ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বেণীর মতো পেঁচানো যমুনার বাঁধ ভাঙছে যে কারণে-

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৭ আগস্ট ২০১৭

বেণীর মতো পেঁচানো যমুনার বাঁধ ভাঙছে যে কারণে-

সমুদ্র হক ॥ যমুনার পশ্চিম তীরে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের আয়ুষ্কাল অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। ষাটের দশকে নির্মিত রংপুরের কাউনিয়া থেকে বগুড়া হয়ে পাবনার বেড়া পর্যন্ত ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বাঁধ টিকিয়ে রাখতে প্রতি বছর সংস্কার কাজের সঙ্গে নতুন করে মাটি ফেলে ঢাল ও চওড়া বাড়নো হয়। তারপরও এই বাঁধের অনেক স্থান ভেঙ্গে যায়। ছোট ও মাঝারি বন্যা এই বাঁধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বড় বন্যা হলেই বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙ্গনের সূত্রপাত হয়। মানুষ ও ইঁদুরের কারণেই এই বাঁধের ক্ষতি হয় বেশি। ইঁদুর বাঁধের বিভিন্নস্থানে বড় ধরনের গর্ত খুঁড়ে আবাস গড়ে তোলে। বিশেষ করে বন্যার সময় ইঁদুর এই কাজটি করে বেশি। যমুনা তীরের ইঁদুর এতই বড় যে মনে হবে অন্য কোন প্রাণী। ওরাও আশ্রয় নেয় গর্ত খুঁড়ে। মনে করে নিরাপদ আশ্রয়। বাঁধ ভেঙ্গে গেলে ওরাও ভেসে যায়। তার আগে এই ইঁদুর নিজেদের ও মানুষের ক্ষতি করে বাঁধের মাটি খুঁড়ে। বন্যার পানি বেড়ে গিয়ে বিপদসীমা অতিক্রম করার সঙ্গেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মীরা ইঁদুরের গর্ত দ্রুত ভরাট করে ভাঙ্গন ঠেকানোর চেষ্টা করে। গর্ত ভরাট করার পর ইঁদুর লোকজনের আড়ালে ফের গর্ত করতে থাকে। এই অবস্থায় বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে শুরু হয় ‘সিপেজ’। সিপেজ হলো ওইসব গর্ত দিয়ে পানি ঢুকে বাঁধের বিভিন্ন স্থানে পানি চোয়ানো শুরু করে। একটা পর্যায়ে বাঁধের ঢাল দিয়ে জলপ্রপাতের মতো পানি ঝরতে থাকে। বাঁধ নড়বড়ে হয়ে যায়। বাঁধের ওপরের সড়ক অংশে যখন পানি ছুঁই ছুঁই অবস্থা তখন স্রোতের তীব্র ধাক্কা ও সিপেজ শক্তিশালী হয়ে বাঁধকে অনিয়ন্ত্রিত করে অংশ বিশেষ ভেঙ্গে দেয়। তারপরই হুহু করে যমুনার পানি পশ্চিম তীরের গ্রাম ও লোকালয়ে প্রবেশ করে ভাসিয়ে দেয় বিস্তীর্র্ণ এলাকা। এই বাঁধ তার সুরক্ষা হারায় বাঁধের ওপর মানুষের বসতি গড়ায়। বগুড়ার সারিয়াকান্দি এলাকায় গিয়ে চোখে পড়বে পশ্চিম প্রান্তে বাঁধের ঢালু অংশে নদী ভাঙ্গনে বসত হারানো মানুষ এবং ‘বানভাসিরা’ (বন্যায় বাড়ি ঘর ডুবে যাওয়া মানুষ) ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কোথাও টিনের চালার বাড়ি। বংশ পরম্পরায় তারা এভাবে বাঁধে বসত গড়েছে। বন্যার সময় এই বাঁধের ওপরই আশ্রয় নেয় হাজারো বানভাসি মানুষ। তাদের একটা অংশ থেকে যায়। বাকি অংশ পানি নেমে গেলে ফিরে যায় নিজেদের গ্রামে। একদিকে ইঁদুরের গর্ত, সিপেজ আরেক দিকে বাঁধের ওপরে বসত গড়ার চাপ পড়ায় যমুনার তীব্র স্রোতের ধাক্কা বাঁধ অনেক সময় সইতে পারে না। স্রোতের এই ধাক্কা যদি ‘ব্যাক ফ্লো’ (একবার আঘাত করার পর বাধা পেয়ে পেছনে গিয়ে প্রবল শক্তি নিয়ে ফের আঘাত) হয় তাহলে বাঁধ দ্রুত নড়বড়ে হয়ে ভেঙ্গে যায়। পাউবোর নিয়মে বাঁধের ওপর মানুষের বসতি তো