ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা

বরিশালে ডিভাইস দিয়ে সর্বরোগের চিকিৎসা

প্রকাশিত: ০৩:০৭, ৮ অক্টোবর ২০১৭

বরিশালে ডিভাইস দিয়ে সর্বরোগের চিকিৎসা

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে ॥ আকুলাইভ ‘প্রি-প্যালথজিক্যাল ডায়গনস্টিক ডিভাইস’ শরীরের বিভিন্ন অংশে ধরে রোগ নির্ণয় করে সর্বরোগের চিকিৎসার নামে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ গ্রামের সহজ সরল মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে প্রতারণা করে আসছে একটি প্রতারক চক্র। অবশেষে ওই চক্রের কথিত এক চিকিৎসককে স্থানীয়রা আটক করে বৃহস্পতিবার রাতে থানা পুলিশের কাছে সোর্পদ করলেও শুক্রবার দুপুরে রহস্যজনক কারণে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে। গৌরনদী পৌর এলাকার টরকী বন্দর আনোয়ারা প্রি-ক্যাডেট স্কুল সংলগ্ন সমিতির মাঠের একটি দ্বিতল ভবনের নিচতলার ভাড়া বাসায় ‘তিয়ানশি বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড’ নামের একটি কার্যালয় স্থাপন করে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে রোগী দেখা, ওষুধ বিক্রি এবং সদস্যদের মোটিভেশনসহ যাবতীয় কার্যক্রম। সূত্র মতে, এমএলএম পদ্ধতিতে সদস্য সংগ্রহ করে লোভনীয় পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে সহজ সরল মানুষকে তিয়ানশি নামের বিপণন কার্যক্রমে যুক্ত করা হয়। ওই কোম্পানির ওষুধ সেবন ও অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহার করে নিরীহ জনসাধারণ একদিকে যেমন মারাত্মক জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তেমনি আর্থিকভাবে হয়েছেন সর্বশান্ত। অথচ ফুড সাপ্লিমেন্টারির নামে চিকিৎসায় ব্যবহৃত এসব সামগ্রীর নেই সরকারের ওষুধ প্রশাসন, খাদ্য বিভাগ কিংবা বিএসটিআইয়ের কোন ধরনের অনুমোদন। চিকিৎসার ক্ষেত্রে ওষুধ ও ফুড সাপ্লিমেন্টারি ব্যবহারে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) অনুমোদিত চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র প্রদানের আইন থাকলেও স্বাস্থ্যঝুঁকির চিন্তা না করে মনগড়াভাবে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে যাচ্ছে তিয়ানশি সংশ্লিষ্ট স্বল্পশিক্ষিত কথিত চিকিৎসকরা। যাদের কারোরই চিকিৎসার ওপর কোন ডিগ্রী নেই। দীর্ঘদিন থেকে ভুয়া চিকিৎসার মাধ্যমে বেআইনী ফুড সাপ্লিমেন্টারি চড়া দামে ক্রয়ের পর ব্যবহার করে শত শত মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হলেও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা রয়েছেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। গৌরনদী পৌর এলাকার টরকী বন্দর জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ মামুন সিকদার জানান, তিনি গত তিন মাস পূর্বে শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিয়ানশি থেকে তাদের ব্যবস্থাপত্র মোতাবেক কিছু ওষুধ ক্রয়ের পর তা সেবন করে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে অবস্থার অবনতি হলে স্বজনরা তাকে ঢাকার হার্ট ফাউন্ডেশনে ভর্তি করেন। সেখানে দীর্ঘ চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে কয়েকদিন পূর্বে বাড়িতে ফিরেছেন। স্থানীয় স্কুল শিক্ষক শিরিনা বেগম তিয়ানশি থেকে ৩০ হাজার টাকার বিভিন্ন রোগের ওষুধ কিনেছেন। তিনি জানান, শরীরের বিষ ব্যথাসহ অন্যান্য রোগ নিরাময়ের