ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দোতারার জাদুকর গীতিকার ও সুরকার কানাই লাল শীল স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

দোতারার জাদুকর গীতিকার ও সুরকার কানাই লাল শীল স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাজু আহমেদ ॥ ‘তোমার ও লাগিয়ারে’, ‘বহুদিনের পিরিত গো বন্ধু, ‘শোন গো রূপসী কন্যা গো’, ‘মাঝি বাইয়া যাও রে’ ‘আমায় এতো রাতে কেন ডাক দিলি’, ‘প্রাণ সখিরে ওই শোন কদম্ব তলায় বংশি বাজায় কে’, ‘অসময় বাঁশি বাজায় কে রে’সহ অসংখ্য কালজয়ী গানের গীতিকার ও সুরকার, উপমহাদেশের প্রখ্যাত দোতারা বাদক কানাই লাল শীলের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গত ৫ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৬ সালের ওইদিন তিনি পরলোক গমন করেন। বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গন সমৃদ্ধকারী অসংখ্য গানের গীতিকার ও সুরকার কানাই লাল শীলের প্রয়াণদিবস অনেকটা নীরবে নিভৃতে চলে গেল। পরিবারের সদস্যরা ছাড়া তেমনভাবে তাকে কেউ স্মরণ করেনি। এত বড় একজন সঙ্গীত প্রতিভার সমৃদ্ধ জীবনকে ভুলতে বসেছে অনেকেই। তার মৃত্যুর ৪১ বছর পেরিয়ে গেলেও তার রচিত এবং সুরারোপিত গান এখনও মানুষের মুখে মুখে। অথচ তাকে নিয়ে কোন স্মরণসভাও পর্যন্ত করা হয় না। এ নিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যথেষ্ট আক্ষেপ রয়েছে। ফরিদপুরে তার নিজ বাড়িতে, নাতি বাদল শীলের আয়োজনে কাঙালি ভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং রাজধানীর মধুবাগে মেজো ছেলে আশুতোষ শীলের বাসায় কাঙালি ভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়া আর কোন আয়োজন হয়নি। কেন? কানাই লাল শীলকে কি এত সহজে ভোলা উচিত?। নাকি ভোলা যায়। এমনটাই মনে করেন সঙ্গীত সংশ্লিষ্ট মানুষরা। বাংলাদেশের কৃতী সন্তান কানাই লাল শীলের জন্ম ১৩০৫ বঙ্গাব্দে, ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার শাকরাইল ইউনিয়নের লস্করপুর (কৈড়াইল) গ্রামে। তার পিতার নাম আনন্দ চন্দ্র শীল, মাতা সৌদা মিনি শীল, স্ত্রী কিশোরী বালা শীল। বর্ণাঢ্য সঙ্গীত ক্যারিয়ারের এই গুণী মানুষটির সঙ্গীত প্রতিভা আজও অনন্য। এক সময়ে দোতারাধারী কালো কিশোর কানাই লাল শীলকে নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়েছিল। পিতা আনন্দ চন্দ্র শীল ছিলেন নৃত্যগীতে উৎসাহী এক বিশালদেহী পুরুষ ছিলে। সঙ্গীতের ধারা পিতার ধমনি থেকেই কানাই লালের দেহে সঞ্চারিত হয়। কিন্তু মাত্র আড়াই বছর বয়সে কানাই লাল পিতৃহারা হন। পিতৃহারা দুরন্ত বালক কানাই লালকে লালন পালন করেন তার পিসিমা। মাত্র আট বছর বয়সে নগরকান্দা এলাকার খ্যাতনামা বেহালা বাদক শ্রী বসন্ত কুমার শীলের কাছে তার প্রথম বেহালায় হাতে খড়ি। বসন্ত শীল কানাইয়ের বেহালায় হস্ত চালনা দেখে সহজেই বুঝে নেন, এই হাত বহু হৃদয়কে স্পর্শ করবে এবং লোক সঙ্গীতের অতল সমুদ্র থেকে মুক্তা আহরণ করার শক্তি এর মাঝে রয়েছে। কানাই তিন বছর গুরু বসন্ত শীল ছাত্রকে উজাড় করে ঢেলে দেন প্রাথমিক শিক্ষা। যদিও বেহালার পূর্ণপাঠ সময় এবং ব্যক্তিগত ব্যস্ততার জন্য তিনি তার পুত্র সম ছাত্রকে দিতে পারেননি। তবুও সঙ্গীতের প্রতি কানাইয়ের মানসিক ভিত্তিভূমিকে তিনি কর্ষন করে যে কোন বীজ বপনের উপযোগী করে দেন। মাত্র এগার বছর বয়সে কানাই লাল বসন্ত শীলের গুরু মতি লাল ধূপির কাছে বেহালায় তালিম নেন। কানাইয়ের মন ছিল অত্যন্ত বৈচিত্র্যপ্রয়াসী সত্যিকারের লোক শিল্পী। তিনি যাত্রাদল ছাড়াও গাজীর গান, কবি গান ও কীর্তনীয়া দলে যোগ দিয়ে সারা ভাটি অঞ্চল সফর করতেন। তার পেশাগত দক্ষতায় দলকর্তারা সকলেই তাকে আপন করে নিয়েছিলেন। যদিও কানাই লাল ছিলেন প্রকৃতিগতভাবে যাযাবর ছিলেন। বাংলার লোক সঙ্গীতের উদার উপত্যকায় এক সত্যিকার জিপসি রাজা ছিলেন। এই বিচরণ ও উদার ভ্রমণ কানাই লালের জীবনকে অনেক অপরিহার্য অভিজ্ঞতার পূর্ণ করে দেয়। তার সজাতিকে অত্যন্ত অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেন। কানাই লালের জীবনে আধ্যত্মিক আলোর ঝলক লাগে বিক্রমপুরের কাছে বাইমাহাটি ফকির বাড়িতে, দরবেশ দাগু শাহের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে। সেখান থেকে ফরিদপুরে গিয়ে তিনি দোতারা বাদক; তারা চাঁন সরকারের কাছে তামিল নেন। এমন এক ছাত্র কানাই লালকে পেয়ে তৎকালীন শ্রেষ্ঠ দোতারা বাদক কানাই লালকে তামিল দিতে রাজি হোন। এখানকার শিক্ষা শেষ হলে কানাই লাল দোতারা শিল্পী হয়ে এক কৃষ্ণ লীলা দলে যোগ দেন। এক সময় ফরিদপুরে রাধীকা মোহন সাহার বাড়িতে কবি জসীম উদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। কানাই লালের দোতারা বাদন শুনে কবি জসিমউদ্দিন মুগ্ধ হয়ে তাকে কলকাতায় নিয়ে যান। কলকাতায় আব্বাস উদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হয় কানাই লালের। এ সময় তার একটি অনন্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। তিনি আব্বাস উদ্দিনের অনুপ্রেরণায় অনেকগুলো পল্লীগীতি রচনা ও সংগ্রহ করেন। আব্বাস উদ্দিন তাকে নানাভাবে কলকাতায় হিন্দু সমাজ ও গ্রামোফোন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে পরিচয় করে দেন। একই সময়ে মেগা ফোন কোম্পানিতে কমলার ঝরিয়ার সঙ্গে দোতারা বাজানোর সময় কোম্পানিতে উপস্থিত ওস্তাদ এনায়েত খাঁ শুনে কানাই লালের তার দোতারা বাদন শুনে তার ছাত্র করে নেয়ার প্রস্তাব দেন। ফলে বেশকিছু কালের জন্য তার দোতারায় শাস্ত্রীয় রীতিতে তামিল নেয়ার সুযোগ হয়। এদিকে হিজ মাস্টার্স ভয়েজ গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ করার সময় কাজী নজরুল ইসলাম তার বাদনে খুশি হয়ে নিজ গানে তার দোতারার সহযোগিতা করার জন্য প্রায় পাঁচ বছরের জন্য কানাই লালকে তার কাছে নিয়ে যান। তখন থেকেই তিনি অল-ইন্ডিয়া রেডিওর কোলকাতা কেন্দ্রের নিয়মিত দোতারা শিল্পী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। দেশব্যাপী খ্যাতির মালা পরে মাত্র ২৩ বছর বয়সে কানাই লাল ফরিদপুর জেলার মুন্সিরচর গ্রামের জলধর শীলের দ্বিতীয় কন্যা কিশোরী বালা শীলকে বিয়ে করেন। তার তিন পুত্র ও চার কন্যা, পুত্রদের মধ্যে কুমুদকান্ত, আশুতোষ ও অবিনাশ তিনজনই দোতারা শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। তার দোতারার ছাত্রদের মধ্যে চৈত্যন বিশ্বাস, চাঁন মিয়া, দুলাল চন্দ্র শীল, বিজয় কুমার দাসও স্বনামে খ্যাত। কানাই লাল শীল রচিত ও সুরারেপিত গান যারা রেকর্ড করেছেন তাদের মধ্যে আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, শচীন দেব বর্মন, আবদুল হালিম চৌধুরী, কুমুদিনী সাহা, অনন্ত বালা বৈষ্ণবী, সরদার আলাউদ্দীন, ফেরদৌসী রহমান, আবদুল আলিম, বেদারউদ্দিন আহমদ, ফরিদা ইয়াসমিন, মোস্তফা জামান আব্বাসী ও নীনা হামিদ এবং এম এ খালেক ও কানন বালা সরকার অন্যতম। কানাই লাল শীল দুই শতাধিক গান রচনার পাশাপাশি সুর দিয়েছেন। তার রচিত ও সুরারোপিত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তোমার ও লাগিয়ারে, সদাই প্রাণ আমার কান্দে বন্ধুরে’, ‘আমি বন্ধুর প্রেম আগুনে পোড়া’, ‘বহুদিনের পিরিত গো বন্ধু’, ‘কেগো নিরলে বসিয়া’, ‘শোন গো রূপসী কন্যা গো, কার লাগিয়া গাঁথ ফুলের মালা’, ‘আমার গলার হার, খুলে নে ওগো ললিতে’, ‘মাঝি বাইয়া যাও রে’, ‘আমায় এতো রাতে কেন ডাক দিলি’, ‘সে যেনো কি করলো রে আমায়’, ‘ওই না রূপে নয়ন দিয়ে আমার’, ‘কোন বা রঙ্গে বাইন্দাছো ঘরখানা’, ‘এ বেশ তোমার কে সাজাইছে’, ‘বন্ধুর প্রেমে শৈল পসিলো গো’, ‘সরল প্রাণে দাগা দিয়া কোথায় গেল লুকাইয়া’, ‘আমার নিঠুর বন্ধু লাইগা রে’, ‘কেন জানি আজ বন্ধু’, ‘প্রাণ সখিরে ওই শোন কদম্ব তলায় বংশী বাজায় কে’ (শিল্পী নীনা হামিদ), ‘ওরে তুই আমারে করলি পাগল’, ‘ও ঢেউ খেলেরে, ঝিলমিল সাইওরে ও ঢেউ খেলে, ‘অসময় বাঁশি বাজায় কেরে’ প্রভৃতি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে কানাই লাল শীল তার অমর সব সৃস্টির মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন। ৪১তম প্রয়াণবার্ষিকী উপলক্ষে তার বিদেহী আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলী।
×