ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১০ নবেম্বর পর্যন্ত ছুটি মঞ্জুর, আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারি

সিনহা দায়িত্বে না ফেরাপর্যন্ত ওয়াহ্হাব মিঞা প্রধান বিচারপতি

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৩ অক্টোবর ২০১৭

সিনহা দায়িত্বে না ফেরাপর্যন্ত ওয়াহ্হাব মিঞা প্রধান বিচারপতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি তিনি দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। এক মাসের ছুটিতে থাকা বিচারপতি সিনহা আগামী ১০ নবেম্বর পর্যন্ত বিদেশে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে যে চিঠি দিয়েছিলেন, তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের স্বাক্ষরের পর বৃহস্পতিবার আইন মন্ত্রণালয় এই প্রজ্ঞাপন জারি করে। অন্যদিকে, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে রেখে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদপ্রাপ্তি এবং পদোন্নতি থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ। বৃহস্পতিবার রাজধানীতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত এ অভিযোগ তোলেন। ‘সরকারের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল মহলবিশেষ’ সক্রিয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি সংক্রান্ত দায়ভার কোনভাবেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বহন করবে না। আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মোঃ জহিরুল হক দুলাল স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির আবেদনে এর আগে ৩ অক্টোবর থেকে ১ নবেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিনের ছুটি মঞ্জুর করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু বিচারপতি সিনহা যেহেতু আরও বেশি দিন বিদেশে থাকবেন, সেহেতু রাষ্ট্রপতি নতুন আদেশ দিয়েছেন। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বর্ধিত ছুটিতে প্রধান বিচারপতির বিদেশে অবস্থানের সময়ে, অর্থাৎ ২ নবেম্বর থেকে ১০ নবেম্বর পর্যন্ত, অথবা তিনি দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা প্রধান বিচারপতির কার্যভার সম্পাদন করবেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে থাকা প্রধান বিচারপতির হঠাৎ ছুটিতে যাওয়া নিয়ে মাসের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী আলোচনা চলছে। বিএনপি অভিযোগ করেছে, রায়ের কারণে চাপ দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। অন্যদিকে সরকার বলছে, এর সঙ্গে রায়ের কোন সম্পর্ক নেই, চাপেরও কোন বিষয় নেই। ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়া বিচারপতি সিনহার চাকরির মেয়াদ রয়েছে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। সুপ্রীমকোর্টের অবকাশ শুরুর আগে গত ২৪ আগস্ট তিনি শেষ অফিস করেন এবং অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর আদালত খোলার দিন থেকে ছুটিতে যান। রাষ্ট্রপতি বরাবরে প্রধান বিচারপতির পাঠানো সেই ছুটির আবেদন সাংবাদিকদেরও দেখান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সেখানে বলা ছিল, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এর আগে তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং গত বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। বিশ্রামের জন্য ৩ অক্টোবর থেকে ১ নবেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিন তিনি ছুটি কাটাতে চান। এর মধ্যে গত ৭ অক্টোবর বিচারপতি সিনহার অস্ট্রেলিয়ার ভিসা পাওয়ার খবর আসে। আদালতের একটি সূত্র জানায়, প্রধান বিচারপতি ও তার স্ত্রী সুষমা সিনহা তিন বছরের ভিসা পেয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বড় মেয়ে সূচনা সিনহার কাছে উঠবেন তারা। এরপর বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা রাষ্ট্রপতিকে জানিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন বিচারপতি সিনহা। আইন সচিব সেদিন জানান, ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নবেম্বর পর্যন্ত বিদেশে থাকার ইচ্ছার কথা ওই চিঠিতে রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বুধবার জানান, প্রধান বিচারপতির ওই চিঠি পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাতে সই করেছেন। পরে রাতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও ওই চিঠিতে সই করেন। প্রধান বিচারপতির ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই বুধবার বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞার সঙ্গে দেখা করেন আইনমন্ত্রী। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় জুডিসিয়াল কনফারেন্স নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির মতামত নিতে এসেছিলেন তিনি। তাছাড়া কিছু প্রশাসনিক পরিবর্তনের বিষয়েও বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা আলোচনা করেছেন। প্রধান বিচারপতির দায় সংখ্যালঘুরা নেবে না ষোড়শ সংশোধনীর রায় কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে সরকারের টানাপোড়নের ইস্যু সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক বিভেদ, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি সৃষ্টিতে একটি মহল ব্যাপকভাবে তৎপর বলে অভিযোগ করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ। ‘সরকারের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল মহলবিশেষ’ সক্রিয় উল্লেখ করে তারা বলেছে, প্রধান বিচারপতি সংক্রান্ত কোন দায়ভার কোনভাবেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বহন করবে না। বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত এসব জানান। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে যা হচ্ছে বা রায় নিয়ে আমাদের কোন বক্তব্য নেই। প্রধান বিচারপতির কী হলো সেটা নিয়েও আমাদের কোন বক্তব্য নেই। কিন্তু প্রধান বিচারপতির দায়ভার এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কোনভাবেই বহন করতে পারে না। ‘প্রধান বিচারপতি প্রধান বিচারপতিই। তার ধর্মবিশ্বাস থাকতে পারে, কিন্তু বিচারপতি হিসেবে তার একমাত্র পরিচয় তিনি প্রধান বিচারপতি। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান বা আদিবাসী নন। কিন্তু যখন তার ধর্মীয় পরিচয় সামনে রেখে প্রশ্ন তোলা হয়, তা সম্প্রদায় হিসেবে আমাদের আহত করে। এ পর্যন্ত অসংখ্য বিচারপতি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ হয়েছেন, কখনও এমনভাবে তাদের ধর্মীয় পরিচয় তুলে, সম্প্রদায়কে সামনে রেখে কটাক্ষ হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।’ প্রধান বিচারপতির ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা বঞ্চনার শিকার হচ্ছে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, পত্র-পত্রিকার সংবাদে জানা গেছে, সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির রায়কে পুঁজি করে সরকারের অভ্যন্তরে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল মহলবিশেষ তার ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে নিয়ে এসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি, উন্নততর পদায়ন ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত করার সর্বনাশা প্রক্রিয়া আগের মতোই আবারও শুরু হয়েছে। এর ফলে মেধা, যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতায় এগিয়ে থাকা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দারুণ হতাশা ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি তিনি বলেন, সরকারী চাকরিতে নিয়োগ, পদোন্নতিতে পূর্বেকার মতোই আবারও বঞ্চনা-বৈষম্যের ধারাটি এগিয়ে আসছে কিনা তা ভেবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শঙ্কিত। পরিষদের অন্যতম সভাপতি হিউবার্ট গোমেজের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সভাপতিম-লীর সিনিয়র সদস্য অধ্যাপক ড. নীল চন্দ্র ভৌমিক, কাজল দেবনাথ, সুব্রত চৌধুরী, জয়ন্ত সেন দীপ্ত, মিলন কান্তি দত্ত, সাংবাদিক মনোজ কান্তি রায়, সঞ্জীব দ্রং, সত্যরঞ্জন বাড়ৈ প্রমুখ।
×