ওষুধসহ উচ্চরক্ত চাপ থেকে রেহাই পেতে তিয়ানশি’র চিরুনী ক্রয় করেছেন কিন্তু পণ্য ব্যবহার ও ওষুধ সেবনে তিনি কোন উপকারই পাননি। একইভাবে নানা প্রলোভনে পড়ে স্থানীয় কামরুন নাহার তিয়ানশি থেকে কিনেছেন ২৩ হাজার টাকার ওষুধ ও পণ্য। সিমা আক্তার ১২ হাজার টাকার, নন্দনপট্টি গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ৯৫ হাজার, জেসমিন আক্তার ১০ হাজার, সিরাজুল ইসলাম ২৬ হাজার টাকার তিয়ানশির ওষুধ ও অন্যান্য পণ্য এবং নুরুজ্জামান মুন্সি ছয় হাজার টাকায় ক্রয় করেছেন মাথা ব্যথা নিরাময়ের মেশিন।একইভাবে গৌরনদী পৌর এলাকার ১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম, নন্দনপট্টি গ্রামের তারিন আহম্মেদ, ব্যবসায়ী হায়দার সিকদার, বাবুল হোসেন, গৃহিণী খালেদা পারভিন, কালকিনির বাবুল সরদার, রমজানপুর গ্রামের আলমাস বেপারি ও বেজগাতীর জুলহাস মুন্সিসহ অসংখ্য ব্যক্তিরা প্রত্যেকেই ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদরোগসহ অন্যান্য জটিল রোগের জন্য চড়া দামে তিয়ানশির ওষুধ সেবন ও অন্যান্য সামগ্রী কিনে প্রতারিত হয়েছেন। এসব ওষুধ সেবনে কোন উপকার তো হয়ইনি বরং প্রত্যেকেরই শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে বলে উপর্যুক্ত ব্যক্তিরা অভিযোগ করেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমএলএম পদ্ধতিতে সদস্য সংগ্রহের মাধ্যমে মুনাফা ও লোভনীয় পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি গ্রামের সহজ সরল মানুষকে তিয়ানশির বিপণন কার্যক্রমে যুক্ত করেন। বিক্রয় কাজে দক্ষতা ও সদস্য অন্তর্ভুক্তির সাফল্য অনুযায়ী একজন সদস্য ফার্স্ট স্টার থেকে শুরু করে এইট স্টার র‌্যাঙ্ক পর্যন্ত হতে পারেন। র‌্যাঙ্ক অনুযায়ী পুরস্কারের মাধ্যমে ল্যাপটপ, বিদেশ ভ্রমণ, প্রাইভেটকার ও বিলাসবহুল বাড়ির লোভনীয় অফার দেয়া হয়। সূত্র মতে, গৌরনদী উপজেলায় সংগঠনের সার্বিক দায়িত্ব পরিচালনা করছেন সেভেন স্টার র‌্যাঙ্কধারী নোয়াখালীর পারভেজ মাহমুদ ও মুন্সীগঞ্জের রমজান শেখ রবিন। রোগী দেখা, রোগ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপত্র প্রদানসহ অন্যান্য কার্যক্রম তারা দু’জনেই করে থাকেন। ব্যবস্থাপত্র লেখার কোন বৈধ কাগজপত্র রয়েছে কিনা জানতে চাইলে পারভেজ মাহমুদ বলেন, ডাক্তার সাহেব ভেতরে রয়েছেন। কিছু সময়ের মধ্যে সে কৌশলে পালিয়ে গেলেও প্রতারিতরা রমজান শেখ রবিনকে আটক করে বৃহস্পতিবার রাতে থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন। তিয়ানশির রোগ নির্ণয়ের ধরন ও ওষুধের মান সম্পর্কে জানতে চাইলে গৌরনদী উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফিরোজ হাসান বলেন, যে কোন ওষুধ অনুমোদিত ডাক্তার ব্যতীত ব্যবস্থাপত্র দেয়া আইনত দ-নীয় অপরাধ। তিনি আকুলাইভ ‘প্রি-প্যালথজিক্যাল ডায়গনস্টিক ডিভাইস’ দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে ধরে রোগ নির্ণয়ের বিষয় সম্পর্কে এবারই প্রথম শুনেছেন বলেও উল্লেখ করেন।আটক কথিত চিকিৎসক রমজান শেখ রবিনকে ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে গৌরনদী মডেল থানার ওসি মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে মামলা দায়ের করার জন্য কোন বাদী না পাওয়ায় মুচলেকা রেখে রবিনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। প্রতারণার ঘটনার কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
×