ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কারাতেকা লতার আবেগ-অনুভূতি

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

কারাতেকা লতার আবেগ-অনুভূতি

রুমেল খান ॥ কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। তেমনি কারাতের শিল্পী হতে চান লতা পারভীন। তিনি শুধু কারাতেকাই নন, পুলিশও বটে। ২৬ বছর বয়সী সুদর্শনা লতা বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রথম মহিলা হিসেবে কারাতেতে আন্তর্জাতিক জাজ হবার গৌরব অর্জন করেছেন। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান কারাতে ফেডারেশনের জাজ পরীক্ষা। এতে উত্তীর্ণ হন পঞ্চগড়ে জন্ম নেয়া লতা (বর্তমান নিবাস চট্টগ্রামের লালখান বাজার, বাঘঘোনা, খুলশীতে)। লতা এখন এশিয়ান কারাতে ফেডারেশনের (একেএফ) প্রথম মহিলা বাংলাদেশী কারাতে জাজ। এ প্রসঙ্গে তার অনুভূতি, ‘যতদূর জানি, আমার আগে এক মহিলা ২০১১ সালে একেএফে পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে পারেননি। সেক্ষেত্রে আমিই প্রথম বাংলাদেশী মহিলা কারাতে জাজ। বিষয়টি আমার এবং বাংলাদেশের জন্য অনেক আনন্দের ও গর্বের। এটা একটা বড় অর্জন। বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর অব জেনারেল শহীদুল হক পিপিএম আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তাছাড়া ফেডারেশন থেকে সংর্বধনা পেয়েও খুব ভাল লাগছে।’ তবে এ প্রসঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পেষণ করেছেন কারাতে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শেখ আলী আহসান বাদল। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আশির দশকে প্রথম নারী হিসেবে রানী পাদমসি কারাতে জাজ হয়েছিলেন। তবে তখন কারাতে ফেডারেশন ছিল জুডো ফেডারেশনের সঙ্গে একীভূত। ফলে সেই হিসেবে কারাতে ফেডারেশেনের প্রথম নারী কারাতে জাজ হিসেবে লতার নাম উল্লেখ করতে পারেন।’ বাবা আজিজুল হক, কৃষিজীবী। মা রহিমা বেগম, একটি বেসরকারী স্কুলের কর্মচারী। দুই বোনের মধ্যে লতা ছোট। বাংলাদেশ পুলিশের মহিলা সদস্য হিসেবে যোগ দেন ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। পঞ্চগড়ের আবেদা হাফিজ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় কখনও কারাতে খেলেননি লতা। খেলেছেন হ্যান্ডবল, ভলিবল এবং ব্যাডমিন্টন। জিতেছেন কিছু পুরস্কারও। তাহলে কারাতেতে আসলেন কিভাবে? পুলিশে জয়েন করার বছরই সেবার মহিলা পুলিশ কারাতে দল গঠন করা হয়। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ট্রায়াল দেন ৯৬ জন। টেকেন ৮২ জন। লতা তাদেরই একজন। ‘নিজ থেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছিলাম কারাতেতে যোগ দিতে। তাছাড়া আমার ফিটনেসও ছিল ভাল।’ কলম্বোতে লতাদের পরীক্ষা হয়েছিল দু’দিনব্যাপী সাত এ্যাঙ্গেলে। লিখিত ও প্র্যাকটিক্যাল। ২০০ নম্বরের পরীক্ষা। সব পরীক্ষায় হয় প্রজেক্টরে। এতে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে শতাধিক কারাতে জাজ অংশ নেন। কারাতেকা হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে লতার সাফল্য হচ্ছে : ২০১৪ সালে +৬৮ কেজিতে এবং ২০১৬ সালে +৭১ কেজিতে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে রৌপ্যপদক, আঞ্চলিক ও ক্লাব পর্যায়ে ১১টি স্বর্ণসহ মোট ১৯ পদক অর্জন, আন্তঃপুলিশ চ্যাম্পিয়নশিপে (পুলিশ ন্যাশনাল) ২০১৪, ১৫ ও ১৬ সালে +৬১ কেজিতে হ্যাটট্রিক স্বর্ণপদক অর্জন, বাংলাদেশ পুলিশের বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদের পুরস্কার লাভ ২০১৬ সালে এবং ২০১৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল ওমেন্স ডে উপলক্ষে বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে সাহসিকতার জন্য ‘মেডেল অব কারেজ’ লাভ। এছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ২০১৫ ও ১৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত সেইসিনকাই উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক কারাতে প্রতিযোগিতায় +৬৮ কেজিতে এবং ২০১৭ সালে +৬৫ কেজিতে স্বর্ণপদক লাভ। ভারত ছাড়াও শ্রীলঙ্কায় খেলতে যাবার অভিজ্ঞতা আছে লতার। কারাতেকা, কোচ ও জাজ হিসেবে ভবিষ্যত লক্ষ্য? ‘খেলোয়াড়ী জীবন ক্ষণস্থায়ী। যতদিন সুস্থ-সবল থাকব, খেলব। এছাড়া একটি কারাতে একাডেমি বা ক্লাব তৈরির স্বপ্ন দেখি। যেখানে ছোট বাচ্চা ও ত্রিশোর্ধ মহিলাদের কারাতে প্রশিক্ষণ দেয়ার ইচ্ছে আছে। যদিও বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম পুলিশ ইন্সটিটিউশনের ছাত্রীদের এবং চট্টগ্রাম কারাতে এ্যাসোসিয়েশনের মহিলা সদস্যদের কারাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। ২০১১ সালের এপ্রিলে প্রেম করে বিয়ে করেন লতা। স্বামী শরীফজাদা কাউসার আহমেদও কারাতের মানুষ। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের চীফ কারাতে কোচ, বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনের বিভাগীয় কোচ এবং চট্টগ্রাম কারাতে এ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চীফ কোচ তিনি। লতা ছাড়াও আরও চারজন কারাতে জাজ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে বৃহস্পতিবার ফেডারেশন থেকে সংবর্ধনা পান, কাউসার তাদেরই একজন। মজা করে লতা বলেন, ‘আমরা দু’জন বাংলাদেশের দুই প্রান্তের মানুষ। আমি পঞ্চগড়ের, আমার স্বামী (কাউসার সেনসি নামেই বেশি পরিচিত) চট্টগ্রামের। এ যেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। আমাদের দু’জনকে এক করেছে এই কারাতেই। আমি যখন পুলিশে যোগ দিই কারাতে দলে, তখন কাউসার কোচ হিসেবে আমাদের কারাতে শেখাতে আসেন। সেখানেই প্রথম দেখা, পরিচয়, প্রেম এবং বিয়ে। পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে করি আমরা।’ লতা-কাউসার দম্পত্তির পাঁচ বছর বয়সী একটি ছেলে আছে নাম কামরান শরীফ। সেও কি কারাতেকা হবে? ‘সেটা ওর ইচ্ছে। তবে এখনই তার কারাতেতে আগ্রহ আছে। আমাদের সঙ্গে প্রায়ই অনুশীলন করে।’ স্কুল পর্যায়ে বেশি করে কারাতে টুর্নামেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে কারাতেকা সৃষ্টি, বেশি করে কোচ ও জাজ তৈরি করার মাধ্যমেই বাংলাদেশের কারাতেকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব বলে মনে করেন লতা।
×