ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী-সন্ত্রাসী গ্রেফতারে ঈদের সময় বিশেষ অভিযান

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৫ আগস্ট ২০১৭

জঙ্গী-সন্ত্রাসী গ্রেফতারে ঈদের সময় বিশেষ অভিযান

গাফফার খান চৌধুরী ॥ জঙ্গী গ্রেফতারে ঈদের সময়কে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পলাতক জঙ্গীর অনেকেই ঈদের সময় নাড়ির টানে সীমান্তপথে দেশে প্রবেশের চেষ্টা করে। আবার দেশেই পলাতক থাকা জঙ্গীরা ঈদের সময় সীমান্তপথে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকে। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে জঙ্গীদের গ্রেফতার করতে বাংলাদেশ ও ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে পলাতক জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের ছবিসহ তালিকা বিনিময় হয়েছে। জঙ্গীদের অনুপ্রবেশ ও পলায়ন ঠেকিয়ে তাদের গ্রেফতার করতে স্থল সীমান্তে বাংলাদেশ ও ভারত হাই রেড এলার্ট জারি করেছে। দুই দেশের সীমান্তবর্তী স্থানগুলোতে মাঝে মধ্যেই সাঁড়াশি অভিযান চলছে। গোয়েন্দা সূত্রে এমন তথ্য মিলেছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দুই দেশের মধ্যে বিনিময় হওয়া জঙ্গী-সন্ত্রাসীর তালিকা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এজন্য তালিকাভুক্ত জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানতে এবার পাসপোর্ট অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছে। কারণ অনেক সন্ত্রাসী ও জঙ্গী নাম-ঠিকানা পরিবর্তন করে ভুয়া নামে পাসপোর্ট তৈরি করে। পরবর্তীতে তারা এসব পাসপোর্টের মাধ্যমে বৈধপথে দেশ ত্যাগ করে। এসব ক্ষেত্রে তাদের শনাক্ত করা বা গ্রেফতার করা কঠিন হয়ে পড়ে। ইতোপূর্বে অনেক অপরাধী এমন ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তথ্য মিলেছে। এরমধ্যে হোটেলের কর্মচারী হত্যার আলোচিত ঘটনায় অভিযুক্ত মতিঝিলের ঘরোয়া হোটেলের মালিক নাম-ঠিকানা পরিবর্তন করে ভারতে পালিয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভারতের কাছে যে তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে, তাতে প্রকৃত নাম-ঠিকানা যাচাই-বাছাই চলছে। তালিকাভুক্তদের কারও বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়ামাত্র তা ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীলদের জানানো হচ্ছে। ভারতও একইভাবে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা তালিকাভুক্ত জঙ্গী বা সন্ত্রাসী সম্পর্কে পাওয়া বাড়তি তথ্য আদান-প্রদান করছে। পুলিশ সদর দফতরের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, ভারতে পলাতক থাকা বাংলাদেশী জঙ্গী ও সন্ত্রাসীরা বেনামে দেশটিতে আত্মগোপন করে আছে। অনেকের কাছেই বৈধ পাসপোর্ট রয়েছে। সেই পাসপোর্ট মোতাবেক পলাতকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন ইউনিটের কাছেই কোন অভিযোগ নেই। অথচ প্রকৃতপক্ষে এসব পলাতকের শতভাগই বাংলাদেশের মোস্টওয়ান্টেড আসামি। দীর্ঘদিন ধরেই জঙ্গীরা বাংলাদেশ ও ভারতে ছদ্মনামে আত্মগোপন করে রয়েছে বলে জানা গেছে। সর্বশেষ বহুল আলোচিত গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গী হামলার অন্যতম পরিকল্পনা এবং অস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহকারী সোহেল মাহফুজ গ্রেফতার হওয়ার পর সে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার পর দীর্ঘ ১৫ বছর পর হাতকাটা মাহফুজকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশের পুলিশ। অথচ মাহফুজ ২০০৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮ বছর ভারতে আত্মগোপনে ছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে জেএমবির আস্তানায় বিস্ফোরণের ঘটনা না ঘটলে হয়ত কোনদিনই মাহফুজের নাম প্রকাশ পেত না। তাকে গ্রেফতার করাও সম্ভব হতো না। খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পর ভারতীয় গোয়েন্দাদের গভীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশী জঙ্গী নসরুল্লাহর নাম। পরবর্তীতে নসরুল্লাহ সম্পর্কে বাংলাদেশী গোয়েন্দারা ব্যাপক অনুসন্ধান করে জানতে পারে, নসরুল্লাহ হচ্ছে বাংলাদেশের হাতকাটা মাহফুজ। ডান হাত না থাকার কারণে তাকে শনাক্ত করতে সহজ হয় বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দাদের। ভারতের মোস্টওয়ান্টেড আসামি নসরুল্লাহকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে সেদেশটি ১০ লাখ রুপী পুরস্কার ঘোষণা করে। মাহফুজকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ভারতের স্পেশাল টাস্কফোর্স (এসটিএফ) ও দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) দুটি দল বাংলাদেশে এসেছিল। তারা ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের মাধ্যমে মাহফুজের কাছ থেকে খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ, ভারতে জেএমবিসহ অন্যান্য জঙ্গী সংগঠনের নেটওয়ার্ক, জঙ্গীদের অর্থায়ন, কোন্ কোন্ দেশের কি পরিমাণ জঙ্গী ভারতে রয়েছে, এসব তথ্য জানার চেষ্টা করে। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স শাখার সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে জানান, ঈদ মৌসুমকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে বিশেষ অভিযান চলছে। আর জঙ্গী মাহফুজ সম্পর্কে তথ্য জানতে ভারত থেকে আসা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের তালিকা হাতবদল হয়েছে। তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের প্রকৃত নাম-ঠিকানা যাচাই-বাছাইসহ তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৭ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গী হামলা, জঙ্গী অর্থায়ন, জঙ্গীদের আত্মগোপন, জামিন, সীমান্তপথে অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়াসহ নানা বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে আমেরিকা ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত আলোচনা চলছে। ভারত ও আমেরিকার সঙ্গে এসব বিষয়ে বেশ কয়েক দফা বৈঠকও হয়েছে। বৈঠকে জঙ্গী তৎপরতা ও তাদের অর্থায়নের কৌশলসহ নানা বিষয় সম্পর্কে তথ্য- উপাত্ত প্রকাশ করা হয়। তাতে ঈদের সময় জঙ্গীদের অর্থ সংগ্রহ কার্যক্রম, দেশত্যাগ, দেশে প্রবেশসহ নানাভাবে তৎপরতা থাকার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। জঙ্গী অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানী জঙ্গীরা ঈদের সময় জাল মুদ্রার ব্যবসা করে বলে জানানো হয়। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ঈদের সময় সীমান্তপথে অনেক লোক বাংলাদেশ ও ভারতে যাতায়াত করেন। ব্যবসা, চিকিৎসা, বেড়ানো ও ঈদ উপলক্ষে দুই দেশের মধ্যে যাতায়াতের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সুযোগটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করে জঙ্গী ও পেশাদার অপরাধীরা। তারা ঈদের অনেক আগেই সীমান্তবর্তী স্থানগুলোতে আশ্রয় নেয়। এরপর সুযোগ বুঝে দেশে অনুপ্রবেশ বা দেশত্যাগ করার চেষ্টা করে। এজন্য বাংলাদেশ ও ভারত প্রতিবছরের মতো এবারও সীমান্তবর্তী স্থানগুলোতে একসঙ্গে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হবে। কমপক্ষে টানা দুই সপ্তাহ এমন অভিযান চলবে। মূলত জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতেই দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন প্রযুক্তি নির্ভর সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করেছেন। জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার, চোরাচালান, নারী-শিশু পাচারপ্রবণ পয়েন্টে সিসি ক্যামেরার পাশাপাশি টহল জোরদার করা হয়েছে। এসব পয়েন্ট দিয়ে জঙ্গীরা যাতে প্রবেশ ও দেশত্যাগ করতে না পারে এজন্য বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে যার যার দেশে টহল দেবে। বাংলাদেশের যশোর, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, শেরপুর ও কুমিল্লা সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্টে কড়া টহল ও অভিযান চলবে। এসব জেলার সীমান্ত পয়েন্টে জাল নোটের কারবারের পাশাপাশি জঙ্গীদের দেশে অনুপ্রবেশ ও দেশত্যাগের অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম (সংঘবদ্ধ অপরাধ) নিয়ন্ত্রণ বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, জাল মুদ্রার কারবারি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গী ও অপরাধীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। অভিযানের মাত্রা সামনে আরও বাড়বে।
×