ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিরাজদিখানে পিক্স সিনেপ্লেক্স

ভাঙ্গার বিপরীতে নির্মাণের গল্প, সিনেমার সুদিন ফেরানোর চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ভাঙ্গার বিপরীতে নির্মাণের গল্প, সিনেমার সুদিন ফেরানোর চেষ্টা

মোরসালিন মিজান একটি পরিসংখ্যানে চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক আগে। পরিসংখ্যানটি বলছে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশে সিনেমা হল ছিল ১ হাজার ৪৩৫টি। এরপর আর বাড়েনি। কমেছে শুধু। এখন সংখ্যাটি ৪০০। ভাবা যায়? গত কয়েক বছরে ঢাকায় ২৩০টি, চট্টগ্রামে ৮৭টি, বরিশালে ৩৬টি, রাজশাহীতে ১৪২টি, সিলেটে ২৫টি, খুলনায় ৯৪টি ও রংপুরে ১০৬টি সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে। সময় যত গড়িয়েছে, আধুনিক হয়েছে শহর। নতুন নতুন বিল্ডিং হয়েছে। চলছে মার্কেট শপিংমল নির্মাণ। শুধু সিনেমা হল নির্মাণের কোন উদ্যোগ নেই। শিল্প সংস্কৃতির চর্চা কমছে। বিনোদনের অভাবে কূপম-ূকতার দিকে ঝুঁকছে মানুষ। এবার সাম্প্রতিক সময়ের আলোচনাটি। আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ভাঙ্গনের বিপরীতে নির্মাণের গল্প নিয়ে সামনে এসেছেন। অগ্রজ অনুজ বন্ধু সুহৃদদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি সিনেপ্লেক্স। না, রাজধানী শহরকেন্দ্রিক কিছু নয়। ঢাকার বাইরে সিরাজদিখানে সুন্দর পরিবেশে সিনেমা দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। পিক্স সিনেপ্লেক্স নামে ঈদের আগে আগে এর উদ্বোধন করা হয়। গত ৩১ আগস্ট থেকে চলছে প্রদর্শনী। সিনেমা ও সিনেমা হলের যে দুর্দিন এখন চলছে সে জায়গা থেকে দেখলে একটি নতুন প্রেক্ষাগৃহ যোগ হওয়া কোন বড় ঘটনা নয়। তবে উপজেলা শহরে এমন আধুনিক নির্মাণ স্থানীয়দের বিশেষ কৌতূহলী করেছে। ঢাকা থেকে মাওয়ার দিকে বেড়াতে যাওয়া মানুষজনও কৌতূহলী হয়ে ঢুঁ মারছেন। উদ্যোগটি সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া গেলে এক ধরনের সাংস্কৃতিক জাগরণ সম্ভব হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে চ্যালেঞ্জটি অনেক বড়। নিজ থেকে গ্রহণ করা চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হতে সম্ভাব্য সব করছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। ঢাকার কাজ ফেলে ক’দিন পরপরই যাচ্ছেন সিরাজদিখান। কয়েকদিন আগে তার সঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়। গাড়িতে যেতে যেতে অনেক কথা। কী যে আগ্রহ নিয়ে স্বপ্নের কথা বলছিলেন তিনি! সিনেপ্লেক্সের চিন্তা মাথায় এলো কখন? বাস্তবায়নও করে ফেললেন। কেউ তো টের পেল না। এমন কথার জবাবে বেশ মজা করলেন। বললেন, ‘আমি তো একাত্তরের গেরিলা। সব গেরিলা কায়দায় করি। সিনেপ্লেক্সের বেলায়ও তাই হয়েছে। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঘোরের মধ্যে থাকতে থাকতেই বানিয়ে ফেলেছি। সবাই মার্কেট শপিংমল বানায়। আমি বোকা মানুষ সিনেপ্লেক্স বানিয়েছি।’ কথার এক পর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা দুঃখ করে বললেন, ‘এই দেশটা তো এমন ছিল না। সিনেমা নাটক সঙ্গীতসহ সব ধরনের শিল্প সংস্কৃতির চর্চা হতো। কত রকমের বিনোদন ছিল গ্রামের মানুষের জন্য! এখন সব উল্টো পথে চলতে শুরু করেছে। ধর্মান্ধতা গিলে খাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য। ভাল লাগে দেখে?’ কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলা। বেশ কিছু সময় চলার পর মূল রাস্তা থেকে বাঁয়ে মোড় নেয় গাড়ি। এবার সরু রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে সবুজ বৃক্ষ। শান্ত একটি নদীও বয়ে চলেছে। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকালেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। বললেন, ‘ইছামতী। কী সুন্দর না?’ রাস্তার সমান্তরালে বয়ে চলা নদীর যেখানে শেষ, সেখানে সিরাজদিখান বাজার। জেড এইচ সিকদার শপিং কমপ্লেক্সের সামনে গিয়ে গাড়ি থামল। ভবনের ওপরের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল ‘রংবাজ’ সিনেমার বিশাল ব্যানার। ব্যানারের দিকে তাকিয়েই রাস্তা পার হচ্ছিলেন পথচারীরা। নাসির উদ্দীন ইউসুফ সেদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, পিক্স সিনেপ্লেক্স। লিফটে ওপরে উঠতেই বিস্ময়! পরিপাটি ফ্লোরের ডান কোণে গড়ে তোলা হয়েছে সিনেপ্লেক্স। জায়গার পরিমাণ ৬ হাজার স্কয়ার ফিট। হলের সামনের অংশটা ভীষণ রঙিন। বিভিন্ন দেয়াল দেশ বিদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো। বক্সঅফিসের সামনে টিকেট সংগ্রহে ব্যস্ত দর্শক। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, দুটি হল। পাশাপাশি। প্রতিটিতে একশ করে আসনের ব্যবস্থা। একটিতে সিনেমা চলছিল। হাউসফুল। বিভিন্ন বয়সী দর্শক সিনেমা উপভোগ করছিলেন। মধ্য বিরতির সময় বের হয়ে এলেন তারা। হলের সামনে প্রশস্ত লবি। ফুড কর্নার। পপকর্ন পানীয় ইত্যাদি হাতে নিয়ে সিনেমার ভাল মন্দ আলোচনা করছিলেন দর্শক। পাশের হলটিতে কী যেন কাজ চলছিল। তাই ভেতরটা ভালভাবে দেখা গেল। অভ্যন্তরীণ সাজ সজ্জায় সুন্দর আর সুরুচির প্রকাশ। আসনগুলো দেখিয়ে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বললেন, আমি নিজে ভারত থেকে পছন্দ করে এনেছি। হল থেকে বের হয়ে আসার জন্য রয়েছে স্বতন্ত্র পথ। সেই পথ ধরে বের হওয়ার সময় দেখা একাধিক স্পিকার। সাউন্ডের কাজ করছিলেন এক ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার। বললেন, আমরা এখানে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করছি। ডলবি ডিজিটাল সাউন্ড দারুণ একটা অনুভূতি দেবে দর্শকদের। সিনেমা হলের পাশেই আছে একটি প্লে গ্রাউন্ড। বাচ্চারা সেখানে খেলছিল। তবে রেস্তরাঁটির কথা আলাদা করে বলতে হয়। সিনেপ্লেক্সের সঙ্গে মানানসই একটি রেস্তরাঁ। নাম ইছামতী। চমৎকার ইন্টেরিয়র। অভিজাত পরিবেশ। সুস্বাদু খাবার। খেতে খেতে কথা বাকি কথাগুলো হচ্ছিল নাসির উদ্দীন ইউসুফের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমার পকেটে কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সা নেই। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছি। আমার সঙ্গে আছে তরুণরাও। রাশেদ চৌধুরী সহায়তা করেছে। ইমরান হোসেন কিরমানি আছে আমার সঙ্গে। সেও বয়সে তরুণ। সকলের প্রচেষ্টায় সিনেপ্লেক্সটি গড়ে তোলা।’ এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পিছু পা হচ্ছি না আমরা। বরং উদ্যোগটি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কাজ করছি।’ বরিশাল, কুষ্টিয়া, নওগাঁ ও বগুড়ায় একই ধরনের সিনেপ্লেক্স নির্মাণের কথা চলছে বলে জানান তিনি। আর এভাবে কাজ করা গেলে সারা দেশে একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি। অজস্র সিনেমা হল ভাঙ্গার বিপরীতে এই নির্মাণের গল্প আমাদের আশাবাদী করে। স্বপ্ন দেখায়। প্রয়াসটি সার্থক হোক।
×