ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অভিযোগ ফজলে নূর তাপসের

রায়ে প্রধান বিচারপতির অংশ ড্রাফট করেছেন এক দৈনিকের সম্পাদক

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১৪ আগস্ট ২০১৭

রায়ে প্রধান বিচারপতির অংশ ড্রাফট করেছেন এক দৈনিকের সম্পাদক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে আওয়ামী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীগণ প্রথমদিন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী পালন করেছেন। টানটান উত্তেজনার মধ্যদিয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচীতে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতৃবৃন্দ উত্তপ্ত বক্তব্য প্রদান করেন। এই কর্মসূচীর ঢেউ সারাদেশের বারগুলোতেও পড়েছে। সারাদেশের বারগুলোতেও পালিত হয়েছে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী। কর্মসূচী পালনকে কেন্দ্র করে আদালত অঙ্গনে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীও ছিল সজাগ। যাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। সমাবেশে বক্তাদের বক্তব্য আর মুর্হমুর্হ স্লোগানে আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে ছিল টানটান উত্তেজনা। দুইপক্ষই কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তাদের একই কথা দাবি না মানলে পরবর্তী সময়ে কঠোর কর্মসূচী দেয়া হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করে যে রায় দেয়া হয়েছে তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে এ রায় বাতিল করে প্রয়োজনে নতুনভাবে রায় লেখার আহ্বান জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ। একইসঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যগুলো অনতিবিলম্বে প্রত্যাহারেরও দাবি জানানো হয়। কিছু অপশক্তি ষড়যন্ত্র করেছে।’ ‘আমরা জানি কারা এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে লিপ্ত। এ ড্রাফট কোথা থেকে এসেছে। একটি ইংরেজী পত্রিকার সম্পাদক এ ড্রাফট করে দিয়েছে। আমরা সেটার নিন্দা জানাই। অন্যদিকে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের পক্ষে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য দেয়ায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে অপসারণ ও গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়। আইনজীবীদের সুপ্রীমকোর্টের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন বারে এ কর্মসূচীর খবার পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে মাদারীপুর জেলা আইনজীবী সমিতি, সিলেট, যশোর, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতিতেও এ কর্মসূচী পালিত হয়েছে। শনিবার সাংবাদিক সম্মেলন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধ সংগঠন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ তিনদিনের কর্মসূচী ঘোষণা করে অভিযোগ করেছে যে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার পথ সুগম করবে। রায়ে যে সমস্ত ‘আপত্তিকর, অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক, অপ্রাসঙ্গিক’ পর্যবেক্ষণ রয়েছে, সেগুলো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। এ দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গতকাল রবিবার এবং আগামী বুধ ও বৃহস্পতিবার দুপুরে সারাদেশের আইনজীবী সমিতিতে তিনদিনের প্রতিবাদ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা এবং আগামী দিনে কঠোর কর্মসূচী পালনের হুমকি দিয়েছে এ সংগঠনটি। একইসঙ্গে বিএনপি-সমর্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুলক হককে রায় নিয়ে মন্তব্য করায় তার পদত্যাগের দাবিতে ওই তিনদিন পাল্টা কর্মসূচী দিয়েছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রীমকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, সে রায়ের প্রধান বিচারপতির বক্তব্য সম্বলিত ড্রাফটটি একটি ইংরেজী দৈনিকের সম্পাদক করে দিয়েছেন।’ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপস এ কথা বলেছেন। রবিবার সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবন মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ে ‘অপ্রাসঙ্গিক ও অসাংবিধানিক বক্তব্যে’ সংক্ষুব্ধ আইনজীবীরা এ সমাবেশের আয়োজন করেন। ব্যারিস্টার তাপস বলেন, ‘আমাদের কথা একদম পরিষ্কার, আপনারা জানেন যেই ষোড়শ সংশোধনীর রায় হয়েছে, সেই রায়ে যেই সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছিল। একটি পয়েন্টে সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছিল। সেটা হলোÑ আর্টিকেল ৯৬ (২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭) প্রযোজ্য হবে কি হবে না, সাংবিধানিক হবে কি হবে না। কিন্তু আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি। সেই ইস্যু বাদ দিয়ে ভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, কিছু অপশক্তি ষড়যন্ত্র করেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জানি কারা এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে লিপ্ত। একে একে আমরা তাদের মুখোশ উন্মোচিত করব জাতির কাছে। আমরা জানি এ ড্রাফট কোথা থেকে এসেছে। একটি ইংরেজী পত্রিকার সম্পাদক এ ড্রাফট করে দিয়েছে। আমরা সেটার নিন্দা জানাই। এ রকম অপ্রাসঙ্গিক, অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক যেই বক্তব্য লেখা হয়েছে ৬ জন বিচারপতি সেটার সঙ্গে একমত পোষণ না করে বিরত থেকেছেন। আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই। এবং তার সঙ্গে সঙ্গে এ অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যগুলো অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করার দাবি জানাই।