ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিআরটিসিতে ‘র‌্যাপিড পাস’ সেবা

কার্ড মেশিন স্পর্শ করলেই পরিশোধ বাসভাড়া

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১০ অক্টোবর ২০১৭

কার্ড মেশিন স্পর্শ করলেই পরিশোধ বাসভাড়া

রাজন ভট্টাচর্য ॥ বাসে উঠতে এখন দীর্ঘ সময় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। নগদ টাকায় ভাড়া পরিশোধে নেই ঝামেলা। খুচরা টাকা রাখারও দরকার হবে না। অর্থাৎ পকেটে টাকা না থাকলেও বাসে যেতে কোন সমস্যা নেই! এটা কিভাবে সম্ভব। সত্যিই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। হওয়ার কথাই। কারণ টাকা ছাড়া তো বাসে ভ্রমণ কল্পনা করা যায় না। তাহলে এমন কী ব্যবস্থা এলো, যার ফলে বিনা টাকায় ভ্রমণ করা যায়। বাস্তবতা হলো বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো রাজধানী ঢাকাতেও শুরু হয়েছে উন্নত যাত্রীসেবা। যারা বাসে নিয়মিত যাতায়াত করেন তারাই এই সেবা গ্রহণের সুযোগ পাবেন। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘র‌্যাপিড পাস’। অর্থাৎ কার্ডের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধ করা। মতিঝিল-আবদুল্লাহপুর রুটের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিআরটিসি ও ওমামা ইন্টারন্যাশনালের বাসে এই সেবা চালু হয়েছে। চলতি বছরের ১৭ মে থেকে নতুন এই সেবা কার্যক্রম শুরু হয়। মাসখানেকের মধ্যে ওমামা পরিবহন সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) কার্ডটি তৈরি করেছে। কার্ড মেশিনে স্পর্শ করলেই ভাড়া পরিশোধ হয়ে যাবে। সময়মতো কার্ড রিচার্জ করারও ব্যবস্থা রয়েছে। কার্ডে টাকা না থাকলেও একবার ভ্রমণের সুযোগ পাওয়া যাবে। রিচার্জের পর বকেয়া টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেয়া হবে। এখন পাইলট প্রকল্প হিসেবে শুধু বিআরটিসি বাসে এই সেবা চলছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রেনসহ সরকারী-বেসরকারী পরিবহনে এই সেবা চালুর কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার যাত্রী কার্ডে ভাড়া পরিশোধ করেন। দিন দিন এই পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। অনেকেই কার্ড ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বিশেষ করে যারা নিয়মিত বাসে যাতায়াত করেন এ রকম যাত্রীদের মধ্যে আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে। তাই সেবা সম্প্রসারণের কথা চিন্তা করা হচ্ছে। এদিকে পরিবহন মালিক ও যানবাহন বিশেষজ্ঞরাও বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা বলছেন, গোটা পরিবহন সেক্টরকে একটি কাঠামোতে এনে এ রকম সেবা নিশ্চিত করা গেলে সবাই উপকৃত হবেন। পাশাপাশি পরিবহন সেবার মানও বাড়বে। এজন্য সবার আগে বাসগুলোকে নির্দিষ্ট কোম্পানির মধ্যে এনে পরিচালনা করা জরুরী বলেও মনে করেন তারা। সোমবার রাজধানীর দিলকুশা পেট্রোল পাম্পের কাছে দেখা গেছে যাত্রীদের লাইন। সবার হাতেই রয়েছে র‌্যাপিড পাস। যাত্রীরা জানালেন, এখন বাস ভাড়া পরিশোধে কোন ঝামেলা নেই। মেশিনে কার্ড ধরলেই ভাড়া শোধ। নতুন এই প্রযুক্তির ফলে খুশি যাত্রীরা। উত্তরার যাত্রী হেলাল জানালেন, পকেটে টাকা না থাকলেও কোন সমস্যা নেই। কার্ডে তো টাকা আছে। আছে বিআরটিসি বাস। তাই যখন তখন বাসে ভ্রমণ নিশ্চিত। অপর যাত্রী আকবর জানালেন, সন্ধ্যার পর বাস কম পাওয়া যায়। তবে সেবার মান ভাল। আমরা সন্তুষ্ট। তিনি জানান, আগস্ট মাস থেকে আমি কার্ড দিয়ে যাতায়াত করছি। এতে ভাড়া নিয়ে কন্ডাক্টরের সঙ্গে যাত্রীদের ঝামেলা নেই। আগে তো প্রতিদিন ঝামেলা হতে দেখেছি। ফাহমিদা জানালেন, প্রতিদিন আমাকে অফিসের প্রয়োজনে আব্দুল্লাহপুর-মতিঝিল যাতায়াত করতে হয়। এখন কার্ড করে নিয়েছি। নির্ভেজাল যাত্রা। সময়মতো কার্ড রিচার্জ করলেই হয়। তিনি বলেন, রিচার্জ করা কিছুটা ঝামেলা। বিআরটিসির কাউন্টারে রিচার্জের ব্যবস্থা থাকলে যাত্রীদের জন্য আরও সুবিধা হতো বলেও জানান তিনি। ডিটিসিএ সূত্রে জানা গেছে, গণপরিবহন ব্যবস্থায় সমন্বিত ই-টিকেটিং পদ্ধতি চালুর লক্ষ্যে ২০১৪ সালে সরকার একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। এই প্রকল্পের আওতায় র‌্যাপিড পাস সেবা চালু হয়। এতে আর্থিক সহায়তা দেয় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক ও ডিটিসিএর অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক মোঃ জাকির হোসেন মজুমদার বলেন, এটি ডেবিট কার্ডের মতো অত্যাধুনিক সার্কিটনির্ভর কার্ড। ডাচ্-ব্যাংক ও বিআরটিসির নির্ধারিত কাউন্টার থেকে এই কার্ড কেনা যাবে ও কার্ডে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা রিচার্জ করা যাবে। তিনি বলেন, বিআরটিসি ও ওমামার পাশাপাশি ‘ঢাকা চাকা’ বাস সার্ভিসেও র‌্যাপিড পাস চালুর ব্যাপারে কাজ চলছে। অন্যান্য বাসে এই সেবা চালু হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেসব বাসের স্টপেজ বেশি, সেসব বাসে এই সেবা চালু করা কষ্টকর। যেখানে কার্ড পাওয়া যাবে ॥ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের মতিঝিলের লোকাল শাখা, বৈদেশিক বিনিময় শাখা, এলিফ্যান্ট রোড, বনানী, উত্তরা ও সোনারগাঁ-জনপথ শাখা এবং বিআরটিসির উত্তরা হাউস বিল্ডিং, বনানী, শাহবাগ ও মতিঝিল স্টপেজে র‌্যাপিড পাস কার্ড কেনা ও রিচার্জ করা যাবে। কার্ডের প্রাথমিক মূল্য ৪০০ টাকা। এর মধ্যে ২০০ টাকা রিচার্জ হিসেবে কার্ডে জমা থাকবে। ব্যবহারকারীরা একবার সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা ও সর্বনিম্ন ১০০ টাকা রিচার্জ করতে পারবেন। আবার ব্যবহারের সময় কার্ডে পর্যাপ্ত টাকা না থাকলেও একবার কার্ডটি ব্যবহার করা যাবে। এ ক্ষেত্রে পরবর্তী রিচার্জ থেকে টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় করা হবে। বিআরটিসির জোয়ার সাহারা বাস ডিপোর ব্যবস্থাপক মফিজ উদ্দিন জনকণ্ঠকে জানান, মতিঝিল থেকে আবদুল্লাহপুর রুটের সব শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে এই সেবা চালু আছে। যাত্রীরা সেবাটি খুব ভালভাবে গ্রহণ করেছেন। ধীরে ধীরে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। তিনি জানান, সরকারী এই প্রকল্পটি বিআরটিসিসহ বেসরকারী ওমামা পরিবহনে চালু হয়েছিল। চলতি বছরের ১৭ মে থেকে প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিক শুরু হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে ওমামা পরিবহনে এই সেবা বন্ধ হয়ে যায়। কোম্পানিটি বাস পরিচালনা এখন বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি জানান, র‌্যাপিড পাস এটি পাইলট প্রকল্প। আমাদের ডিপো থেকে চলা ২৬টি বাসেই এই সেবা চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব ডিপোতে এই সেবা চালু করার কথা জানান তিনি। মফিজ উদ্দিন বলেন, সরকারী-বেসরকারী পরিবহন সেক্টরে পর্যায়ক্রমে এই সেবা চালুর কথা রয়েছে। আমরা ভাল সাড়া পেয়েছি। ট্রেনেও দ্রুত সময়ের মধ্যে এই সেবা চালু হওয়ার কথা রয়েছে। আশা করি ট্রেনে এ সেবা চালু হলে যাত্রীরা তা ভালভাবেই গ্রহণ করবেন। জাকির হোসেন মজুমদার জানান, ২০১৮ সালের জুনে চলমান প্রকল্পের প্রথম ধাপ শেষ হবে। এই সময়ের মধ্যে রেলপথ, নৌপথ ও টোল প্লাজায় র‌্যাপিড পাস সেবা চালুর পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া আগামী বছর প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে কেনাকাটা, ইউটিলিটি বিল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেতনসুবিধা র‌্যাপিড পাস কার্ডে সংযুক্ত করা হবে। র‌্যাপিড পাসসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য িি.িৎধঢ়রফঢ়ধংং.পড়স.নফ এই ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে। কার্ড ব্যবহারের পদ্ধতি ॥ জাকির হোসেন মজুমদার জানান, কার্ডটি ব্যবহারের জন্য বাসে চালকের পাশে একটি যন্ত্র বসানো হয়। কার্ডধারী যাত্রী বাসে ওঠার সময় একবার এবং বাস থেকে নামার সময় একবার যন্ত্রের নির্দিষ্ট স্থানে কার্ডটি স্পর্শ করাবেন। বাস থেকে নামার সময় যন্ত্রে কার্ড স্পর্শ করানোর পর যন্ত্র থেকে রসিদ বের হবে। এতে ভাড়া ও কার্ডের ব্যালেন্স উল্লেখ করা থাকবে। কত কিলোমিটারের জন্য কত ভাড়া রাখা হয়েছে সেই হিসাবও দেখা যাবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্দিষ্ট দূরত্ব সফটওয়্যারে ইনস্টল করা আছে। যে কারণে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেয়ার সুযোগ নেই। যাত্রীরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন না। সরকার নির্ধারিত ভাড়া ধরেই সফটওয়্যার তৈরির কথা জানান যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ। সেবা সম্পর্কে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠকে বলেন, উন্নত দেশগুলোতে এ ধরনের সেবা চালু রয়েছে। আমরা চাই আমাদের দেশে পরিবহন সেবায় পরিবর্তন আসুক। যাত্রীরা এই সেবা গ্রহণ করলে সারাদেশে তা দ্রুত ছড়িয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
×