ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাগো নারী বহ্নিশিখা

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

জাগো নারী বহ্নিশিখা

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। আর শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত করা বিংশ শতাব্দীর সূচনাকাল থেকে অবিভক্ত বাংলা তথা সারা ভারতের এক অস্থিতিশীল কালপর্বের উত্তাল অধ্যায়ে। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নতুন পরিবর্তন আর স্বাধীনতা অর্জনের বিভিন্ন অপরিহার্য পর্যায়ের মধ্য দিয়ে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ স্বদেশী আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী আর সাংঘর্ষিক কার্যক্রমের উত্তাল সময় সর্বোপরি ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর এই সঙ্কটপূর্ণ আর্থ-সামাজিক বলয়ের কবি নজরুল শৈশব পার করে উদয়ীমান কিশোরের দীপ্ত চেতনায় শাণিত করার লড়াইয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন। পিতৃহীন নজরুল মাতৃসান্নিধ্য থেকেও অনেকটাই বিচ্ছিন্ন, ফলে পারিবারিক বন্ধনের শৈথিল্য তাকে ঘর থেকে বাইরে বের করে আনে। সেই থেকে জীবনের কঠিন পরিস্থিতিরি সঙ্গে কবির নিবিড়তম যোগ ব্রিটিশ শাসনের করাল নিষ্পেশনে তখন অবিভক্ত বাংলার জনপদ বিপর্যস্ত, হরেক রকমের বন্ধন জালে আবদ্ধ সর্বোপরি স্বাধীনতা নামক প্রত্যাশিত শব্দটি প্রায়ই স্বপ্নের মতো। এরই মধ্যে ১৯১৪ সালে শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। যার তপ্ত হাওয়া এসে লাগে পাক ভারত উপমহাদেশেও। যে আহ্বানে তাড়িত হয়ে বিদ্রোহী কবি ১৯১৭ সালে বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে করাচীতে চলে যান। ১৯১৮ সালে যুদ্ধে উন্মত পৃথিবী শান্ত হলেও কবির ফিরতে প্রায় ১৯২০ সাল পর্যন্ত সময় লাগে। এসেই লিখে ফেললেন ‘বিদ্রোহী’র মতো যুগান্তকারী কবিতা। যার মধ্যে ছাপ পড়ে সমকালীন সমাজের নানা অসঙ্গতি থেকে শুরু হওয়া বিশ্বব্যাপী সমরাস্ত্রের বহুমাত্রিক হিংসাত্মক তা-ব। সারা বাংলা থেকে শুরু করে অবিভক্ত ভারতে চষে বেড়ানো নজরুল কাছ থেকে দেখতে পান অসহায় সাধারণ মানুষের বঞ্চনা আর নিপীড়নের বিদগ্ধ যন্ত্রণা, আর এসবের সঙ্গে যুক্ত হয় নিজের অসাধারণ সৃজনী প্রতিভা। বিদ্রোহীর ছত্রে ছত্রে যে উদ্দীপ্ত অনুভব সারা দেশকে কাঁপিয়ে দেয়, উৎপীড়ন আর নির্যাতনের জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অদম্য নির্ভীকতায় নিজেকে যেভাবে নিবেদন করলেন তা আজও বিস্ময়ের সঙ্গে অভিভূত করে দেয়। সেই শুরু, সাধারণ মানুষকে নিয়ে সৃজনশীলতায় নিজেকে শুধু ডুবিয়ে রাখাই নয় সৃষ্টির অদম্য উন্মাদনায় বাংলা সাহিত্যের ভা-ারও পরিপূর্ণ করা, আর এরই সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে আছে নারী সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, নারীকে দেখার সূক্ষ্ম আর তীক্ষè বোধ। সেই তাড়নায় পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেন, সমস্ত বন্ধনজাল ছিন্ন করে কিভাবে নারীরা চলার পথ খুঁজে পাবে সর্বোপরি যথার্থভাবে মানুষ হিসেবে নিজেদের অবস্থান কতখানি শক্ত করতে পারবে। সে মাত্রায় ধর্মীয় রক্ষণশীলতা এবং অবরোধ প্রথা নারীর সহজ, স্বাভাবিক পথচলাকে বিড়ম্বিত করে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে নিজেদের আসন মজবুত করা কঠিন হয়ে পড়বে। কবি