দূরে থাক গরু চড়ানো পর্যন্ত যাবে না। সেখানে ভর বছর বাঁধে আশ্রিত হয়ে আছে হাজারো পরিবার। পাউবো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ এবং জনপ্রতিনিধি মানবিক কারণে আশ্রিতদের সরিয়ে দিতে পারে না। উত্তরাঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভাঙ্গন প্রতিরোধে যমুনার তীরের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ এলাকায় এ যাবত বহু কোটি টাকা ব্যয়ে যত অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া কোনটিই টেকেনি। বর্ষা মৌসুম এলেই বিশ্বের একমাত্র ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ মেয়েদের চুলের বেণীর মতো পেঁচানো যমুনা নদী তার তা-ব নাচন শুরু করে দেয়। পাউবো জিওটেক্স, বালির বস্তা, সিসি ব্লক নিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকে। পানি বেড়ে গিয়ে স্রোতের গতি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গেই যমুনার সঙ্গে যুদ্ধের মতো সিসি ব্লক নিক্ষেপ করা হয়। আরেক দিকে যে সব এলাকায় পানি ঢুকে পড়ার শঙ্কা দেখা দেয় সেখানে বালির বস্তা দিয়ে তীর রক্ষার চেষ্টা করা হয়। সিসি ব্লক ফেলে স্রোতের গতি কমানো না গেলে আর কোন উপায় থাকে না। তখন যে ভাবেই হোক যমুনা তীরে আঘাত করবেই এবং তা করেও। হয় বাঁধ ভাঙবে। না হয় গ্রামে ও চরগ্রামে নদীর তীর ভেঙ্গে হাজারো মানুষের বসত ভিটা জমি জিরাত কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করে দেবে। এ ক্ষেত্রে পাউবোর কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। যার মধ্যে আছে বাঁধ নির্মাণের সময় বালির পরিমাণ বেশি দেয়া। তার ওপর মাটি ভরাট করে কম্প্যাকশন ঠিকমতো না করা। কখনও সামান্য মাটি দিয়ে বালির বাঁধ নির্মাণ করা হয়। যে ভাবে বাঁধ নির্মাণের কথা থাকে সে ভাবে না করা। শুকনো মৌসুমে বাঁধের সংস্কার কাজ না করে বর্ষার আগেই তা শুরু করা। এতে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে পাউবোর কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের লাভ বেশি। ফের কাজ পেয়ে ঠিকমতো কাজ না করে বহু অর্থ বানানো। এলাকার লোকজন বিষয়গুলো ভালভাবেই জানে। তারপরও নীরবেই সয়ে থাকে। তারা শুধু দেখে মানুষকে বাঁচানোর নামে কাজ করে বাঁধ নির্মাণের কথা বলে পাউবোর কর্মকর্তা আর ঠিকাদাররা কি ভাবে নিজেদের বাড়ি প্রাসাদ বানিয়ে ফেলেছে। পাউবোর কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বাড়ি দেখলেই প্রমাণ মেলে এত টাকা তারা কিভাবে পায়। দুর্নীতি দমন বিভাগও তা খতিয়ে দেখে না। বছরের অন্যান্য সময়ে যমুনা যতটা শান্ত থাকে বর্ষা মৌসুম শুরু হলেই যমুনা তারচেয়ে বেশি রুক্ষ হয়ে ধ্বংসের আচরণ শুরু করে দেয়। তখন যমুনাকে দেখে চেনাই যাবে না। মনে হবে এই কি সেই শান্ত যমুনা। যে যমুনার মৃদু স্রোত মানুষকে আনন্দ দেয় বর্ষায় সেই যমুনার জলোচ্ছ্বাসের মতো তীব্র স্রোত একের পর এক লোকালয়ে প্রবেশ করে তা-ব ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে দেয়। যমুনা তীরের মানুষ এভাবেই যমুনাকে দেখছে বংশ পরম্পরায়। অস্তিত্বের লড়াইয়ে বছরের পর বছর যুগের পর যুগ যমুনার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছে তারা। এ খেলা চলছে নিরন্তর...।
×