ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৬ অক্টোবর ২০১৭

রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন

রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন এক মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পীঠস্থান। সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আদর্শিক বোধ আর গভীর চৈতন্যে শিক্ষা কার্যক্রমের যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় তা যেমন যুগান্তকারী একইভাবে সার্বজনীন।পট বিশ্বপরিসরের জ্ঞানচর্চার এক অনবদ্য মিলনকুঞ্জ। প্রাচীন ভারতের নৈসর্গিক আবহের মধ্যে তপোবন বিদ্যালয়ের যে আদর্শিক নমুনা সেটাই কবিকে নানামাত্রিকে উদ্বুদ্ধ করে। সঙ্গত কারণে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ নামে বিদ্যালয়টি কবির চেতনালব্ধ বোধেরই এক নবসংস্করণ। শান্তিনিকেতনের বিদ্যাশ্রমের যাত্রা এভাবে শুরু হলেও পরবর্তীতে তা আরও ব্যাপক আকার আর বিশ্বজনীনতার অপার সুষমায় গড়ে উঠতে সময় নেয়নি। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদপুষ্ট এই বিদ্যালয়টি কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা আসীন হয়। ফলে কলকাতা থেকে দূরে এই বোলপুর অঞ্চলটি এক সময় দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। কথিত আছে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬০ সালে বোলপুরের কাছে একটি জমি ক্রয় করেন। মহর্ষি মাঝে মধ্যে বোলপুরে আসতেন বলে এখানে ‘শান্তিনিকেতন’ নামে একটি গৃহও নির্মাণ করেন। পর্যায়েক্রমে আশপাশের পুরো এলাকাটি শান্তিনিকেতন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই গৃহে মহর্ষি ধ্যানমগ্ন হয়ে নিজেকে নিরাকার ব্রহ্মের কাছে সমর্পণ করতেন। আর তার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি উপাসনাগৃহ বা ব্রহ্ম মন্দির। ১৮৯২ সালে এই মন্দির উদ্বোধন করে মহর্ষি তার আধ্যাত্ম চেতনাকে নিমগ্ন করলেন বিশ্ব প্রতিপালকের আরাধনায়। পিতৃভক্ত রবীন্দ্রনাথের কাছে শান্তিনিকেতনের এই গৃহ আর মন্দির ছিল প্রার্থনা আর বিদ্যাচর্চার এক পবিত্র মিলনকুঞ্জ। যেখানে শুধু দেশীয় ঐতিহ্য এবং চিরায়িত সংস্কৃতিরই আবাহন হবে না পাশাপাশি বিশ্বজনীনতার অপার সম্ভাবনাকেও জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করা হবে। সেই বোধ থেকেই ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু এবং শেষ অবধি তা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়া। দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে আজ শান্তিনিকেতনের এই শিক্ষার পীঠস্থানটি শুধু দর্শনীয়ই নয় বরং জ্ঞান সাধনার এক অনুপম সাধনাযজ্ঞ। রবীন্দ্রভক্ত মানুষের কাছে শান্তি নিকেতনের স্নিগ্ধ মনোমুগ্ধকর পরিবেশ এতটাই আকর্ষণীয় যে শুধু দেখার জন্য নয়, এখানে প্রকৃতির অবারিত দানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত জ্ঞান সাধনাকেও উপভোগ করতে অনেকেই তীর্থ দর্শনে চলে আসে। শান্তি নিকেতনের নিরবচ্ছিন্ন শুদ্ধ পরিবেশকে সমধিক প্রাধান্য দিয়ে কবি যেভাবে শিক্ষা পাঠ্যক্রমের বিষয়সূচী তৈরি করেছিলেন তা কেবল প্রচলিত শিক্ষাধারার ভিন্ন মাত্রারই নয় বরং সারা বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহাসম্মিলনের এক নিভৃত সাধনা কুঞ্জ। সুতরাং জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সৌন্দর্য অবগাহনে নিবেদিত দর্শনার্থীর কাছে এ এক পরম তীর্থস্থান যেখানে বিশ্বকবির সৃষ্টি আর কর্মবৈচিত্র্যের সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশমান ধারার এক নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ শান্তিনিকেতনের নির্মল আবহকে শুদ্ধতার পরম অনুভবে অম্লান করে তোলে। সেই শান্তিনিকেতন দর্শন সত্যিই এক অপরিমেয় সৌন্দর্য অবগাহন যা পবিত্রতম তীর্থ ভূমি দেখার আনন্দাবেগে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার মতো মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা। কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে ‘শান্তিনিকেতন’ এক্সপ্রেসে প্রায় সাড়ে তিন ঘণটার যাত্রায় পৌঁছানো যায় বোলপুর শহরে। যেখানে রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনের অপার সুষমায়মুগ্ধ আর বিমোহিত হওয়ার মতো পর্যাপ্ত আনন্দ আর বিনোদনের সঙ্গে জীবন গড়ারও এক বৈষয়িক ব্যবস্থা বিরাজমান। অর্থাৎ দেশীয় ঐতিহ্য আর বিশ্বপরিসরের অবাধ ও মুক্ত জ্ঞানচর্চার এক অভাবনীয় আবহ যা কোন মানুষকে তার নান্দনিক স্বপ্নের দ্বারে পৌঁছে দিতে নিরন্তর কর্মপ্রবাহ অব্যাহত রেখেছে। মূলত শান্তিনিকেতনের কার্যক্রমের মূল স্থপতি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার হাত দিয়ে তৈরি ‘শান্তি নিকেতনের গৃহ’ আর দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যে শুভ যাত্রা শুরু করে এই বিশেষ প্রাঙ্গণটি সেখানে যুগের পরিবর্তনের সময়ের দাবিতে আরও কত জীবন আর কর্ম ঘনিষ্ঠ কার্যক্রমের বিকাশ ঘটে তার সামগ্রিক সমৃদ্ধতা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের এই তীর্থ ভূমিটি যা আজও সুশোভিত জীবন গড়ার কারিগর সর্বোপরি নান্দনিক আবহে পরিশুদ্ধ বিদ্যাচর্চার উন্মুক্ত সাধনকেন্দ্র। পিতার শুভ উদ্যোগকে চেতনায় ধারণ করে বিশ্ববরেণ্য কবি দেশীয় ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে লালনের মধ্যে বিশ্বজনীনতার যে অপার ভা-ারকে সম্পৃক্ত করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন সেখান থেকেই শান্তিনিকেতনের সমৃদ্ধ গৌরব নিরবচ্ছিন্ন গতিধারায় বেগবান হয়েছে। সারাদেশ আর বিশ্ব পরিভ্রমণ করা রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন ঐতিহ্যিক মূল্যবোধ থেকে যেমন চ্যুত হওয়া যাবে না পাশাপাশি বিশ্বের অবাধ আর মুক্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকেও জীবন ও দেশ গড়ার অপরিহার্য শর্ত হিসেবে সন্নিবেশিত করা সব থেকে বেশি জরুরী। তাই শান্তিনিকেতনে দেশ-বিদেশের প্রাজ্ঞ গুণীজনরা যেমন জ্ঞান সাধনার মহৎ কর্মে সম্পৃক্ত হয়েছেন একইভাবে সারা পৃথিবী থেকে আগত শিক্ষার্থীদেরও মিলনকুঞ্জে পরিণত হয়েছে। ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ব্রহ্মচর্চাশ্রম’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্দেশ্য ছিল শুধু পঠন-পাঠনই নয় একজন শিক্ষার্থীর নান্দনিক বিকাশ থেকে শুরু করে দেশাত্মবোধের বৈশিষ্ট্যসহ বৈশ্বিক জ্ঞানচর্চাকে নিবিড়ভাবে যুক্ত করা। প্রায় বিশ বছর এই কার্যক্রম চলতে থাকে। ১৯২১ সালে সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে এই বিদ্যানিকেতনটিকে ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ভুক্ত করা হয়। সর্বভারতীয় বর্ণাশ্রম প্রথার কঠিন নিগড়ে আবদ্ধ অশুভ সঙ্কেতটি কবি কখনও মানতে পারেননি। একেবারে শুরু থেকে সামান্য প্রভাব পড়লেও পর্যায়ক্রমে তা সর্বসাধারণের জন্য অবাধ ও মুক্ত হয়ে যায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই শান্তিনিকেতনের এই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা এবং শিক্ষার্থী হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে। অদ্যাবধি সে ধারার ব্যতিক্রম হয়নি। বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এবং চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায় কবিগুরুর স্নেহভাজন এবং আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। স্টেশন থেকে নেমেই শান্তিনিকেতনের পথে যাত্রা শুরু করার মাধ্যম হিসেবে অটো এবং রিক্সার মতো যানবাহনই যথেষ্ট। বর্তমানে শান্তিনিকেতনের সামগ্রিক প্রাঙ্গণটি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে। যেখানে শান্তিনিকেতন গৃহ, ছাতিমতলা, আম্রকুঞ্জ, কলা ভবন, সঙ্গীত ভবন, পাঠ ভবন থেকে শুরু করে আরও অনেক প্রয়োজনীয় ভবন আছে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে অচ্ছেদ্য। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এসব ভবনের স্থপতি। কেন্দ্রীয় পাঠাগার, অতিথি ভবন, শান্তিনিকেতন, ডাকঘর, গবেষণা কেন্দ্র, পল্লী শিক্ষা ভবন এবং মেলা প্রাঙ্গণের মতো অতি আবশ্যক বিষয়গুলোও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সবচেয়ে যা দর্শনীয় কিংবা দৃষ্টিনন্দন তা হলো আপন প্রকৃতির বেড়াজালে দেশীয় সম্পদ আর বিশ্বজনীনতার অপার সুষমাকে ধারণ করে নিরন্তর চর্চার এক অভাবনীয় নিমগ্নতা। শৈশব এবং কৈশোরের নিজের শিক্ষা জীবনে কবি কখনও স্বাচ্ছন্দ্য আর স্বস্তি বোধ করেননি। সেই চেতনা থেকে নিজের তৈরি শিক্ষাঙ্গনকে এতটাই উন্মুক্ত আর সার্বজনীন করেছিলেন যাতে অবাধ জ্ঞানচর্চাকে কোন নির্দিষ্ট বলয়ে আবদ্ধ করতে না হয়। বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় পাঠাগার দেশ-বিদেশের জ্ঞানচর্চার এক অভাবনীয় মিলনযজ্ঞ। ‘মেলা প্রাঙ্গণ’ শান্তিনিকেতনের সমস্ত উৎসব আর মেলাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। পিতা মহর্ষির আমল থেকেই এখানে পৌষমেলার আয়োজন করা হতো। সেই কারণে আশপাশে কিছু কুটির ও হস্তশিল্প গড়ে ওঠা যা গ্রামীণ অর্থনীতির সহায়ক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। সময়ের গতিতে এই অর্থনীতি তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় আরও গতিশীল হয়েছে ঠিকই কিন্তু হস্তচালিত শৈল্পিক সম্ভার তার নিজস্বতার কিছু জায়গাও ছেড়ে দিতে হয়। তার পরেও বিভিন্ন বস্ত্র সামগ্রীর ওপর বুটিকের হরেক রকমের কারুকার্য আজও তার শৈল্পিক দ্যোতনায় অম্লান হয়ে আছে যা শুধু দর্শনীয় নয় ব্যবহারিক মাত্রায়ও এক অনবদ্য অবদান রেখে যাচ্ছে। শান্তিনিকেতনের আর এক আকর্ষণীয় এবং নান্দনিক বৈশিষ্ট্য এই মেলা প্রাঙ্গণের যা পর্যটন শিল্পকেও অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। মেলা প্রাঙ্গণের বিভিন্ন উৎসব আর আনন্দের বর্ণিল আয়োজনে। ‘মেলা প্রাঙ্গণ মহর্ষির হাত দিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া পৌষমেলায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং আরও অনেক স্বদেশীয় সমৃদ্ধ বৈভবের শুভযোগ হয়েছে। যেমন ১ বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শান্তিনিকেতনের এক অনিন্দ্যসুন্দর শুভ উৎসব। বর্ষণস্নাত আবহমান বাংলার ‘বর্ষামঙ্গল’ ও শাান্তিকিনেতনের আনন্দমেলার অনুষঙ্গ হয়েছে। একইভাবে শরতকে আবাহনের মধ্য দিয়ে শরতবন্দনাও মেলা প্রাঙ্গণের অন্যতম এক বিশিষ্ট আয়োজন। আর বসন্ত উৎসব তো শান্তিনিকেতনের আর একটি বিশিষ্ট পর্যায় যা মেলা প্রাঙ্গণকে নানামাত্রিক পূর্ণ করে তোলে। আর এসব মহৎ কর্মযোগের স্থপতি কবি গুরুর জন্মবার্ষিকীর মতো মঙ্গলবার্তা তো আছেই, যা মেলা প্রাঙ্গণের পুরো নৈসর্গিক আবেদনকে কানায় কানায় ভরিয়ে দেয়। সব মিলিয়ে শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক সম্ভার ভ্রমণকারী আর দর্শনার্থীদেও কাছে যে পরিমাণ আনন্দযোগের আবহ তৈরি করে তা নিজে উপলব্ধি করতে না পারলে সে মাত্রায় যাওয়া আসলে কঠিন। জ্ঞানচর্চাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে পারিপার্শ্বিক ঐশ্বর্য্যকি ম-লকে বিবেচনায় রেখে আনন্দ আর উৎসবের অনুষঙ্গও নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করতে না পারলে সার্বজনীন জ্ঞানের পরিধি কখনই পূর্ণমাত্রাকে স্পর্শও করতে পারবে না। তাই শান্তিনিকেতন শুধু নির্মোহ আবেগ, কিংবা শান্তির নিরবচ্ছিন্ন কুঞ্জই নয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিরন্তর গতি, আনন্দলোকের পরিশুদ্ধ তীর্থস্থান সর্বোপরি উৎসব আয়োজনে এক বর্ণিল সমারোহের মিলনমেলা। যা নিজের চোখে দেখতে না পারলে অনুভব করা আসলেই মুশকিল। সত্যজিত রায়কে লিখে দেয়া রবীন্দ্রনাথের কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি এখানে উল্লেখ্য দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের পরে একটি শিশির বিন্দু।...
×