মনে করতেন বাধা শুধু সমাজ কিংবা পুরুষ নয় নারীরা নিজেরাই নিজেদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। তার মতে এ দেশের নারীরা সত্যিই অসহায় এবং দুর্ভাগা। সমাজের সমস্ত অত্যাচার আর অবিচার সহ্য করে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কাটিয়ে দেয়। কি ভাবে নিজেদের মঙ্গল আর সামনে চলার পথ নির্বিঘ্ন হবে সেটাও বুঝতে তাদের অনেক দিন পার করে দিতে হয়। অবরোধ প্রথাকে নারী প্রগতির সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক বলে তিনি মনে করতেন। কারণ এতে শিক্ষার দ্বারও বন্ধ হয়ে যায়। আর শিক্ষার আলো যদি নারীরা নিজেদের মধ্যে ছড়াতে না পারে তাহলে বন্ধ দুয়ার কখনই খোলা সম্ভব হবে না। একটি প্রবন্ধে তিনি বলেন সমস্ত নারী আজ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কিন্তু যুদ্ধ করার যে প্রধান অস্ত্র শিক্ষা আর জ্ঞান তাই তাদের নেই আছে কেবল একটা দারুণ আত্মগ্লানি, মর্মভেদী অনুশোচনা সর্বোপরি মুক্তির জন্য দুর্দমনীয় আকাক্সক্ষা।’ নজরুল শুধুমাত্র নারীর অধিকার আদায়ের জন্য শক্ত লেখনীর দাগই কাটেননি তাদের সম্মানে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে বাস্তব কিছু কর্মসূচীও হাতে নিয়েছিলেন। প্রতিভাদীপ্ত নারীরা যাতে নিজেদের সৃজন ক্ষমতা প্রকাশ করতে পারে তার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। তার প্রকাশিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার একটি বিশেষ অংশজুড়ে ছিল নারীদের জন্য ‘সন্ধ্যা প্রদীপ’ নামে একটি বিভাগ। তৎকালীন নারীরা তাদের মনের আবেগ কিংবা গৃহবন্দী অবস্থা থেকে বাইরে বেরুনোর সমস্ত উপায় অবলম্বন ও নির্বিঘেœ নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে এই ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’ বিভাগে ব্যক্ত করতে পারত। তার ইতি এবং নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এ পত্রিকায় ছাপা হতো। বিস্ময়ের হলেও সত্য অনেক সময় নারীরা নিজেরাই তাদের অধিকার আর স্বাধীনতা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করতে দ্বিধা করত না। এসবের বিরুদ্ধে কঠিন এবং কঠোর প্রতিবাদ করতেন মিসেস, এম রহমান যাঁকে নজরুল নাগমাতা এবং সত্যিকারের মাতৃত্বের আসনে বসিয়েছিলেন। যার অকাল মৃত্যু কবিকে দারুণভাবে উদ্বিগ্ন এবং ব্যথিত করেছিল। এই ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’ বিভাগে মিসেস এম রহমানের পাঁচটি জ্বালাময়ী, বিদ্রোহী এবং বিপ্লবাত্মক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। যার প্রতিটি লাইন নারীর অধিকার আর স্বাধীনতার পক্ষে গিয়েছিল। শুধু তাই নয় সেই সময় নারী জাগরণের সাহসী অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার বলিষ্ঠ আর উদ্দীপ্ত লেখনী নজরুলকে বিস্মিত আর মুগ্ধ করেছিল। বেগম রোকেয়ার নির্ভীক মনোবল আর আধুনিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ নজরুল এই অজেয় নারী ব্যক্তিত্বকে দৃষ্টান্ত হিসেবে ভাবতে পছন্দ করতেন। প্রাচীন সমাজ আর ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে নারীদের সামনে চলার পথে রোকেয়ার অমৃত বাণী সমাজের সবচেয়ে বড় সম্পদ বলে কবি মনে করতেন। এভাবে দেশের সমস্ত নারীকে পাহাড় সমান সমস্ত বাধাবিপত্তিকে ডিঙ্গিয়ে নিজেদের কণ্টকাকীর্ণ পথকে নিষ্কণ্টক আর অবারিত করতে হবে তাদের