ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ২৮ আগস্ট ২০১৭

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা

আসল ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে জট ও জটিলতা কাটছে না কিছুতেই। শনিবারের জনকণ্ঠের প্রথম পাতায় নড়াইলের এক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার খবর ছাপা হয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি পাকিস্তান সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সরকারী চাকরি করেছেন। স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে। সে সময়ে বেতন বৃদ্ধি তথা ইনক্রিমেন্ট হয়েছে তার। গ্রামের বাড়িতে রাজাকারদের সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করেছেন বলেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের পক্ষ থেকে। সেই ব্যক্তিই ১৯৯৩ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাগিয়ে নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সনদ। এতদিন বেশ ভালই চলছিল। সম্প্রতি সরকার বিভিন্ন সময়ে প্রায় ঢালাওভাবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কিত একাধিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে তালিকা প্রণয়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যক্তি সম্পর্কে কাগজপত্রসহ অভিযোগ জমা পড়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে। আরও যা উদ্বেগজনক তা হলো, এ রকম অভিযোগ আসছে ও এসেছে অন্য স্থান থেকেও। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর ভাষ্যে জানা যায় যে, নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি প্রেরিত তালিকায় একাধিক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকায় তা স্থগিত করা হয়েছে। এ সবই নাকি ম্যানেজ করা হয়েছে বিপুল অর্থের বিনিময়ে। দুঃখজনক হলো, এ রকম একাধিক অভিযোগ এসেছে জনকণ্ঠের হাতে, যা চিঠিপত্রের পাতায় ছাপা হয়েছে একাধিকবার। অনেক স্থানেই নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য স্থানীয়ভাবে যে যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয়েছে, তাতে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে অনেকেই সনদ তথা সুপারিশ সংগ্রহ করেছেন বিপুল অর্থের বিনিময়ে। আবার অর্থ দিতে না পারায় অনেক আসল মুক্তিযোদ্ধার নামও বাদ পড়েছে বলে অভিযোগ আছে। সম্ভবত এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা কখনই চিহ্নিত হতো না, যদি না সরকারী চাকরিতে পদ ও পদোন্নতিতে নিয়মিত কাগজপত্র পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ত! বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোসহ ভাতা ও অন্য নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। আর এর সুবাদেই কাগজপত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে ধরা পড়ছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। যাদের অনেকে এমনকি সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। কেউ কেউ চাকরিরত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পর্যন্ত। অথচ অমল ধবল স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল ৪৬ বছরে পদার্পণ করার পরে এমনটি হওয়ার কথা নয়। প্রকৃতপক্ষে এই তালিকাটি করা অত্যাবশ্যক ছিল স্বাধীনতার পরপরই। তবে তখন সম্ভবত সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার এই জরুরী কাজটি সম্পন্ন করতে পারেনি। এরপরই ঘটে ’৭৫ পরবর্তী মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক ঘটনা। সপরিবারে জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ক্ষমতায় জেঁকে বসে খুনী মোশতাক ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র, যাদের অনেকের আনুগত্য বাংলাদেশের পরিবর্তে ছিল পাকিস্তানের প্রতি। বলা যায়, সে সব সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ ও আনুকূল্যেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার আধিক্য ও দৌরাত্ম্য বেড়ে যায় বহুগুণ। আসল ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা একে একে হারিয়ে যেতে থাকেন স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্তরালে। সুমহান মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং বাঙালী জাতির চিরদিনের, চিরকালের গর্ব ও অহঙ্কার। এর চিরায়ত সম্মান ও মর্যাদা ধূলিসাত হতে যেতে দেয়া যায় না কোন অবস্থাতেই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যে বা যারা জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে, তারা আদৌ কোন স্বার্থ বা প্রাপ্তির জন্য যাননি। তবে পরবর্তীকালে সরকারী আনুকূল্য ও দয়া-দাক্ষিণ্য কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে কলুষিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। ইত্যবসরে গজিয়ে উঠেছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। যা হোক, বিলম্ব হলেও ভুয়াদের দৌরাত্ম্য ও কবল থেকে আসল মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করার সময় এসেছে। তবে এতদিন পরে এসে আসল ও নকল চিহ্নিত করা যথার্থ অর্থে একটি কঠিন কাজ বৈকি।
×