ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

লটকন বাগানে একদিন...

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১১ আগস্ট ২০১৭

লটকন বাগানে একদিন...

ছুটি থেকে ছুটি নিয়েছেন কখনও? মাসের প্রথমে ব্যাংক এ কাজের চাপ গিয়েছে খুব। একদিনের ছুটি নিয়ে বেশ লম্বা বন্ধ পেয়েছি। আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল এই বন্ধে চুটিয়ে ঘুরে বেড়াব। কিন্তু বিধি বাম ঘাড়ে এসে জুটল দায়িত্বের ভার মাসের বাজার শেষ করতে হবে । মা’র কড়া নির্দেশ কোথাও যাওয়া যাবে না । অগত্যা ঘরে বসে থাকতে হলো প্রথম দিন এদিকে অফিস খোলার আর দুই দিন বাকি মাকে অনেক বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজি করালাম । কিন্তু কোথায় যাব তা ঠিক করা ছিল না। তবে চিন্টু আগের থেকে বলেছিল ওর বন্ধুর বাড়ি নরসিংদী নিয়ে যাবে ওখানে লটকন বাগান আছে। ছোটবেলায় মা অফিস থেকে আসার সময় ব্যাগে করে লটকন নিয়ে আসত টক-মিষ্টির অপূর্ব স্বাদ। মা আবার লটকন বেশি খেতে দিতেন না বলতেন বেশি খেলে বুঝি জ্বর আসে। শুক্রবার সকাল ৯টা। মোবাইলটা বেজে চলছে ক্লান্তিহীন। ঘুম ঘুম চোখে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকালাম। চিন্টুর ফোন রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে চিন্টু বলল, ‘৯টায় লটকন বাগানে ঘুরতে যাওয়ার কথা দাদা। সেই কখন থেকে কল করছি। কোন সাড়া পাচ্ছি না া। আমি বললাম তুমি বাসায় আস আমি রেডি হয়ে হচ্ছি। আমাদের গাড়ি রওনা দিল নরসিংদীর দিকে। বন্ধের দিন তাই ঢাকার রাস্তা ফাঁকা। খালি রাস্তা গালি চলছে বেপরোয়া গতিতে। হাইওয়েতে দেখলাম রাস্তা নতুন কার্পেটিং করা। সবাই লেন মেনে চালালে আরামে তিনটা গাড়ি চলতেই পারে। হাইওয়ের দুপাশে মাঝেমধ্যেই রঙিন সব গেট, দূর গ্রামের ঈদ এর জন্য সাজিয়েছে । না জানি কত হইচই হচ্ছে! খুব ইচ্ছে করছিল লাল-হলুদ কাগজ দিয়ে সাজানো আয়োজনে শামিল হই। কিন্তু আমরা ছুটে চলেছি নরসিংদীর দিকে। মেঘনার ওপর দাপটের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রিজ পার হতে হতে দুচোখে খোঁজার চেষ্টা করলাম জীবনানন্দের অনুপ্রেরণা। হঠাৎ ্রগ্রাম শেষ। পথের দুপাশে বিভিন্ন কারখানা, আধুনিক রফতানিমুখী কারখানার কয়েক মাইলজুড়ে দেশের অগগ্রগতির নানা নিদর্শন। স্পিনিং, সিরামিকস, মশার কয়েল, কী নেই! সকাল সাড়ে ১২টার দিকে আমরা নরসিংদী এসে পৌঁছালাম পাঁচদোনা মোড়ে চিন্টুর বন্ধু সপ্তক অপেক্ষা করছিল । সেখান থেকে সপ্তকের মামা লটকন বাগান ঘুরে আসার জন্য লোক দিলেন। নরসিংদীর পাঁচদোনা মোড় থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে আমাদের যেতে হবে ‘মরজাল’ নামের স্থানে। সেখানেই নাকি