ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ সীমান্ত বন্ধ করে দিলে লক্ষাধিক নিহত হওয়ার আশঙ্কা ছিল- গোয়েন্দা রিপোর্ট

রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় কূটনৈতিক সাফল্য আকাশচুম্বী

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় কূটনৈতিক সাফল্য আকাশচুম্বী

শংকর কুমার দে ॥ মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন যেভাবে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে তাতে বাধা দিয়ে বাংলাদেশ যদি সীমান্ত সীল করে দিত তাহলে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা হতাহতের আশঙ্কা ছিল বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু তা না করে বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দিয়ে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গকে ঢুকতে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ সেøাগানের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে। এতে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘে আলোচনা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জোরালো সমর্থন, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার ত্রাণ তৎপরতা, পুনর্বাসনের উদ্যোগসহ নানামুখী পদক্ষেপ বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন আকাশচুম্বি, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ৪৬ বছরের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন কৃতিত্ব। মিয়ানমারে জাাতিগত নিধনের জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, আগুন দেয়াসহ মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বরোচিত ঘটনা ঘটিয়েছে তার বর্ণনাসহ রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে ফেরত না নেয়া পর্যন্ত পুনর্বাসনসহ বহুমুখী পদক্ষেপের তথ্য সংগ্রহ করছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা কক্সবাজার, বান্দরবান জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও সীমান্ত এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হচ্ছে, মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সময় বাংলাদেশ যদি সীমান্ত সীল করে দিত তাহলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই দেশের সীমান্তরক্ষীর গোলাগুলিতে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নিহত ও দুই দেশের সীমান্তরক্ষীর মধ্যে গোলাগুলি ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে, যা বাংলাদেশে এককভাবে প্রশংসার দাবি রাখে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতার জের ধরে বাঁধভাঙ্গা ¯্রােতের মতো রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার ঘটনা ঘটার পর গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে এই ধরনের আশঙ্কার কথা অবহিত করা হয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে। প্রাণে বাঁচার আকুতি নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিতে সম্মত হয় সরকারের নীতিনির্ধারক মহল। গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদন থেকে এই ধরনের তথ্য জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মিয়ানমারে গত ২৫ আগস্ট যে রোহিঙ্গা জাতিগত নিধ যজ্ঞ শুরু হয় তার অন্তত আরও ২৩ দিন আগে গত ২ আগস্টে পরিকল্পনা নেয়া হয়। ২ আগস্টের ৮ দিন পর গত ১০ আগস্ট রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের প্রস্তুতি শুরু করে মিয়ানমার সরকার। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার অনতিদূরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সীমানায় তারা সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য ও সীমান্তরক্ষী নিয়োগ করে। এতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে উদ্বেগের পাশাপাশি নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়, যা অবহিত করা হয় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। গত ২৪ আগস্টে মিয়ানমারের জাতিগত নিধনের বিষয়ে জাতিসংঘের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল কোফি আনান কমিশনের রিপোর্ট প্রদান করার পর আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশের চৌকিতে আক্রমণ ও পাল্টা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের ঘটনাটি ঘটেছে আকস্মিকভাবে, দ্রুতগতিতে, যার পরিণতিতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজার, বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলায়। আকস্মিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনায় যদি বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা বাধা দিতে গিয়ে গুলি করত এবং তারা আবার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যেতে বাধ্য হলে সেখানকার সীমান্তরক্ষীরাও গুলি করত, তাহলে পরিণতি কি দাঁড়াত ? এতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের গোলাগুলিতে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নিহত ও দুই দেশের সীমান্তরক্ষীর মধ্যে গোলাগুলি ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল বলে মতামত ব্যক্ত করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন হাজার হাজার নারী, পুরুষ, শিশু, সন্তান নিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামার দুদিন পর গত ২৭ আগস্ট বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ, সশস্র বাহিনী বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টাস্কফোর্সের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনায় উল্লেখ করা হয়, গত ২ আগস্ট আরসা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে ¤্রাে সম্প্রদায়ের কয়েক লোককে হত্যা করে, যার ফলে রাখাইন রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। মিয়ানমার সরকারের নির্দেশে ওই দিন থেকেই প্রাণে বাঁচার জন্য সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমার থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশু বাংলাদেশে আগমনের ঘটনা ঘটতে থাকে। বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে আসার ঘটনা ঘটতে থাকলে তাদের বাধাদান থেকে বিরত থাকেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা। গত ২৮ আগস্ট বিজিবির পক্ষ থেকে এক প্রতিবেদন পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এতে বলা হয়, গত ১০ আগস্ট মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যের বুথিডং ও রাথিডংয়ে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করে, যা পরবর্তীতে রোহিঙ্গা নিধনে পরিণত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন যেভাবে হাজার হাজার নর-নারী, শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণীর রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে তাতে যদি সীমান্ত সীল করে দেয়া হতো তাহলে পরিণাম কি দাঁড়াত তা কি চিন্তা করা যায় ? বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা যদি গুলি করত তাহলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় রোহিঙ্গারা হতাহত হতো। অপরপক্ষে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের গুলির মুখে তারা মিয়ানমারে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, আগুন দেয়াসহ বন্দুকের নলের মুখে যারা চলে আসছিল তারা যদি আবার ফিরে যেতে বাধ্য হতো তখন মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীরা গুলি করলে সেখানেও রোহিঙ্গাদের হতাহতের ঘটনা আরও বেড়ে যেত, যা কল্পনারও বাইরে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন যে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে তার বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে অবহিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ এই নীতি অবলম্বন করে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশকে মানবতা ও শান্তির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন যা অনন্য নজির হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাবে।
×