স্বার্থে। এর ব্যত্যয় হলে নারীদের সামনে এগুনোর কোন সম্ভাবনাই থাকতে পারে না। নজরুল জীবনভর চেয়েছেন নারীরা শুধু জ্ঞানের দীপ্ত আলোকে আলোকিতই হবে না তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশেও সমানভাবে উদ্যোগী হতে হবে। সেই বোধে নজরুল তার সাহিত্যের বিচিত্র আঙ্গিনায় যেভাবে নারী শক্তির বন্দনা গেয়েছেন একইভাবে নারীর দীপ্ত সৌন্দর্যকে মহিমান্বিত করে অক্ষয় ঐশ্বর্যেরও জয়গান করেছেন। নারী ছিল তার কাছে চিরায়ত দীপ্তি, অনিন্দ্যসুন্দর প্রতিমা আর সুষমালক্ষ্মীর অম্লান দ্যুতি। সাধারণ মানুষের জীবন প্রবাহে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে নিমগ্ন কবি নজরুল অসহায় আর পিছিয়ে পড়া নারীদের ব্যাপারেও ছিলেন উদ্বিগ্ন আর সচেতন। সেই মাত্রায় সৃজন আর মনন কর্মেও নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছেন। প্রতিদিনের কর্মযোগে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণ যেমন সমাজ-সভ্যতার অনিবার্য দাবি একইভাবে তাদের গড়ে ওঠারও এক অপরিহার্য প্রত্যয়। সেই বোধ আর বিশ্বাসে সব সময়ই তাদের প্রাণিত করেছেন, সাহস দিয়েছেন সর্বোপরি কর্মে আর সৃজনে তাদের অংশীদারিত্বের দাবিও ছিল। দীপ্ত পায়ে, প্রতিভারস্ফুরণে সর্বোপরি দেশের সচেতন আর দায়বদ্ধ নাগরিক হিসেবে অগ্রসরমান আর আধুনিক বঙ্গললনারা তার কাছে ছিল নারী শক্তির এক অনির্বাণ কিরণ। যেমন বেগম, মিসেস এম রহমান একইভাবে বেগম সুফিয়া কামালও ছিল তার কাছে স্নেহাস্পদ পরম প্রীতিভাজন। বেগম সুফিয়া কামালের প্রতি কাজী নজরুলের নজর ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম আর অনুভূতিপ্রবণ। সুফিয়া কামালের প্রথম স্বামী ছিলেন নজরুলের অত্যন্ত কাছের মানুষ এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগী, সেইভাবে সুফিয়া কামালকে জানা এবং চেতনার সুযোগ। প্রথম যেদিন সুফিয়া কামালের কাব্য প্রতিভার অভিনব বোধ তার সামনে প্রকাশ সেদিন তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এক স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন যে ‘সাঁজের মায়া’ কবিতাটি যখন তিনি দেখলেন বিশ্বাসই করতে পারলেন না একজন মুসলিম অবরোধবাসিনী বালিকা কিভাবে এমন চমৎকার পদ্যে নিজের অনুভূতি ঝঙ্কৃত করতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে এই কবিতা প্রকাশেরও আন্তরিক সদিচ্ছার কথা জানালেন, তার বুঝতে কষ্ট হয়নি এই কাব্যবোধ সুফিয়া কামালের একান্ত নিজের, একেবারে ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা জেগে ওঠার এক বলিষ্ঠ আর্তি। তার সেই বিশ্বাস সময়ই প্রমাণ করে দেয়। সুফিয়া কামাল একজন শুধু কবিই ছিলেন না আন্দোলনে, সংগ্রামে, অধিকার আদায়ের এক লড়াকু সৈনিকও ছিলেন। কবি মনে করতেন সামাজিক অভিশাপের সমস্ত জঞ্জাল যেমন নিঃশেষে নির্মূল করতে হবে একইভাবে নিজেদের বেঁচে থাকা থেকে শুরু করে তৈরি হওয়া, সসম্মানে টিকে থাকার তাগিদও প্রতিটি নারীর মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। নিজেদের গড়ে তোলার তাড়িত অনুভবই নারীকে ভেতর থেকে জাগিয়ে তুলবে, অন্তরস্থিত আলোকরশ্মিই তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথকে মুক্ত আর নিরন্তর করবে। এই চৈতন্যে তিনি নারীকে বারে বারে জেগে ওঠার প্রত্যয়ে শাণিত করার আহ্বান জানিয়েছেন-সামনে চলার পথকে মুক্ত আর নিষ্কণ্টক করার পরামর্শ দিয়েছেন।
×