে খুচরা ও পাইকারি বাজারের বিক্রেতাদের অদক্ষতার কারণেও নষ্ট হচ্ছে মাছ। আবার ভোক্তা পর্যায়ে মাছটি আনার পর এর উচ্ছিষ্টাংশ ফেলে দেয়ার কারণেও বাদ পড়ে মাছের ২-৫ শতাংশ। দেশে এখনও একজন মানুষের বছরে মাছের ঘাটতি রয়েছে প্রায় আড়াই কেজি। অর্থাৎ প্রতিবছরে এখনও মাছের ঘাটতি প্রায় চার লাখ টন। আর ১০ লাখ টন অপচয় হিসেবে নিলে তা প্রকৃতপক্ষে হবে প্রায় ১৪ লাখ টন। গবেষণায় দেখা গেছে- দেশের মোট উৎপাদিত মাছের মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ তাজা হিসেবে ভোক্তারা পাচ্ছেন। আবার দেশে ৪০ শতাংশ মাছের বরফ প্রয়োজন হলেও সংশ্লিষ্টরা তা ব্যবহার করছেন না। তার মধ্যে ৮৮ শতাংশ জেলে, ৭৭ শতাংশ খামারি বা কৃষক, ২৭ শতাংশ রিটেইলার এবং ৪৭ শতাংশ ভে-ররা মাছে বরফ ব্যবহার করছেন না। কাজে লাগাতে হবে সুযোগ-সম্ভাবনা : মৎস্য উৎপাদনে শীর্ষ দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এ খাতের সম্প্রসারণের হার বেশি হলেও অপচয়ের কারণে মাছের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাছের উচ্ছিষ্টাংশ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও খাদ্যপণ্য উৎপাদন হলেও এদেশে তেমন কোন সুযোগ নেই। অথচ মাছের এ ধরনের উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে তেল, অয়েল কেক ও খাবার তৈরি এবং শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল তৈরি করে বছরে বিপুল অর্থ আয় করা সম্ভব। সরকার দেশের মাছ উৎপাদন বাড়াতে যতটা নজর দিচ্ছে, ঠিক ততটাই অবহেলা করা হচ্ছে এর সংরক্ষণ কিংবা পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে। তাছাড়া মাছ উৎপাদনে জড়িত এবং বিপণন প্রক্রিয়ায় যারা নিয়োজিত, তাদেরও দক্ষতা ও সঠিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তাজা মাছ বিপণন করতে এখনও দেশে উন্নত অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। খামারি বা জেলেরা এখনও বরং পুরনো পদ্ধতিতে মাছ বিপণন করে যাচ্ছেন। পরিবহন ব্যবস্থারও দুর্বলতা রয়েছে। মৎস্য পরিবহনের জন্য ফ্রিজিং পিকাপ ব্যবস্থাকরণ দরকার। এসব বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মনযোগ দেয়া খুবই জরুরী।
×