ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এসিড সন্ত্রাসে মরিয়মের জীবন গড়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

এসিড সন্ত্রাসে মরিয়মের জীবন গড়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল ফল করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন বুনলেও প্রেমের টানে মরিয়ম (২০) বিয়ে করেন তার পাশের গ্রামের এক মোবাইল মেকানিককে। আবেগের তাড়নায় বিয়ে করলেও কিছুদিন পর থেকে মরিয়ম তার স্বামীর আসল রূপ টের পেতে থাকেন। প্রায়ই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বাড়িতে ফিরে স্বামী তাকে মারধর করতে শুরু করেন। এক সময় যৌতুকের টাকা দাবি করলে মরিয়ম তার মা-বাবার কাছ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা নিয়ে স্বামীর হাতে দেন। এভাবেই কেটে যায় ৩ বছর। কিন্তু সংসারে অশান্তি বাড়তেই থাকে। গত বছরের নবেম্বর মাসে মরিয়ম তার বাবার বাড়িতে ফিরে আসে এবং তার স্বামীকে ডিভোর্স লেটার পাঠান। এরপর মরিয়ম তার মায়ের সঙ্গে সাভারে এসে একটি পোশাক কারখানায় যোগ দেন। দীর্ঘ ৯ মাস তাদের যোগাযোগ বন্ধ থাকে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! কোরবানির ঈদ করতে মরিয়ম তার বাড়ি হালুয়াঘাটে যান। ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় মরিয়মের স্বামীর পরামর্শে তার মামাত ভাই আল-আমিন ঘরের জানালা দিয়ে মরিয়মের মুখে এসিড ছুড়ে মারে। এ ঘটনায় মরিয়মসহ তার পাশে থাকা ছোট দুই ভাইবোন মহিরন ও রাসেলও এসিড সন্ত্রাসের শিকার হন। পরবর্তীতে অপরাধীরা আইনের আওতায় এসেছে। বর্তমানে তারা জেলে রয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে মরিয়ম। এসিড দগ্ধ মরিয়ম বর্তমানে রাজধানীর মিরপুর-১৪ নম্বরে অবস্থিত সিআরপি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের অধীনে বিনা খরচে চিকিৎসা চলছে তার। মঙ্গলবার সরেজমিনে হাসপাতালের কেবিনে গিয়ে দেখা গেল, জানালা দিয়ে আকাশপানে তাকিয়ে আছে মরিয়ম। তার ডান হাত ও বুক থেকে পেট পর্যন্ত ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো। পুরো মুখে দগ দগে ঘা। তিনি জনকণ্ঠকে জানালেন, ‘বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করে যে ভুল করেছিলাম তা ডিভোর্সের পরে চাকরি করে স্বাবলম্বী হয়ে শুধরানোর চেষ্টা করছিলাম। বাবা-মা, ভাইবোনকে নিয়ে সুখে থাকার স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু মাঝপথেই থেমে যেতে হলো। আমি তার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। সে যেন কখনও জামিনে মুক্ত হতে না পারে। আমার মতো এ পরিণতি যেন কোন মেয়ের না হয়।’ কথাগুলো বলতে বলতে মরিয়ম অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। মরিয়মের মতো দেশের অনেক নারী বিভিন্নভাবে এসিড সন্ত্রাসের মুখোমুখি হচ্ছে। এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৩০ নারী। এছাড়া, ১৯৯৯-২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট এসিড ভিকটিমের সংখ্যা ৩ হাজার ৭১২ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের বিগত আট মাসে ২৬ নারী এসিড দগ্ধ হয়েছেন এদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীর নাখালপাড়ায় পাষ- স্বামী যৌতুক না পেয়ে স্ত্রী আকলিমার মুখে এসিড ছুড়ে মারে। জীবনের সঙ্গে টানা ২ মাস যুদ্ধ করে সুস্থ হলেও নিজের এক চোখ ও সুন্দর মুখমন্ডলটি হারাতে হয়েছে তাকে। এছাড়া, জুন মাসে কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়ায় কলেজছাত্রী আইরিন (১৬) এসিড সন্ত্রাসের শিকার হন। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে দুর্বৃত্তরা তার গায়ে এসিড ছুড়ে মারে। কিন্তু আইরিন বোরকা পরিহিত থাকায় এসিডে তার মুখ ঝলসে না গেলেও পিঠ ঝলসে যায়। তবে কি কারণে তাকে এসিড মারা হয় এ বিষয়ে আইরিনের কোন ধারণা ছিল না। এ ঘটনায় অপরাধী এখনও শনাক্ত হয়নি বলে জানা গেছে। সঠিক বিচারের অভাবে এসিড সন্ত্রাসের মতো ভয়াবহ ঘটনা বাড়ছে। সেই সঙ্গে এসিড বেচাকেনায় কড়াকড়ি কোন আইন না থাকার ফলে এসব রোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। কঠোর আইন এবং সরকারী ও বেসরকারী অনেক উদ্যোগের পরও কমেনি নারী নির্যাতনের চিত্র। নির্যাতনের মাত্রায় বরং যোগ হচ্ছে অভিনব কৌশল। তুলনামূলক হারে এসিড সন্ত্রাসের ঘটনা হ্রাস পেয়েছিল গত বছর। যা অনেকের মনেই স্বস্তি এনে দিয়েছিল। ২০১৬ সালে ৩৪ জন নারী ও শিশু এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে।
×