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন যখনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংবিধান এবং গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে, আইনজীবী সমাজ সব সময় জেগে উঠেছে। রুখে দাঁড়িয়েছে। আজকে সেই ষড়যন্ত্র দানা বেঁধেছে। আজকে আইনজীবী সমাজ ক্ষুব্ধ এবং তাই এ প্রতিবাদ আয়োজন করেছে। আমাদের এ প্রতিবাদ সমাবেশ চলবেই।’ আগামী বুধবার এর প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করা হবে বলে উল্লেখ করে ব্যারিস্টার তাপস বলেন, ‘সারাদেশে সকল বারে আমাদের এ প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজিত হচ্ছে। তাতে জনগণ আছে। বৃহস্পতিবারও আমাদের কর্মসূচী পালন করা হবে।’ এ সময় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেনÑ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকট আব্দুল মতিন খসরু, প্রেসিডিয়াম সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ন, আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল বাসেত মজুমদার প্রমুখ। সমাবেশে বার কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল বাসেত মজুমদার বলেন, ‘এ রায়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যে কটাক্ষ করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে তাতে আমি মনে করি, এ রায় আর থাকার কোন সুযোগ নাই।’ ‘আমি অনুরোধ জানাই অনতিবিলম্বে স্বপ্রণোদিত হয়ে এ রায় বাতিল করে প্রয়োজনে নতুন রায় লেখার। সেই রায় হবে সংশোধনীর রায়।’ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘যে রায় দেয়া হয়েছে, যে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে, একক ব্যক্তির নেতৃত্বে তা হয়নি। এটা আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। ‘আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু বলেন, ‘এ রায়ের পর বিএনপি মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন মিছিল বের করছেন এটা কিসের লক্ষণ? এটাত পাকিস্তান না। যে সুপ্রীমকোর্ট রায় দেবে আর সেনাবাহিনী এসে দখল করে আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। এ দিবাস্বপ্ন দেখবেন না। ‘আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘সংসদ সার্বভৌম। সংসদকে হেয় করে আপনি (প্রধান বিচারপতি) কী বোঝাতে চেয়েছেন তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। ‘বিচারক অপসারণে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থার সমালোচনা করে রেজাউল করিম বলেন, ‘মার্শাল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আইনকে একদিকে বৈধ বলবেন আর গণতান্ত্রিক সংসদের প্রতিষ্ঠিত আইনকে বলবেন অবৈধ এ বিষয়গুলো জাতি বুঝতে পারছে না। আমাদের পরিষ্কার কথা এ বাংলাদেশের চোরাগলি দিয়ে ক্ষমতায় আসার পথ আর কারও জন্য নাই।’ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক আপত্তিকর বক্তব্য দেয়ায় তাকে অপসারণ ও গ্রেফতার দাবি করেছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। এ দাবিতে বিএনপি সমর্থক শতাধিক আইনজীবী গতকাল সুপ্রীমকোর্ট বার ভবনে বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিল শেষে আইনজীবী ভবনের সমানে বিচারপতি খায়রুল হকের অপসারণ ও গ্রেফতার, মন্ত্রীদের বক্তব্যের মাধ্যমে সুপ্রীমকোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা ও নিম্ন আদালতের চাকরি বিধিমালার গেজেট অবিলম্বে প্রকাশের দাবিতে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন আইনজীবীরা। এতে বক্তব্য রাখেনÑ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতায় রায় চৌধুরী, সুপ্রীমকোর্ট বারের সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন, সানাউল্লাহ মিয়া, সাবেক সম্পাদক বদরুদ্দোজা বাদল, কায়সার কামাল, আবেদ রাজা, শওকতউল হক, মনির হোসেন, ফাহিমা নাসরিন মুন্নি, মোহাম্মদ আলী, গাজী কামরুল ইসলাম সজল, মির্জা আল মাহমুদ, থারুক হোসেন, তাহসিন আলী প্রমুখ। মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, বিচারপতি খায়রুল হক ডাবল স্ট্যান্ডার্ড গ্রহণ করেছেন। তিনি তার রায়ে বলেছেন, বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের পর চাকরিতে যোগদান করা উচিত নয়। আবার তিনি সরকারী চাকরি নিয়েছেন। তিনি প্রধান বিচারপতি ও ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করেছেন। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাতিল সংক্রান্ত মামলায় ওপেন কোর্টে যে রায় দেয়া হয়েছিল, ১৬ মাস পর সেই রায় পাল্টে দিয়েছেন। এ রায় দিয়ে তিনি জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। অনেকে বলছেন, তাকে দেশ ছাড়া করতে হবে, আমি বলছি, তাকে গ্রেফতার করে জনতার আদালতে বিচার করতে হবে।
×