ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একটি ব্যাংক খারাপ হলে পুরো অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২৭ আগস্ট ২০১৭

একটি ব্যাংক খারাপ হলে পুরো অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, একটি ব্যাংকে যেন লালবাতি না জ্বলে এজন্য সরকার মূলধনের যোগান দেয়। একটি ব্যাংক খারাপ হলে পুরো অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। তবে যথাসময়ে দেউলিয়া আইন ও মার্জার আইন করা হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠায় ১০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হলে গ্রাহককে দেয়া হয় মাত্র ২০ কোটি টাকা। ব্যাংকের সব কর্মকর্তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হতে হবে। কোন কেরানি ব্যাংকে দরকার নেই। শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের অবস্থা পর্যালোচনা: চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপায়’ শীর্ষক কর্মশালায় প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ কর্মশালার আয়োজন করে। এতে অন্যদের মধ্যে অর্থমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আব্দুর রাজ্জাক, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির, অর্থবিভাগের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও এসএম মনিরুজ্জামান, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৮ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি প্রমুখ বক্তৃতা করেন। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক ও চলমান কর্মকা- নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব ইউনুসুর রহমান। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সমগ্র ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণ মাত্র ১০ থেকে ১১ শতাংশ। সেখানে সরকারী ব্যাংকের ২৭ শতাংশ। এতে আমার লজ্জা লাগে। খেলাপী ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। অবলোপনের মাধ্যমে যেসব খেলাপী ঋণ ব্যালান্সশিট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে তা আদায়ের দায়িত্ব ব্যাংকের। খেলাপী ঋণের সংস্কৃতি বহুদিনের। শুরুতে খেলাপী ঋণের জন্য ব্যাংকারদের দোষ ছিল না। ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারণ জটিলতায় ১৯৭২ সালের পর কিছু খেলাপী ঋণ তৈরি হয়। তিনি বলেন, এখন খেলাপী ঋণ বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকাররাই দায়ী। ঋণ দেয়ার পরই ব্যাংকাররা চান গ্রাহক খেলাপী হয়ে যাক। এতে গ্রাহককে কব্জায় আনা যাবে। শিল্পপতিদের মেয়াদী ঋণ দেয়া হয়। কিন্তু চলতি মূলধনের ক্ষেত্রে জামানত নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করা হয়। শিল্পপ্রতিষ্ঠায় ১০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হলে গ্রাহককে দেয়া হয় মাত্র ২০ কোটি টাকা। এটি করার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, মূলধন পর্যাপ্ততা ব্যাংকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একটি ব্যাংকে যেন লালবাতি না জ্বলে এজন্য সরকার মূলধনের যোগান দেয়। একটি ব্যাংক খারাপ হলে পুরো অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, ব্যাংকের সব কর্মকর্তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হতে হবে। কোন কেরানি ব্যাংকে দরকার নেই। কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, কেওয়াইসি ব্যাংকের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বড় বড় গ্রাহকের সঙ্গে সরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কম। ঋণ প্রস্তাব আরও উন্নত হতে হবে। এটি কিভাবে করা যায় সেই সুপারিশ দেন। তিনি বলেন, ১৫ বছর ধরে একটি কথা বলে আসছি মার্জার হবে। কিন্তু এজন্য আইন দরকার। দেউলিয়া আইন ও মার্জার আইন করা হবে। আমেরিকার ৪ হাজার ব্যাংক ছিল। এখন মার্জার হয়ে অনেক কমে গেছে। আমাদের দেশেও যথাসময়ে মার্জার হবে। আমরা প্রস্তুত আছি। অর্থমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বেসিক ব্যাংকে ভয়াবহ জালিয়াতি হয়েছে। একজন চেয়ারম্যান বোর্ড মেমো ছাড়াই ঋণ দিয়েছেন। এ্যাকাউন্ট খোলার দুদিনের মাথায় তার নামে ঋণ পাস করিয়ে টাকা দিয়েছেন। অন্য ব্যাংকের দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে তার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আমরা