লটকনের বাগান। আমরা এগিয়ে চলছি লটকন বাগানের দিকে। চোখ কচলে গাড়ির জানালা দিয়ে সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম, একটা লটকনগাছও যেন মিস না হয়। রাস্তা ক্রমেই সরু“ হয়ে আসছে সামনের দিকে। পিচ ঢালা রাস্তার দুই পাশে নাম না জানা গাছের সারি। হঠাৎ করে চিন্টু চেঁচিয়ে উঠল, ‘লটকন’, ‘লটকন’! তার আঙ্গুলের নিশানা বরাবর আমিও দাঁড়ালাম, ওই তো বাঁ পাশে এক গাছভর্তি লটকন ঝুলে আছে। তড়িঘড়ি করে নামতে যাচ্ছিলাম। আমাদের পথ প্রদর্ক বাধা দিলেন, ‘সামনে আরও আছে, এগুলো তো শোপিস। কথায় বলে অপরিচিত জায়গায় অভিজ্ঞদের কথা শুনতে হয়, নইলে বিপদ। শক্ত হয়ে বসে রইলাম আরও বেশি গাছ দেখার আশায়। কিন্তু আর তো পাওয়া যাচ্ছে না! তবে কি এই একটাই গাছ আছে পুরো নরসিংদীতে। মন খারাপের ঠিক চূড়ান্ত অবস্থায় বিকেলের সোনালি আলোটা যেন আরও বেশি সোনালি রং নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সামনের দুই পাশের গাছগুলোতে। হঠাৎ করেই যেন লটকনের রাজত্বে চলে এলাম। গ্রামে ঢুকতেই সড়কের দুই পাশে নজর কাড়ে অসংখ্য ছোট-বড় লটকনের বাগান। আছে কাঁঠাল আর জলপাইয়ের বাগানও। গাছের আড়াল থেকে ভেসে আসে ঘুঘু ও চৈতার বউপাখির সুরেলা কণ্ঠ। আমরা মুগ্ধ হই। চোখের সামনে দিয়ে যখন-তখন দুধ পাখিসহ বিভিন্ন পাখি এ-গাছ থেকে ও-গাছে উড়ে যাওয়ার দৃশ্য সেই মুগ্ধতা আরও বাড়িয়ে তোলে। হালকা জনবসতির এই এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে লটকন বাগান। অধিকাংশ গাছের নিচ থেকে ওপরের অংশের শাখা-প্রশাখায় লটকন ফল জড়িয়ে আছে। পুরো গাছভর্তি লটকন পেকে হলুদ হয়ে আছে, সেই পাকা রঙে বিকেলের আলো আরও সোনালি করে তুলেছে পুরো পরিবেশ। হাঁ করা মুখ নিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। যতদূর চোখ যায় শুধু লটকন আর লটকন। গাছের গোড়া থেকে শুরু“ করে ডালপালা পর্যন্ত ঝুলন্ত পুষ্পমঞ্জরিতে থোকায় থোকায় লটকন। প্রতিটি পুষ্পমঞ্জরিতে ৫ থেকে ৫০টি ফল। দেখে মনে হয় যেন পুরো গাছে লটকনের ফুল ফুটেছে। একেবারে গোড়া থেকে শুরু“ করে চোখ যায় না এমন ওপর পর্যন্ত ধরে আছে অজস্র লটকন। একেকটা আকারেও বিশাল। প্রতিটা গাছতলায় ঝরা পাতার মতো পাকা লটকন পড়ে আছে। এত বড় লটকন সচরাচর দেখা যায় না। পাশে বাড়িঘর। তার পাশে কাঁঠালগাছের সারি, মাঝখানে লটকনের মিছিল। খাওয়ার কেউ আছে বলে মনে হলো না। আমরা গাড়ি থেকে নেমে আসি পাশে কেউ নেই দেখে লোভ সামলাতে না পেরে লটকন পেরে খওয়া শুরু করলাম । আহ! অমৃত। টসটসে রসে ভরা কী মিষ্টি! একসময় দেখি এক লোক আমাদের ডাক দিচ্ছেন , তা দেখে চিন্টুর দৌড় দেয়ার উপক্রম উনি বললেন, ‘লটকন খাবেন? এদিকে আসেন। এদিকে অনেক লটকন আছে। গিয়ে দেখি তিনি মূলত লটকন ব্যবসায়ী। নাম জানতে চাইলে বললেন রমিজ আহমেদ, তিনি বললেন ছোটখাটো একটা আড়ত আছে তার। সেখানে ঝুড়িতে লটকন সাজানো হচ্ছে। শহরে নিয়ে বিক্রি হবে এগুলো। এত সুন্দর, পরিপাটি করে লটকনগুলো সাজানো হচ্ছে যে দেখে মনে হয় সব নিয়ে যাই।’ তার কাছ থেকে জানলাম, পুরো লটকন বাগান তারা বছরের শুরুতে ইজারা নেন। বৈশাখ মাসে গাছে ফল আসে আর বর্ষায় এগুলো পাকা শুরু করে। লটকন ফলের রং হলুদ ও ভেতরে দুই থেকে পাঁচটি বীজ হয়, বীজের গায়ে লাগানো রসাল অংশ খাওয়া হয়ে থাকে। জাতভেদে টক বা টকমিষ্টি স্বাদের লটকন জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে বাজারে পাওয়া যায়। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও লটকন রফতানি করেন তিনি। এই বড় লটকনগুলো যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে পাঠানো হবে। এ বছর থেকে তিনি লটকন প্যাকেটিং করে রফতানি শুরু করেছেন। সাধারণত লটকন দুই থেকে তিন দিন পর্যন্ত রাখা যায়। কিন্তু প্যাকেটিং করার কারণে সেই লটকন সাত-আট দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব হচ্ছে। আমরা রমিজ ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নেব তখন রমিজ ভাই আমাদের এক ঝুড়ি লটকন উপহার দিলেন প্রথমে নেব না বলেছিলাম পরে ভাবলাম ঈদের বন্ধের পর অফিসে গিয়ে সবাইকে ঈদের উপহার হিসেবে লটকন দেয়া যাবে তাই আর না বললাম না। আমার গাড়ি বোঝাই করে লটকন নিয়ে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। চলতি পথে দেখলাম এখানকার লোকজনের প্রায় সব বাড়িতেই লটকন গাছ আছে। সেসব গাছে পাতার থেকে লটকন বেশি। দেখতে দেখতে চলে এলাম সৃষ্টিগড় বাজারে। এটা মূলত লটকনের হাট। এখানে আরও বড় পরিসরে লটকন বিক্রি হয়। মাত্র ঘণ্টাখানেকের লটকন অভিযান শেষ করে আমরা আবার গেলাম চিন্টুর বন্ধু সপ্তকের বাসায় সেখানে দুপুরের ভুড়িভোজ সেরে আমরা ফিরে চললাম যাত্রিক জীবনে । কিভাবে যাবেন ঢাকার সায়েদাবাদ, বনানী, মহাখালী বা উত্তরা থেকে যেকোন নরসিংদীর বাসে উঠে পাঁচদোনা বাসস্ট্যান্ড নামবেন। সেখান থেকে সিএনজি/ মাইক্রোবাস ভাড়া করে চলে যাবেন মরজাল। সেখানে চালককে বললেই হবে যে লটকন বাগান দেখতে যাবেন, তিনিই আপনাকে কামারটেকের রাস্তা দিয়ে সৃষ্টিগড় পর্যন্ত নিয়ে যাবেন। এ ১৫ থেকে ১৬ কিলোমিটার সরু রাস্তার পুরোটাই লটকন বাগান। লটকন জুলাই মাসের পর আর পাওয়া যাবে না। ফেরার সময় ভেলনগর বা পাঁচদোনা হয়ে আবার চলে আসতে পারেন। ঢাকা থেকে নরসিংদীর পাঁচদোনা পর্যন্ত বাসভাড়া ১০০ টাকা অথবা ঢাকা থেকে মাইক্রোবাস ভাড়া করে নিতে পারবেন ভাড়া নিবে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা [email protected]
×