ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মহামিলনের বিজয়া দশমী আজ

হৃদয়ের ভক্তি, ইন্দ্রিয়ের শুদ্ধতা, অসুরের বিরুদ্ধে সুরশক্তির জয়গান...

প্রকাশিত: ০৫:১১, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

হৃদয়ের ভক্তি, ইন্দ্রিয়ের শুদ্ধতা, অসুরের বিরুদ্ধে সুরশক্তির জয়গান...

সমুদ্র হক হৃদয়ের ভক্তি। ইন্দ্রিয়কে শুদ্ধ। অসুর শক্তির বিরুদ্ধে সুরশক্তির জয়গান। এভাবেই আজ বিজয়া দশমীর মাধ্যমে শেষ হচ্ছে শারদীয় উৎসব। সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলার পাঁচটি দিন যে কখন ফুরিয়ে গেল...। মন্ডপগুলোতে নারী, পুরুষ, শিশুদের ভিড়। যেখানে হৃদয়ের গভীর থেকে ভক্তি নিবেদন দর্শনার্থী ও পূজারীদের। বগুড়ার দত্তবাড়ির পূজাম-পের পুরোহিত বললেন, পূজা উপাসনা ভাব ভক্তি অর্থ ইশ্বরকে ভালবাসা। এর মাধ্যমেই সর্বজনীনতার উন্মেষ ঘটে। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সুন্দরের আহ্বান জানানো হয়।” ষষ্ঠী থেকে দশমী- এই পাঁচদিন পূজায় ব্যবহারের পাঁচটি পদ থাকে। পঞ্চ পল্লব, পঞ্চ শস্য, পঞ্চগব্য, ফুল ফল, দূর্বা, তুলসীসহ নানা কিছু। রামায়ণে আছে- রামচন্দ্র দুর্গাপূজায় দেবীকে ১শ’ ৮টি নীলপদ্ম অঞ্জলি দেয়ার সময় একটি কম পড়লে তিনি (রামচন্দ্র) নিজের চোখ তুলে নিতে উদ্যত হন। দেবী মুগ্ধ হয়ে তাকে রক্ষা করেন। সেই থেকে সুন্দর চোখকে পদ্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়। শ্যামল মিত্রের কণ্ঠের একটি গানের কথা ‘ওই পদ্ম চোখের নীল যমুনায় আমি ঝাঁপ দিয়েছি...’। পূজায় থাকে নব পত্রিকা। এর অর্থ নয়টি গাছের উপকরণ। যে গাছের কাছে দেবী দুর্গা আশ্রয় নিতেন। এই নব পত্রিকা বসুন্ধরার প্রতীক। শারদীয় উৎসবকে বলা হয় চিত্ত শুদ্ধের মিলনমেলা। উৎসবের কয়েকটি দিন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ঘরে বয়ে যায় আনন্দধারা। তারা সকল ধর্মের মানুষকে নিমন্ত্রণ জনায়। সম্প্রীতির এক মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সুনামগঞ্জের সাধক বাউল শাহ আব্দুল করিমের গান উদাহরণ হয়ে আসে। তিনি গেয়েছেন ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম, গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু- মুসলমান মিলে বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম, হিন্দু বাড়িতে নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম, জারি গান, গাজীর গান হইত, রঙ্গে গাইতাম আর আনন্দ পাইতাম...।’ শারদীয় উৎসব যেন তার এই গানের মতোই। এ যেন সম্প্রীতির এক চিরন্তন বাঁধন। মিলনের এমন তিথিগুলোতে দেবী দুর্গাকে পরানো হয় বেনারসি শাড়ি। এই রেশ ধরে মেয়েরাও পরে বেনারসি শাড়িসহ নতুন ঝলমলে শাড়ি। কোমরে বিছা, নাকে নথ, পায়ে নূপুর। বিজয়া দশমীর দিনে হিন্দু নারী মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়। এই সিঁদুর খেলায় তরুণীদের উচ্ছ্বাসটি বেশি। ছেলেদের পরনে থাকে বাহারি পাঞ্জাবি ও কুঁচি দেয়া গরদের ধূতিসহ নানা রঙের ধূতি। নিমন্ত্রণের পালায় লুচি, লাবড়া, নারকেলের নাড়ু, বুন্দিয়া, খিঁচুড়ি, ফিরনি, পায়েসসহ কত কি! পূজাম-পে ধূপের ধোঁয়ার আরতিতে মনে হবে মেঘের মধ্যে দুর্গার ডান পাশে লক্ষèী ও গণেশ। যারা যথাক্রমে ঐশ্বর্য সম্পদ ও সিদ্ধিদাতা গণঐক্যের প্রতীক। বাঁ পাশে জ্ঞানের প্রতীক সরস্বতী ও শৌর্য-বির্যের প্রতীক কার্ত্তিক। পুরাণে বর্ণনা আছে, দুর্গা হিমালয় ও মেনকা দম্পতির কন্যা এবং শিবের পতœী। দুর্গার আরেক নাম উমা। দেবী উমা থাকেন কৈলাসে পতিগৃহে। সিংহের ওপর চড়ে বিশ্বব্রহ্মা-ে বাবা-মায়ের ঘরে আসেন। মর্ত্যে আগমনের প্রতীক্ষায় মা মেনকার সে কী ব্যাকুলতা! তারপর বিশ্ব ভুবনে মায়ের বাড়িতে দুর্গা তার পরিবারসহ কয়েকদিন থাকার পর ফিরে যান কৈলাসে। বিজয়া দশমী সেই ফিরে যাওয়ার ক্ষণ। মার্কেন্ডেয় পুরাণে ৮১ থেকে ৯৩ পর্যন্ত তেরোটি অধ্যায় নিয়ে আছে দুর্গা মাহাত্ম্য। মহামায়া দেবীর মাহাত্ম্য অংশে মন্ত্র সংখ্যা ৭শ’। এই গ্রন্থকে সপ্তশতীও বলা হয়। এক অধ্যায়ে আছে- রাজা যুধিষ্ঠির বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দুর্গার আরাধনা করেছিলেন। মহাভারতের বিরাট পর্বে ষষ্ঠাধ্যায়ে দেবীর স্তোত্রে আছে- দ অক্ষরটি দৈত্যনাশক, উ কার বিঘœ নাশক, রেফ রোগ নাশক, প পাপ নাশক, আ কার শত্রু নাশক। অর্থাৎ দৈত্য বিঘœ রোগ পাপ ভয় শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। অনেক নামে দুর্গার পূজা হয়। যেমন দুর্গা, মহিষমর্দিনী, শূলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারি, বাহারী, চ-ী, উমা, হৈমবতি, কমলা, শিবানী, যোগনিদ্রা ইত্যাদি। বিশ্বজুড়ে এখন এক অস্থির অবস্থা। কোথাও যুদ্ধের আভাস। কোথাও অন্যায়। কোথাও মানবতা বিলীন। অশুভ শক্তিগুলো যেন অসুরের মতোই ছুটে আসছে। সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় মহাশক্তি নিয়ে বিশ্বভুবনে আবির্ভাব মহামায়া দুর্গার। দেবী দুর্গার দশ হাতে দশটি অস্ত্র। একইভাবে দশ হাতে একতাবদ্ধ হওয়া তথা সম্মিলিত শক্তির প্রতীক। শঙ্খ ওঙ্কার ধ্বনীর প্রতীক। তীর-ধনুক দেবীর শক্তিমত্তার প্রতীক। বজ্রাগ্নি সংকল্পের দৃঢ়তা। পদœ আত্মার বিকাশ লাভ। সুদর্শনচক্র শুভতার লালন ও অশুভতার বিনাশ। তলোয়ার জ্ঞানের ইঙ্গিত। ত্রিশূল স্বত্ব, রজঃ, তমঃ ও গুণের প্রকাশ। এভাবেই দেবী দুর্গা বৈষম্য নীপিড়নের বিরুদ্ধে সত্য ও শান্তির প্রকাশ ঘটান।
×