কোন ব্যবস্থা নিতে পারিনি। প্রমাণসহ সব কাগজ দুদকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু দুদক কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি স্থায়ী কমিটির কোন মিটিংয়ে দুদকের কর্মকর্তাদের ডাকলেও তারা আসেননি। বেসিক ব্যাংকে প্রকাশ্য দিবালোকে ডাকাতি হয়েছে। এখনও মাত্র ৭১ জন গ্রাহকের কাছে ২৯ হাজার কোটি টাকা আটকা রয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোক ভাল করতে হলে এ্যাকশন প্লান করতে হবে। সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক ইচ্ছা সবচেয়ে বড় কথা। অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে দুর্নীতির তুলনায় অপচয় বেশি হয়েছে। ব্যক্তিগত অপচয়, প্রাতিষ্ঠানিক অপচয় ও ঐতিহ্যগত অপচয় হয়েছে। এটি বন্ধ করতে হবে। ব্যাংকগুলো পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে কোন সময়সীমা ছাড়া। এটি হতে পারে না। অবশ্যই সময় থাকতে হবে। মূল প্রবন্ধে ইউনুসুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং খাতের মোট ৯ হাজার ৭২০টি শাখার মধ্যে ৫ হাজার ১২০টি শাখা বা ৫৩ শতাংশই সরকারী ব্যাংকগুলোর। ব্যাংকের খাতের মোট আমানতের ৩১ ভাগ এবং ঋণের ২২ ভাগ সরকারী ব্যাংকগুলোর। আইন অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে ১০ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক হলেও সরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর রয়েছে ৭ শতাংশ। এর বিশেষায়িত ব্যাংকের মূলধন ঋণাত্মক ৩৩ শতাংশ। গত চার বছরে মূলধনের যোগান দিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৯ হাজার ৬৪০ কোটি ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে খেলাপী ঋণ ১০ শতাংশ হলেও সরকারী ব্যাংকে তা ২৭ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে মামলার নিষ্পত্তি অনেক সময় লেগে যায়। ১৯৮০ সালে মামলা করেও সেই টাকা আদায় করা যায়নি। একটি কোম্পানির ৮-১০ পরিচালক থাকলে তারা সবাই একের পর এক রিট করেন। এতে টাকা আটকে যায়। গকুল চাঁদ দাস বলেন, ২০০৭ সালে ১৫ নবেম্বর সরকারী ব্যাংকগুলোকে কর্পোরেট করার পর থেকেই অধপতন শুরু। পরিচালনা পর্ষদ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই অধপতনের দিকে যাচ্ছে। সরকারী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অর্থমন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিকভাবে কাজ করেনি। হলমার্ক ঘটনা জানার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চুপ ছিল। পর্ষদের মেয়াদ শেষ হবার মাত্র ৮ দিন আগে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ ভাঙ্গার সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পর্ষদ ভাঙ্গা ক্ষমতা অগণতান্ত্রিক। এটি বাতিল করতে হবে। তিনি বলেন, খেলাপী ঋণ কমাতে ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। এজন্য এমডিসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের টার্গেট ঠিক করে দিতে হবে। ব্যর্থ হলে বেতন কাটতে হবে। খেলাপী থেকে যে পরিমাণ আদায় হবে ঠিক সেই পরিমাণ ঋণ দিতে হবে। এতগুলো ব্যাংকের দরকার নেই। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে অতি দ্রুত একীভূত করতে হবে। এরপর বিডিবিএল, বেসিক ও রূপালী ব্যাংক মিলে একটি এবং অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক মিলে আরেকটি ব্যাংক করতে হবে। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ বলেন, ব্যাংকের দুর্নীতির জন্য ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ঘটনায় পর্ষদ ও শীর্ষ ম্যানেজমেন্ট দায়ী। সরকারের উচিত দেখেশুনে নিয়োগ দেয়া। প্রয়োজনে বছরের পর বছর না রেখে খারাপ হলে ২ থেকে ৬ মাসের মধ্যে বাদ দিতে হবে। ঋণ বিতরণ ও আদায়ের ক্ষেত্রে দুদকের কর্মকা- বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের ব্যাংকের স্বার্থ দেখে কাজ করতে হবে। ৩ জন গ্রাহককে আটক করলে ১৫ জন পালিয়ে যায়। এতে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিআইবিএমের মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, সরকার চাইলে ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াবে। সবার আগে জানতে হবে সরকার চায় কিনা? ভারত সরকার চেয়েছে সেদেশের ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এজন্য সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা লাগবে।
×